অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি
টুয়েন্টি টুয়েন্টি ক্রিকেট! এটা আবার ক্রিকেট নাকি! চার মারো, ছক্কা মারো! বোলারদের হাত থাকবে বাধা। ব্যাটসম্যানরাই রাজা। যত্তসব টাকা কামানোর ধান্দা! খানিকটা সত্যি, তবে পুরোটা নয়। আর এধরণের অর্ধসত্য নিয়ে যারা এমন ভাবনা ধারন করেন তাদের সঙ্গে দ্বিমত নিয়েই মঙ্গলবার দক্ষিণ আফ্রিকায় বসছে টুয়েন্টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর। অন্যভাবে বললে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট কিন্তু গতিময় সংস্করণের প্রথম বিশ্বকাপ।
আর সেই বিশ্বকাপ দিয়ে ক্রিকেট ঢুকছে নতুন এক যুগে
ভূমিকায় বলা সেই অর্ধসত্যে আসা যাক। এটা ঠিক দর্শকদের বিনোদনের কথা মাথায় রেখেই এই ঘরানার প্রসার। পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচে গ্যালারিশুন্যতাতেই অভ্যস্ত ক্রিকেটাররা। ওয়ানডেতে স্টেডিয়ামপূর্ণতার নিশ্চয়তা সবসময় থাকে না। টিভি স¤প্রচারের চেয়ে এক্ষেত্রে বেশি প্রভাব আসলে নিত্যকার যাপনের।
জীবন থেকে পুরো একটা দিন স্রেফ ক্রিকেটকেই দিয়ে দেওয়ায় আপত্তি আছে অনেক ক্রীড়াপ্রেমীর। তাই সব কিছু ঠিক রেখেই শুধু ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমিয়েই টুয়েন্টি টুয়েন্টি।
এবং সেটা শুধু চার-ছক্কার খেলা নয়। ব্যাটসম্যানরা টেস্টে যতটা সময় খরচ করেন অভিযোজনে, ওয়ানডেতে বাধ্য হয়েই তা কমে যায়। টুয়েন্টি টুয়েন্টিতে আরো কমে।
কারণ সময় কম, মারতেই হয়। আর মারকুটে খেললে স্বাভাবিক লক্ষ্যটাই থাকে সর্বোচ্চ অঙ্কের। কিন্তু বিশ্বমানের বোলাররা টেস্ট বা ওয়ানডেতে যে বোলিংটা করেন, টুয়েন্টি টুয়েন্টিতে তার চেয়ে কম জোরে করেন না, কমও ঘোরান না। তাই খেলাটা ব্যাটসম্যানদের কথাটা ভুল। আর স্রেফ মারকুটে বা ছক্কা স্পেশালিস্টরাই এ প্রতিযোগিতায় দারুণ করবেন সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে।
তাহলে অস্ট্রেলিয়া তাদের ওয়ানডে দলটাকেই পাঠিয়ে দিত না।
এখানে একটু বিতর্কের অবকাশ আছে বৈকি। এবারের টুয়েন্টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপে কাউকে ফেবারিট মানা না হলেও টপ ফেবারিট দলটির নাম অস্ট্রেলিয়া। অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট, আর ছোট দৈর্ঘ্যে যে কেউ যে কোনো অঘটন ঘটাতে পারে বলেই কেউ ফেবারিট নয়। কিন্তু সেই অঘটনটাই অনিশ্চিত হয়ে যায় যখন প্রতিপক্ষ ধারাবাহিক সাফল্যে গরীয়ান থাকে।
টানা তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ও চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া তেমনই এক দল। নিজেদের সামর্থ্যে বিশ্বাস আছে বলেই তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে শিরোপা নিয়ে ফেরা দলটিই খেলাচ্ছে। সংযোজন বিয়োজন অবশ্য আছে। দলে নেই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়া গ্লেন ম্যাকগ্রা। তিনি অবসর নিয়েছেন।
ফিরেছেন আগুন ঝরানো বোলার ব্রেট লি। তিনি ইনজুরি কাটিয়ে উঠেছেন।
এই ধারণার একদম বিপরীত মেরুতে আছে নিঃসন্দেহে ভারত। ওয়ানডের রান সংগ্রহের তালিকায় দেশটির সেরা তিন ব্যাটসম্যানকেই দলে রাখেনি তারা। শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙুলী ও অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়- তিন জনই অবশ্য নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন দল থেকে।
কিন্তু তারপরও ভারতের দল দেখলেই বোঝা যায় ব্যাট হাতে ক্রিজে মারমুখীদেরই নির্বাচকরা বাছাইকালে প্রথম পছন্দে রেখেছেন। মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে তরুণ মুখদের জয়জয়কার ভারতীয় শিবিরে। বাংলাদেশই বা কম কিসে! মোহাম্মদ আশরাফুলের দলে এখনও কোনো ওয়ানডে না খেলা মুখ আছে গোটা তিনেক। এদের মধ্যে মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিন তো অনুশীলন ম্যাচগুলোতে তারকা মর্যাদা পেয়ে গেছেন। আবার সহ-অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা দেখিয়ে দিয়েছেন যে ভালো ক্রিকেট খেলে, তার জন্য টেস্ট যা টুয়েন্টি টুয়েন্টিও তাই।
