কত অজানারে!
ঘুম না, রীতিমত মরার ভান করে পড়ে আছে আসলাম। এই বিষয়ে তার যশ পুরা মহকুমায়। সে মরার ভান করলে কারো বুঝার সাধ্য নেই যে আসলেই মরেছে কিনা। নীতুন কবিরাজ তো একবার নাড়ী টিপেও বুঝতে পারে নাই। তবে এই মুহুর্তে অবস্থা একটু ভিন্ন।
এই জলার ধারের বুনো মশা গুলো বেশি ডিস্টার্ব করছে। এরা স্টেজের সৌখিন মশার মত না। একে বারে চামড়া ভেদ করে হাড়ের মধ্যে হুল ফুটায়ে দিচ্ছে!!
সিচুয়েশনটা এমন যে আসলামের প্রবল ভয় আর আতঙ্কে থাকার কথা!! কিন্তু তার যে অনুভুতিটা হচ্ছে তা হল কিছুটা বিরক্তি (মশাদের কল্যানে), আর একটা পুরাতন ভাল লাগা আর খারাপ লাগার মিশ্র অনুভুতি। আসলাম যদি আরেকটু শিক্ষিত হত তাহলে জানতো এই অনুভুতির নাম নস্টালজিয়া!! তাও এই মরার ভান করার কারনেই। যদিও নস্টালজিয়ায় ভোগার মত অবস্থা এখন না!
প্রতি বছর কোরবানীর ঈদের পর স্কুল মাঠে যাত্রা পালার আয়োজন হয়।
তাদের গ্রামের লোকজনই চাদা টাদা তুলে আয়জন করে। যাত্রা দল আসে ওপার বাংলা থেকে। নুরজাহান অপেরা। তেমন বড় সড় দল না। এর চেয়ে ভাল দল দেশেই আছে।
কিন্তু ওপার বাংলার দল বলে কথা!! পুরা মহকুমার লোকের ঢল নামে যাত্রা দেখতে। যে দলই আসুক না কেন। প্রতি বছর পালা হবে একটাই; “কুসুম বানুর পালা”!! এই পালার প্রত্যেকটা ডায়লগ সবার মুখস্ত। তার পরও এই পালাই করতে হবে। কারন এই গ্রামে শো করার শর্ত একটাই।
পালার নায়ক ‘হাশিম সওদাগরের’ পাঠ দিতে হবে গ্রামের কাওকে। সে যেমনই অভিনয় করুক না কেন!! এতে অবশ্য পালার জনপ্রিয়তা কমেনা। আরো বেড়ে যায় দুই তিন গুন।
গ্রামের আর সব যুবকের মত আসলামের ও নায়কের পাঠ করার খুব শখ! তাই যাত্রা আয়জনের সময় তার তোর জোড় থাকে সব চেয়ে বেশি। কোথায় পান্ডেল বসবে।
যাত্রা কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তোফা শিকদারের চা লাগবে কিনা, বাতাস করতে হবে কিনা, এই সব হল তার উদ্ববেগের বিষয়। সে অভিনয় ও করে জব্বর! সুযোগ পেলেই হাশিম সওদাগরের সাপে কাটার দৃশ্যটা অভিনয় করে দেখায়। মোস্তোফা শিকদার এরকম বিনি পয়সার আসিস্টান্ট পেয়ে প্রতিবারই তাকে ভরসা দেয় যে সেবারের নায়ক সেই হবে।
কিন্তু তার ভাগ্যের শিকে কোন বারই ছিড়েনা। শেষ মেস নায়কের পাঠ জুটে সেই শাহ আলমের!! ‘বেটা আস্ত কাপুরুষ চেহারাডা একটু চকচকে আর বাপের ক্ষমতা আছে বলে।
তানা হলে ও অভিনয়ের জানেডা কি?!’! রাগ হয় আসলামের।
মোস্তফা শিকদার আসলামকেও নিরাশ করে না। সান্তনা স্বরুপ তার পাঠ জুটে মৃত সৈনিকের!! স্টেজের উপর মড়ার মত পড়ে থাকতে হবে!! মানে একে বারে লাস্ট দৃশ্যে। হাশিম সওদাগর যখন সব সৈনিকদের মেরে আহত অবস্থায় কুসুম বানুর কোলে মাথা রেখে পালার শেষ ডায়লগ গুলো দেবে। তখন আসলাম পড়ে থাকবে মৃত সৈনিকের বেশে!! এই হল তার পাঠ।
তবে এই সুযোগ টুকুও আসলাম কাজে লাগায় পুরপুরি। সে যে কত বড় অভিনেতা তা দেখাতে হবে না!!
