হেথায় কিছু লিখব বলে চায় যে আমার মন, নাই বা লেখার থাকল প্রয়োজন!
বিশ্ব এখন টুয়েন্টি টুয়েন্টি জ্বরে আক্রান্ত। আনিসুল হকের মতে, এই টুয়েন্টি-টুয়েন্টিই পৃথিবীর ভবিষ্যত। শুধু ক্রিকেটের ক্ষেত্রে না, পড়াশুনা থেকে শুরু করে টিভি-বিনোদন, প্রেম-ভালোবাসা, বিয়ে - অদূর ভবিষ্যতে সবকিছুই চলবে টুয়েন্টি টুয়েন্টি ফর্মূলা অনুযায়ী। বিস্তারিত পড়ুন আনিসুল হকের এই লেখাটি ...
---------- ---------- ---------- ----------
বিশ্ব এখন ব্যস্ত টুয়েন্টি-টুয়েন্টি নিয়ে! কয়েকটা খেলা দেখে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ টুয়েন্টি-টুয়েন্টি, সেটাও যদি পানসে মনে হয়, তবে টুয়েলভ টুয়েলভই মনে হচ্ছে ভালো। বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০ ওভারে ১২০ পেরিয়েছে, তবু সেই খেলা দেখে মনে হচ্ছে, এ কী দেখছি।
পেটায় না কেন? দুদিনেই অভ্যাস এ রকম খারাপ হয়ে গেছে। খালি মনে হচ্ছে, পেটাও পেটাও। চার আর ছক্কা হলেই চলবে চিয়ার লিডাদের নাচ, উদ্দাম, উচ্চকিত, উচ্চনাদ বাদ্যের তালে তালে। সময় বেশি নাই, মাত্র ২০ ওভার খেলতে হবে, এর মধ্যেই শ্রীলঙ্কার মতো করে ফেলা চাই ২৬০। যে যুগের যে ভাও।
এখন সবকিছুই ইনস্ট্যান্ট।
অত সময় আছে নাকি যে রয়েসয়ে সময় নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করব। সবকিছু তৈরি থাকবে, চাওয়ার আগেই পেয়ে যাব, থালা-বাসনের কারবার নাই, সরাসরি মুখে, চিবানোর কষ্টটা তবু তরতেই হয়। এখনো, ভবিষ্যতে আশা করি, তাও করতে হবে না।
পৃথিবীর সবকিছু চলছে টুয়েন্টি-টুয়েন্টি ফরমুলা অনুসারে।
এখন সম্পর্ক টুয়েন্টি-টুয়েন্টি, দেখা হবে, কথা হবে, ভাব আর স্বার্থে বিনিময় হবে, তারপর যে যার পথে চলে যাবে, কা তব কান্তা, পৃথিবীতে কে কাহার। এখন বন্ধুত্ব হবে টুয়েন্টি-টুয়েন্টি, কাল তোমাকে আমার দরকার ছিল, তাই ব্যাটে বলে বেশ জমেছিল, আজ আর দরকার নাই, তোমাকে, হে বন্ধু, বিদায়। যাব বলে থেমে থাকতে নেই।
প্রেমও হবে টুয়েন্টি-টুয়েন্টি ফাস্টফুডের মতো, ইনস্ট্যান্ট কফির মতো, তারপর ৪০ ওভার পর্যন্ত যদি টেকা গেল তো গেল, না গেলে চার ঘন্টার আগেই...আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে। পালে হাওয়া লাগিবে, পোস্টমাস্টারদের মতো হৃদয়ে দার্শনিক তত্ত্বও উদিত হওয়ার কারণ নাই, কেহই বর্ষাবিস্ফারিত নদীর দিকে তাকাইয়া বলিবে না, পৃথিবীতে কে কাহার।
কারণ সে আগে থেকেই জানে, পৃথিবীতে এই রূপ কত বিরহ-মিলন আছে। প্রেম একবার নয়, বারবার আসবে। দাম্পত্যও এ রকম টুয়েন্টি-টুয়েন্টি হয়ে যাবে। তোমার পথে তুমি চলবে আমার পথে আমি। মধ্যখানে কিছুদিনের জন্যে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে যদি দেখা হয়েই যায়, দুই কাপ চা দুজনে পাশাপাশি বসে খেতেও পারি।
তারপর ট্রেন এসে গেলে তোমার ব্যাকপ্যাক তোমার পিঠে, আমার ঝোলা ব্যাগ আমার কাঁধে। গতস্য শোচনা নাস্তি। সম্মুখে শান্তি পারাবার। লেখাপড়া টুয়েন্টি-টুয়েন্টি হয়ে গেছে অনেক আগেই, অন্তত এই বাংলাদেশে। সারি সারি কোচিং সেন্টার।
উত্তর লিখে দিচ্ছে শিকেরা, ছাত্ররা মুখস্থ করছে, উগরে দিচ্ছে।
মূল টেক্সট কেউ পড়ছে না, গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি স্কুলের বাচ্চাদের সামনে চিল্লাচ্ছেন, তোমরা শুধু অঙ্ক কোরো না, গণিত শেখো, প্রশ্নের আগে গণিত বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে কতগুলো বর্ণনা থাকে, জিনিসটা কী বুঝিয়ে বলা হয়, সেসব পড়ো, পড়ে বোঝো। কে শুনবে কার কথা। গণিতের নামে অঙ্ক।
