"পসার বিকিয়ে চলি জগৎ ফুটপাতে, সন্ধ্যাকালে ফিরে আসি প্রিয়ার মালা হাতে"
প্রিয় বান্ধবী - ৫
ওয়েন্ডি নামটা মোটেও চাইনিজ ধাঁচের না বরং ইংলিশ ধাঁচের। ওয়েন্ডি দেখতে কিন্তু টিপিক্যাল চাইনিজদের মতই। ছোট ছোট চোখ। চাপা নাক। পাতলা ঠোঁট।
শেতাঙ্গদের মতই ফর্সা গায়ের রং। কথা বার্তায় বেশ মার্জিত এবং গোছানো। কোন প্রগলভতা নেই। নেই বাড়তি কোন উচ্ছাস। ইংরেজী ভালই বলতে পারে।
কথা বলতে বা বুঝতে কোন সমস্যা চোখে আমার পড়েনি। পরে জেনেছিলাম স্কুলিংটা বেইজিং এর এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে শেষ করেছে। এআইটি'র বহিরাগত মেয়েদের মধ্যে ওয়েন্ডি ছিল সুন্দরীদের একজন। পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী কিছু সিনিয়র স্টুডেন্টস্ ওর সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু ওয়েন্ডীর পক্ষ থেকে কোন রকম রেসপন্স না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
ওয়েন্ডি ক্লাশে ও ক্লাশের বাইরের বেশীর ভাগ সময় কিছু নির্দ্দিষ্ট বন্ধু-বান্ধবী সাথে নিয়ে চলাফেরা করতো। আমার সাথেই ওর সময়টা বেশী কাটতো। দুজনের পাঠ্য বিষয় এক হওয়ায় লাইব্রেরী ওয়ার্কটা একসাথেই করতাম। দুপুরের লাঞ্চ ও রাতের ডিনারও প্রায় একই সাথে সেরে নিতাম। এআইটিতে আমাদের বন্ধুত্ব কেন জানিনা আলোচনার বিষয় ছিল।
অসম বয়সী ও অসম বর্ণ ও গোত্রের মদ্যে বন্ধুত্বের বিষয়টা সবার কাছেই একটা কৌতুহলের ব্যাপার। আমি এ নিয়ে কখনও তেমন মাথা ঘামাইনি। বরং নিজেকে গর্বিত মনে হতো। এই বন্ধুত্বের প্রতি অনেককে ঈর্ষান্বীত চোখে তাকাতে দেখেছি। এদের মধ্যে ছিল কিছু পাকিস্তানী বদমাইশ আর ছিল কিছু বাংলাদেশী হিপোক্র্যাট।
তাদের আচরণ ও কথাবার্তা ছিল কেমন যেন সন্দেহে ভরা, চোখে মুখে হিংসেমী আর এক ধরনের আক্রোশ। শ্রীলঙ্কান অনেককেই বাঁকা চোখে তাকাতে দেখেছি। তবে সরাসরি কেউ কিছু বলতো না। শ্রীলঙ্কান এক মেয়ে ছিল আমার ক্লাশমেট। তার সাথে সবসময়ই আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
মেয়েটা খুব লাজুক ছিল। চাইনীজ ও ভিয়েতনামিজরা কথা কম বলতো। ভাষা তার প্রধান সমস্যা। ভারতীয় কমিউনিটির সাথে আমার সবচাইতে হৃদতা বেশী ছিল। কিশোর, রাকেশ, রাজেশ, ভীমা (আসল নাম জানিনা, ভীমের চরিত্রে অভিনয়ের কারনে ওকে ভীমা বলে ডাকতাম) সবাই আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল।
ওয়েন্ডির বাহ্যিক আচরণ ও চলাফেরা ছিল ভীষণ রকমের রিজার্ভ। প্রকৃতিগতভাবে তার চারিত্রিক উন্মেষ ঘটেছিল অনেকটা কনজারভেটিভ পরিবারের মেয়েদের মত করেই। তাই অনেকের সাথেই তেমন সহজভাবে মিশতে পারতো না। কথা খুব কম বলতো। বলার ইচ্ছা না হলে বলতোই না।