পাকিস্তানও তাই। বাজে একটি বিশ্বকাপ শেষে ইনজামাম-উল হক সব ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরে দাঁড়িয়েছেন। তরুণ শোয়েব মালিকের অধিনায়কত্ব পাওয়াটা সেক্ষেত্রে যতটা চমকপ্রদ, তার চেয়ে বেশি চমকে দিয়েছে টুয়েন্টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপে তাদের দল। টেস্টে রেকর্ড গড়া ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ ইউসুফ এবং ওয়ানডেতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে কার্যকর অলরাউন্ডারদের একজন আবদুল রাজ্জাককে বাদ দিয়েছেন পাকিস্তানী নির্বাচকরা। এনিয়ে জল ঘোলা হয়েছে অনেক।
নির্বাচকরা দাবি করেছেন টুয়েন্টি টুয়েন্টি ক্রিকেটে একটা দলের পরিকল্পনায় যে ধরণের কৌশল থাকে, তা পূরণে অক্ষম দুজন। ইউসুফ বা রাজ্জাক মানেননি সে যুক্তি। বদলি যারা তাদের মধ্যে ইয়াসির আরাফাত ইংলিশ কাউন্টিতে খেলার অভিজ্ঞতায় রীতিমতো টুয়েন্টি টুয়েন্টি স্পেশালিস্ট। মিসবাহ-উল হকও ঘরোয়া টুয়েন্টি টুয়েন্টিতে ভালোই নাম কামিয়েছেন।
আবার মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা দলগুলো যে খুবই সুবিধা পাচ্ছে এমনটাও বলা যাচ্ছে না।
যাদের ঘরোয়া কাঠামোয় টুয়েন্টি টুয়েন্টি আছে এদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে ইংল্যান্ড। ২০০৩ সাল থেকে এ ঘরানায় অভ্যস্ত তারা। কিন্তু জাতীয় দলের সবাই নন। বোর্ডের সঙ্গে চুক্তির কারণে জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা ঘরোয়া টুয়েন্টি টুয়েন্টি ম্যাচ খেলার সুযোগ কদাচিত পান। তাই ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা কেভিন পিটারসেন ও ইংল্যান্ডের মূল ভরসা অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের ঝুলি এ ধরণের হাতেগোনা ম্যাচেই সীমাবদ্ধ থাকে।
ফাঁকটা পূরণ করতেই তারা দলে নিয়েছে ঘরোয়া টুয়েন্টি টুয়েন্টিতে সফল কয়েকজনকে। একই কথা খাটে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রেও। সেজন্যই প্রোটিয়াদের সবচেয়ে সফল ওয়ানডে ব্যাটসম্যান জ্যাক ক্যালিস ঘরের উঠোনে বিশ্বকাপে দর্শক থাকেন। দলে ঢুকে যান অ্যালবি মরকেল ও গুলাম বেদির মতো টুয়েন্টি টুয়েন্টি স্পেশালিস্টরা।
কিন্তু স্বাগতিক হওয়ার সুবিধা যতটুকুই পাক দক্ষিণ আফ্রিকা, ক্রিকেটীয় মানে ও বিচারে অস্ট্রেলিয়ার পরেই তাদের নাম আসছে ফেবারিট তালিকায়।
বরং জোরেসোরে উচ্চারিত হচ্ছে গত বিশ্বকাপের রানার্স আপ শ্রীলঙ্কা এবং সেমিফাইনালিস্ট নিউজিল্যান্ডের নাম। দুটো দলই তাদের ওয়ানডে দলটিই রেখে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মতোই। যদিও গত বিশ্বকাপে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ উইকেট পাওয়া মুত্তিয়া মুরালিধরনের ইনজুরিজনিত অনুপস্থিতিতে একটু ব্যাকফুটেই মাহেলা জয়াবর্ধনের দল। অন্যদিকে একঝাঁক মারকুটে অলরাউন্ডারে ভরপুর নিউজিল্যান্ড বলতে গেলে সবচেয়ে মানানসই টুয়েন্টি টুয়েন্টি ঘরানায়।
আপসেট ঘটাতে পারে ভেবে অনেকে বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া ও স্কটল্যান্ডকে হিসেবে রেখেছে।
কিন্তু সেটা শিরোপা জয়ের জন্য নয়। এবং ২৪ সেপ্টেম্বর যখন টুর্নামেন্টের পর্দা নামবে, তখনই আসলে জানা যাবে টুয়েন্টি টুয়েন্টিটা আসলে কিভাবে খেলতে হবে। তার আগ পর্যন্ত ধন্দে থাকবে প্রতিযোগী সবকটি দল।
এই ধন্দে ছিলেন বিল লরিও। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে অ্যাশেজ সিরিজের মেলবোর্ন টেস্টের চারদিনই নষ্ট হয়ে যাওয়ায়, দর্শকদের দিকে চেয়ে পঞ্চম দিন মুখোমুখি হয়েছিল দু-দল।
অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের সেই ম্যাচটিই আসলে ছিল প্রথম প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে; এমন পরিস্থিতির উপজাত হিসাবেই জন্ম আজকের তুমুল জনপ্রিয় ওয়ানডে ক্রিকেটের। সেই ম্যাচে জয়ী অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক লরি ম্যাচ শেষে বলেছেন, "আমরা জিতেছি জানি, কিন্তু কি করছিলাম সেটা একদমই বুঝিনি। " অনেকটা আচমকাই চাপিয়ে দেওয়া নতুন ঘরানার এই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ব্যাপ্তি পাওয়ার আগে এই ধোঁয়াশাটা মেনে নেওয়াই যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।