আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রিয় বান্ধবী - ৩

"পসার বিকিয়ে চলি জগৎ ফুটপাতে, সন্ধ্যাকালে ফিরে আসি প্রিয়ার মালা হাতে"

প্রিয় বান্ধবী - ৩ ক্লাশ, আড্ডা, লেখাপড়া, বেড়ানো, ইচ্ছেমত শপিং ইত্যাদি নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটছিল। রাতে লাইব্রেরী কিংবা হোম ওয়ার্ক সেই সাথে গ্রুপ এ্যাসাইনমেন্টের কাজ। প্রতি সপ্তাহে ফিল্ড ভিজিট, ছাওফ্রায়া নদীর উপর বোটে লাঞ্চ কিংবা ডিনার, ডিনার শেষে আবার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা। আমি সবার সিনিয়র তাই সবকিছুতেই আমার অগ্রনী ভূমিকা। ক্যাফেটেরিয়া, লাইব্রেরী, টিভিরুম, স্যুইমিংপুল, টেনিসকোর্ট, জিমনেসিয়াম এবং তার পাশ ঘেঁষে খোলা মাঠের বেঞ্চে বসে আমাদের আড্ডাটা বেশ জমে উঠতো।

বিকেল ও সন্ধ্যার প্রতি আড্ডাতেই দুই মনিকা (নেপাল ও ভারত) উপস্থিত থাকতো। ওরা দুজন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। দুজনেই থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। মানিকজোড় বলা যায়। দুই মনিকার (নেপাল ও ভারত) সাথে আমার বন্ধুত্বের সূত্রপাতের পেছনে একটা কারন ছিল।

কারনটা নিতান্তই সামান্য। এআইটি'র ক্যাফেটেরিয়ায় ওরা দুজন নিয়মিত খেতে আসতো। ইন্ডিয়ান, মুসলিম, থাই, চাইনীজ সব ধরনের খাবার এখানে পাওয়া যেত। ওদের ভার্সিটির ক্যাম্পাসে থাইফুড ও ফাস্টফুড ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যেত না। আর দামের দিক থেকেও সেই খাবার ছিল বেশ ব্যয়বহুল।

তাই থামাসাত থেকে দুজনে দুটো সাইকেল চালিয়ে এআইটি ক্যাম্পাসে আসতো। দুপুর ও রাতের খাবারের জন্য তাদের আলটিমেট চয়েস ছিল এআইটি'র ক্যাফেটেরিয়া। আড্ডা শেষে ক্যাম্পাসে ফিরে যেত। বিশাল আকারের এই ক্যাফেটেরিয়া বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও খোলা মেলা। ক্যাফের উত্তর পার্শ্বে টেনিসকোর্ট আর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মেডিকেল সেন্টার।

টেনিসকোর্টের পাশের রাস্তাটা কাঁচা, তার উপর আঁকাবাঁকা। ঐ রাস্তা দিয়ে আসার পথে মনিকা (নেপাল) হঠাত্ ব্যালান্স সামলাতে না পেরে সাইকেলসহ পড়ে যায়। আর পড়বি তো পড় আমার সামনেই (বাংলা সিনেমার মতই চমকপ্রদ ঘটনা)। আরেক মনিকা (ভারত) পৌঁছানোর আগেই আমি এগিয়ে ওকে রাস্তা থেকে উঠতে সাহায্য করি। পায়ের গোড়ালীতে ভালই ব্যথা পায়।

মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে ফার্স্ট এইডের ব্যবস্থা করা হয়। পায়ের গোড়ালীতে ব্যান্ডেজ দেয়া হয়। কয়েকদিন এক পায়ে ভর করে সাইকেল চালানো আর একটু খুঁড়িয়ে হাঁটা ছাড়া তেমন কোন সমস্যা হয়নি। দুই মনিকার সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত সেখান থেকেই। এভাবেই ওরা দুজন নিয়মিত আমাদের আড্ডার সঙ্গী হয়ে যায়।

শেষদিকে ভারতীয় মনিকার এক বয়ফ্রেন্ড জুটে যাওয়ায় নেপালী মনিকার সাথেই আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আরও ঘনিষ্ঠ হয়। সাইকেল থেকে পড়ার মাধ্যমে যার সাথে পরিচয় সে আমাকে সাইকেল থেকে না ফেলেই ব্যথিত করেছিল। পরবর্তীতে ওর লেখা কিছু চিঠি আমাকে সেই উপলব্ধিই এনে দেয়। ব্যাংকক থেকে ফিরে আসার পর ৪/৫ বছর কেটে যায়। হঠাত একদিন আমার অফিস নাম্বারে মনিকার টেলিফোন।