প্রথম বার সে এমন আর্তচিৎকার করে মারা গেল। যে সব দর্শকের মত স্টেজের সবাই ও ভড়কে গেল রীতিমত। এর পর পালা শেষ। তবু আসলাম তো ওঠেনা!! আসলামের মা ততক্ষনে মড়া কান্না জুড়ে দিয়েছে! তাও আসলাম উঠেনা।
পরে যখন নীতুন কবিরাজ এসে নাড়ী টিপে টুপে তাকে মৃত ঘোষনা করলো, তখনই সে উঠে বসে একটা বিজয়ের হাসি দিল সবার দিকে চেয়ে!!! যাত্রার কাহিনীতো সবাই জানেই। তাই এর পর থেকে যাত্রার মূল আকর্ষন হয়ে গেল আসলামের মরার দৃশ্য! এই অছিলায় মোস্তফা শিকদার ও আর নায়কের পাঠ দেয় না আসলাম কে। ‘ইস্ এক বার যদি সে চান্স পাইতো। পুরা দুই বাংলা কাপায়া দিত!!’ নায়ক হওয়া আর হয়না আসলামের!
এই সব কথা মনে পড়ছে এখন! অন্ধকার আরো একটু গাড় হয়ে গেছে বোধ হয়। জলা কাদার মধ্যে মিলিটারী বুট গুলো খট্ খট্ এর বদলে কেমন যেন পচ্ পচ্ শব্দ করছিলো এতক্ষন।
সেই শব্দ আরেকটু দূরে চলে গেছে। আসলাম চোখ বড় বড় করে মড়ার দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। মাথা ঘুরায়ে দেখার সাহস পাচ্ছে না।
স্কুল মাঠে মিলিটারী ক্যাম্প বসেছে। ঘর দোর জ্বালানো শুরুকরেছে শুওয়াররা।
প্লান ছিলে আজ রাতেই নৌকায় করে ঐ পার চলে যাবে আসলাম এবং আরো অনেকেই। তার পর ট্রেনিং নিয়ে এসে বিদায় করবে এই পাঞ্জাবী কুত্তা গুলারে। শাহ আলম ও জানতো এই কথা। শালা কাপুরুষ হারামীর পোলা! তার বাপই হচ্ছে মিলিটারী দের প্রধান হোস্ট। এই গত রাতেও একটা গরু মেরেছে স্কুল মাঠে।
আপ্যায়ন আর কি! নদীর ঘাটে আগে থেকেই মিলিটারী নিয়ে ঘাপটিমেরে ছিল। তারা যেই গেছে, চার দিক থেকে এসে তাদের ধরে নিয়ে এসেছে এই জলার ধারে। তার পর ব্রাশ ফায়ার। অন্য সবাই গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে দেখে আসলাম ও পড়ে গেছে। মরার ভান করে।
ব্যাস!
মিলিটারী রা চলে গেছে। গায়ের উপর কার যেন হাত এসে পড়েছে! আসলাম দেখে মোস্তোফা শিকদার। মারাত্বক যখম সে! আসলামের হাতটা শুধু শক্ত করে ধরে ঝাকি দিল একবার। তারপর তীব্র চোখে তাকিয়ে কি যেন বলতে চাইলো! এর পরই সব স্থির। আসলাম বুঝলো আর মৃত সৈনিক নয়, নায়কের পাঠ করার সময় এসে গেছে তার।
একটা জন্তু যেন ভর করলো আসলামের উপর। মুহুর্ত গুলো কেটে যেতে লাগলো ঝড়ের বেগে। শাহ আলমের নিথর শরীর থেকে শাবল টা টেনে বের করতে গিয়ে আসলাম দেখে দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আছে শাহ আলমের মা! নিস্তব্ধ হয়ে। একবার ক্ষমা চাইতে গিয়েও কি ভেবে যেন, কিছু বলল না আর আসলাম। এখনো তার অনেক কাজ বাকি।
রক্তাক্ত শাবলটা হাতে নিয়েই এগিয়ে যেতে লাগলো স্কুল মাঠের দিকে।
আবারো স্কুল মাঠে মরার মত পড়ে আছে আসলাম। একটা টহল মিলিটারীর বুক এফোড় ওফোড় করতে পেরেছে সে। সে জন্যেই যেন তার মুখে লেগে আছে একটা বিজয়ীর হাসি!! নিজের বুকটাও কেমন যেন লাল রঙে ভেসে যাচ্ছে তার। এসব কারনেই বুঝি এবার আর মরার অভিনয় টা ঠিক মত হচ্ছেনা! কেমন যেন জীবন্ত লাগছে তাকে!! আসলে এখনতো আর সে অভিনয়ই করছেনা...
বিদায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।