হাসান ভাই ২
মৃদু হাসি ছাড়া আর কোন ঊত্তর পাওয়া গেলনা। এক্ষেত্রে হাসান ভাইই ভরসা। জার্মান আর ইংরেজি দুইই তার দখলে। তিনি উঠে গেলেন মেয়েটির সাথে। হাসান ভাই ফিরে আসার পর জানা গেল মেয়েটির নাম কিম চাও।
ভিয়েতনাম থেকে এসেছে ভাগ্য ফেরাতে। ইরাকির সাথে পরিচয় হয়েছে ট্রেনে। এর মধ্যে লাল গোলাপ পর্যন্ত পৌছে গেছে ভাষা না জেনেই।
গল্পে গল্পে রাত তখন একটা ছাড়িয়েছে, আমার সঙ্গী সাথিদের কেউ কেউ দুই এক পাক নেচেও এসেছেন। মাঝে মাঝে সোফিয়া অথবা হাসান ভাই আমাকে সঙ্গ দিচ্ছেন।
সোফিয়া থাকায় হাসান ভাই এর ব্যবসা জমে উঠেছে। তিনশো গোলাপের প্রায় সবই শেষ। পড়ে থাকা কয়েকটি সাদা গোলাপের একটি নিলাম আমি সোফিয়ার জন্যে। খিলখিলয়ে হাসতে হাসতে সে বলল “হাসান উইল বি এংরি”। আমি বললাম “না হি মে বিকাম জেলাস”।
ড্যান্স ফ্লোরে তখন বাজনা দ্রুত থেকে দ্রুত তর হচ্ছে। হাসান ভাই আমার পাশে বসলেন একটি লোরেন বাউ নিয়ে। চোখে মুখে ক্লান্তি, অবসন্নতা। বললাম কেমন আছেন হাসান ভাই? বুদ্ধিমান লোক তিনি বললেন টিকে আছি, শুধু মাথা খাটিয়ে টিকে আছি। কী কষ্ট যে করতে হয়েছে, বলে বোঝানো যাবে না।
ততক্ষণে নাচের ফ্লোর থেকে ফিরে এসেছে অন্যরাও। হোটেলে ফেরার জন্যে রেডি হতে দেখে হাসান ভাই বললেন, ট্রেন তো সব বন্ধ হয়ে গেছে, ভোর চারটার আগে ফেরার ট্রেন নেই। তারচেয়ে বসেন গল্প করি।
হাসান ভাই এর গল্প দিয়েই শুরু হল আসর। মাগুরায় জন্ম আমদের মেজবানের।
সর্বহারাদের দলে ঢুকেছিলেন সাম্যের রাজনীতিতে অনুপ্রাণীত হয়ে। এর পরের জীবনের কালো অধ্যায় আর মনে করতে চান না। এই ক্লেদাক্ত জীবনকে পিছনে ফেলার চেষ্টাতেই টাকা পয়সা ধার করে এরশাদের আমলে দেশ ছেড়েছেন। প্রথমে ইরাক, তুরস্ক হয়ে গ্রিস, তার পরে ইটালি হয়ে সুইজার ল্যান্ড, আর সব শেষে পায়ে হেটে জার্মানি। অবিশ্বাস্য লাগছিল তার গল্প।
লোরেন বাঊ চুমুক দিতে দিতে বললেন ভোদকা খেয়েছেন? আমার নেতিবাচক উত্তর শুনে বললেন নির্জলা ভোদকা ঘাষের উপর ঢেলে দিলে ঘাষ হলুদ হয়ে যায়। সেই বিষ খাবার প্রতিযোগিতায়ও আমাকে নামতে হয়েছে শুধু টিকে থকার জন্যে। এনায়েতের চোখ কপালে ঊঠতে দেখে বললেন "সুইজারল্যান্ডে পৌছানোর কিছুদিন পর টাকা ফুরিয়ে গেল। চাকরি নেই, ওয়ারক পারমিট নেই এমন কি পাস পোর্ট পর্যন্ত নেই। সেই সময় দেশি সুইজারল্যান্ডের এক গ্রামে ভোদকা খাওয়ার প্রতিযোগিতা হচ্ছে।