বৈরী আবহাওয়ার কারনে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস্ এর কোলকাতা-কাঠমন্ডু ফ্লাইটের জিয়াতে এমারজেন্সী অবতরন। ট্রানজিট রুটের সেই স্বল্পবিরতিতে মনিকা আমার অফিস নম্বরে কল করে। আমি ফোন পেয়ে প্রথমে চমকে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো নেপাল থেকে কল করেছে। কিন্তু পরে আমার ভুল ভাঙ্গলো।

- "হ্যালো, য়্যা য়্যাম মনিকা হেয়ার। মনিকা ফ্রম নেপাল। মে আই টক টু মি: .... প্লিজ! হে! আর য়্যু মি: ...? হাউ আর য়্যু? ডু য়্যু রিমেমবার মী? ইটস্ মী, ইওর ফ্রেন্ড ফ্রম এআইটি, ব্যাংকক"। - "ইয়াহ্। দিস ইজ মী।

আই ডু রিমেমবার য়্যু। হোয়ার আর য়্যু ফ্রম? য়্যা অ্যাম দ্যা ফুল হু উইল নেভার ফরগেট ইয়্যু- এ্যান্ড ইটস্ ইম্পসিবল, বিলিভ মী"। - "য়্যা য়্যাম নাউ ইন ঢাকা এয়ারপোর্ট। টকিং ফ্রম লাউঞ্জ। নো টাইম টু সি ইউ।

য়্যা য়্যাম ইন হারি। হ্যভ টু রিচ মাই ফ্লাইট। ইটস্ ইন ট্র্যানজিট নাউ। সো য়্যা য়্যাম ভেরী আনফরচুনেট। উইশ ফর মী।

বাই ডিয়ার। টেক কেয়ার"। কথা আর বেশীদূর এগোয়নি। কিছু জিনিষ অল্পতেই শেষ করা ভাল। মনিকা ছিল উচ্ছল প্রকৃতির অথচ অনেক কিছু সহজেই গোপন করতে পারতো।

তাই ধারনা করতাম মেয়েটা চাপা স্বভাবের। ৫ বছরের ব্যবধানে অনেক কয়টা চিঠি লিখেছিল। সব চিঠিতেই ছিল শ্রদ্ধা মেশানো ভালবাসা আর বন্ধুত্বের ছোঁয়া। শুভেচ্ছা কার্ড পাঠাতো নিজের হাতে আঁকা ফুল আর টক টকে লাল হৃদয়ের ছবি দিয়ে। এক একটা চিঠি ছিল স্বল্প কাব্যের কথামালা।

এখন ভাবলে হাসি পায়। কী রকম ছেলেমানুষ! আমিও লিখতাম। প্রতিটি চিঠির জবাবে একটা করে চিঠি। হিসেব বরাবর রেখেছি। পরে আর হিসেব ঠিক রাখতে পারিনি।

জবাব কমিয়ে দেয়াতে মনিকা আর লিখতো না। শেষ দিকে একটা চিঠিতে অনেক কিছুই লিখেছিল। চিঠিটা পড়ার পর কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। নিজেকে মিলিয়ে দেখছিলাম। মনিকা লিখেছিল- -"তোমাকে আমি হিংসে করি।

খুউব হিংসে করি। সব মিলিয়ে বন্ধু হিসেবে তোমাকে কেন যে এতো ভাললাগতো বলতে পারবো না। তোমার মত কোন মানুষকে ভালবেসে আটকানো ঠিক না। দূর থেকে ভাললাগাটাই অনেক ভাল। জীবনে তোমার মতো মানুষের দেখা যদি কখনো পেয়ে যাই তবে তাকে বন্ধু হিসেবেই চাইবো, ভালবাসার মানুষ হিসেবে নয়।

কারন এমন মানুষকে একটা খাঁচায় আটকে রাখা ভুল। তুমি সবার হয়েও অন্য কারও। এটা অনেক মেয়েই মেনে নিতে পারবে না। তুমি অন্য কারও জেনেও তোমাকে বন্ধু হিসেবে পাওয়া অনেক বড় কিছু। তুমি মানুষ হিসেবে ভীষণ ভাল একজন মানুষ, বন্ধু হিসেবেও কম নও।

তোমাকে খুব মিস করি। আমার ভাবনা আর আকাঙ্ক্ষার অনেকটা সময় তোমার জন্য খরচ করেছিলাম। সেগুলো কখনই ফেরত চাইবো না। কারন ওইটুকু সময়ের খরচ একটা মানুষকে চিনতে সাহায্য করেছে। ওয়েন্ডীর সাথে তোমার বন্ধুত্ব অটুট থাকুক এই কামনা করি।

আমি তোমার বন্ধু হলেও তোমাকে অনেক কথা বলতে পারিনি। মেয়েরা সব কথা খুলে বলতে পারে না। ভাল থেকো। তোমার বউ ছেলেদের আমার আদর দিও"। -মনিকা।

চলবে-

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.