ভাষাগত দূবত্ব কিছুটা ছিলই। ছেলেদের ব্যাপারে ওর আগ্রহ ছিল খুব কম। অথচ ব্যতিক্রম দেখেছি শুধু আমার বেলায়। তাই ওর ব্যাপারে কোন প্রেডিকশন করা আমার জন্য ভীষণ রকমের আহাম্মকি। ওর হাত দেখে আমি তেমন কিছু বলতে পারিনি।
বলার মত তেমন কিছু খুঁজে পাইনি। এমন একটা নিরামিষ গোছের অথচ ভীষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেয়ে আমার মত আড্ডাবাজ ও হ্য হুল্লোর করা মানুষের সাথে শেষদিন পর্যন্ত কী ভাবে তাল মিলিয়ে চললো আমার ভাবতে অবাক লাগে। আমিই ছিলাম ওর অবসর সময়ের সঙ্গী। ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত বন্ধু। আর আমাদের এই বন্ধুত্ব থেকেই জন্ম নিয়েছিল বন্ধুত্বের প্রতি একে অপরের প্রতি নির্মল, আন্তরিক ও পবিত্র ভালবাসা।
যে ভালবাসার অর্থ প্রেম নয়। যে ভালবাসার অর্থ পরম শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ। জীবনে প্রথম বুঝেছিলাম বন্ধুত্বের ভালবাসায় অন্যরকম এক ভাললাগা থাকে।
আমার আর ওয়েন্ডির বন্ধুত্ব মানুষের প্রতি মানুষের এক ধরণের ভাললাগা। বন্ধুর প্রতি বন্ধুর অকৃত্রিম ভালবাসা।
ওয়েন্ডি জানতো আমি বিবাহিত। আমি আমার কথা ও আচার-আচরণে বুঝিয়ে দিতাম আমি বিবাহিত। তাই আমার বিবাহিত স্ত্রী সম্পর্কে এমন কিছু নেই সে জানতো না। ধর্মীয়ভাবে আমার নিজের কিছু মূল্যবোধতো ছিলই। যা আমি কখনই বিস্মৃত হইনি।
তাই আমার সকল ভাললাগা, ভালবাসা, আবেগ আর অনুভুতিগুলো সুনিপূণভাবে একটা নির্দ্দিষ্ট পন্ডিতেই বাঁধা ছিল। আমাদের বন্ধুত্ব ছিল সামাজিক অনুশাসনে শৃঙ্খলিত এক অনুপম ভালবাসা। আমার নিজের প্রতি বিশ্বাস ছিল আমাদের বন্ধুত্ব কখনই দিকভ্রান্ত হবে না। ওয়েন্ডির মত মেয়ের প্রেমে পড়া আর ওর প্রেম পাওয়া যে কোন পুরুষের ভাগ্যের ব্যাপার সেটা আমি এখনো স্বীকার করি। সে আমার প্রিয় বন্ধু হবার পরেও আমার কাছে "ডিয়ার" বলে ডাকার অনুমতি চেয়েছিল।
আমি তাকে সেই অনুমতি দিয়েছিলাম। কারণ অসামান্য ঐ মেয়েটা আমার মত সামান্য হৃদয়ের এক মানুষের কাছে 'ডিয়ার' বলার অনুমতি চেয়েছে আমি কি তা না দিয়ে থাকতে পারি? ব্যাপারটা হয়তোবা সামাজিক বা সাংসারিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা গোপনীয়। বউ জানলে মন খারাপ করার কথা। অথচ আমি আমার বৌকে সব কথাই খুলে বলেছি। বউয়ের ভালবাসা তাতে এতোটুকু কমেছে বলে কখনো মনে হয়নি।
চলবে-
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।