আর আছে এমসিকিউ, টিক দিয়েই পার হয়ে যাওয়া চলে পরীক্ষা নামের বৈতরণী।
রাজনীতিও হবে টুয়েন্টি-টুয়েন্টি। এমনকি সংস্কারও। সবকিছু আসবে প্যাকেজে। প্যাকেজিংটা খুব দরকারি। মোড়কটা হতে হবে আকর্ষণীয়।
ফয়েল পেপার, ভালো ছাপা।
বিচারও তা-ই হবে। রাব বানানো হবে। যৌথ বাহিনী অভিযান পরিচালনা করবে। ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার।
স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল। এই প্রক্রিয়ায় ইন্দিরা গান্ধী নকশাল দমন করেছিলেন। আমরাও পারব। পারতেই হবে।
সবকিছু হবে সীমিত ওভারের।
আমাদের সাহিত্য এখন সীমিত ওভারের, বড় বড় উপন্যাস এখন আর কেউ পড়বে না, লিখবে না, উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত-সরল সংস্করণ বেরোবে, দরকার পড়লে ধ্র“পদী উপন্যাসের কমিক গিলব আমরা। আমাদের নাটক এখন সীমিত ওভারের।
এক নাটকে ১০ দিন শুটিং করার সময় নাই, কদরও নাই। মনে পড়ে, সাইদুল আনাম টুটুল নাল পিরান-এর শুটিং করতে দুই দফায় শুধু রংপুরেই ছিলেন ১০ দিন, এর বাইরে ঢাকাতেও শুটিং হয়েছিল। এখন এক দিনে দেড় পর্ব নামাতে হবে।
দেশে চলছে দৈনিক সাবান (ডেইলি সোপ)। পাণ্ডুলিপিও নাকি লিখতে হয় না। সেটে যে কয়জন শিল্পী উপস্থিত আছেন, তাদেরকে দিয়েই পরিচালক উপস্থিত মতো কাহিনী বানিয়ে নেন, পাত্রপাত্রীরা সংলাপ বলতে থাকেন ইচ্ছামতো। আমাদের সাংবাদিকতাও এখন টুয়েন্টি-টুয়েন্টি।
আমরা কোনো কিছুর গভীরে যাব না।
আমরা টেলিভিশনে বসব লাইভ টক শো নিয়ে, দর্শক প্রশ্ন করবে, আমরা সব প্রশ্নের উত্তর জানি, ইনস্ট্যান্ট দিয়ে দেব। আমাদেরও গভীরে যেতে হবে না, একটা বিষয় নিয়ে মাসের পর মাস ধরে কেঁচো খোঁড়ার সময় নাই।
কোনো কিছু নিয়ে পাঁচ দিনের টেস্ট খেলব না। সময় নাই। চাতক পাতক দল, চল চল চলহে।
আমরা তারকাও বানাব টুয়েন্টি-টুয়েন্টি পদ্ধতিতে। একটা জীবন সাধনা করে নিজেকে পুড়িয়ে পৃথিবীর সবকিছু ত্যাগ করে শুধুই একটা বিষয়ে সিদ্ধি অর্জন! অত সময় কই। বানাও ইনস্ট্যান্ট ফর্মুলা।
ছেড়ে দাও বাজারে কিছু তারকা। নে তোরা এখন করে খা।
ফরিদা পারভীন দুঃখ পাচ্ছেন, সারা জীবন গান গেয়ে কীই বা পেলাম, গান না গাইতেই গাড়ি, লক্ষ লক্ষ টাকা...যার দুঃখ তার কাছে থাকুক। আমরা এগিয়ে যাব টুয়েন্টি-টুয়েন্টি নিয়ে।
উচ্চাঙ্গসংগীত যারা গাইবেন, তাদের মনে এই দৃঢ়তা নিশ্চয়ই থাকবে যে ব্যান্ড তারকার মতো জৌলুস তারা পাবেন না। খাও দাও ফুর্তি করো। দুনিয়া দুই দিনের।
যতক্ষণ ক্রিজে আছ, বীরের মতো থাকো। যদি পেটাতে না পারো, সরে দাঁড়াও।
বীরভোগ্য এই পৃথিবী সেই দর্শনই যেন দেখতে পাই টুয়েন্টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে। কাজেই টুয়েন্টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ উড়ে এলেও যে জুড়েই বসবে, কোনো সন্দেহ নাই।
---------- ---------- ---------- ----------
মূল লেখাটি সম্ভবত কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে থাকবে।
আমি এটা সংগ্রহ করেছি বাংলাদেশ ইনফো ডট কম থেকে। লেখাটা ভালো লাগল তাই সবার সাথে শেয়ার করলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।