পুরো আয়োজন খোলামাঠে, শীতের সময়তো দেখেছেন এখানে কেমন বাতাস থাকে, সেই হাড় কাঁপানো শীতে শুধু ভোদকার কারণে মানুষ টিকে যাচ্ছে"। তর সইছিল না এনায়েতের বলল "আসল কথা বলেন"। হাসান ভাই গায়ে মাখলেন না। মনে হচ্ছে তিনি আমাদের মাঝে নেই। লোরেন বাউএর গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছেন যেন অভ্যাসের বসে।
দৃষ্টি আমাদের ছাড়িয়ে অন্য কোন খানে। পোডিয়ামের মিউজিক তাঁকে স্পর্শ করছে কি করছে না, বোঝা যাচ্ছে না। “ আমার পকেটে তখন কয়েকটা মাত্র ক্রোনার। আমি নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব, কখন যেন হাজির হয়ে গেলাম আসরে। প্রতিযোগিতা জমে উঠেছে সব চেয়ে বেশি যে খেতে পারবে তার জন্যে পুরষ্কার ৫৫০ ক্রোনার।
আমি বসে গেলাম। নির্জলা ভোদকা। প্রতি চুমুকে পুড়ে যাচ্ছে পাকস্থলী। কিন্তু আমার ফেরার উপায় নেই। ৫০০ ক্রোনার তখন আমার কাছে অনেক।
অন্যরা খাচ্ছে মজা করে আমি পুড়ছি বাধ্য হয়ে। একে একে বিদায় হচ্ছে এক এক জন। আমি বসে বসে গলায় ঢালছি তরল আগুন”।
- তারপর? রুমনের প্রশ্ন, হাসান ভাই এর গলা যেন অনেক দূর থেকে ভেসে এল, “পরদিন নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাস্পাতালের বিছানায়” মৃদু হাসলেন তিনি, “বালিশের নীচে ৫৫০ ক্রোনার”।
-জারমানিতে এলেন কবে?
-সে আর এক গল্প।
লুকিয়ে চুরিয়ে আর কত পারা যায়। বলেন? একটা হোটেলে কাজ পেলাম বাসন ধোয়ার। ইটালিয়ান মালিক, জানতো আমার কাগজ পত্র নেই, তাও কাজ দিল, ওদেরও লাভ আছে, ইল্লিগালদের কম পয়সায় খাটান যায়। মাস কয়েক কাজ করেছিলাম, তারপর ছাঁটাই। ট্রেনে মিউনিখের বর্ডার পর্যন্ত এসে পায়ে হেটে বর্ডার পেরিয়ে চলে এলাম।
-এত সোজা?
হাসলেন হাসান ভাই। মোটেও সোজা নয়। এখানে এসে পুলিশ ধরলো, পাসপোর্ট চাইল, কিছুই দেখাতে পারলাম না। কোর্টে চালান করে দিল। সেখান থেকে ঊদ্ধার করল YMCA (Young Men’s Christian Association. অবাক হলাম আমি YMCA কেন?
- YMCA অসহায়দের আইনী সহায়তা দেয়, বিনিময়ে বাইবেল পড়া শিখতে হয়, ওরা জার্মান ভাষাও শেখায়।
আমাকে কোর্টে নেবার পর আমি রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলাম। বললাম বাংলাদেশে আমার জীবনের নিরাপত্তা নেই। আমি আন্ডার গ্রাউইন্ড পলিটিক্স করতাম আম্র নামে মিথ্যা খুনের মামলা আছে। বিচারক সব শুনে হেসে ঊড়িয়ে দিতে চাইলেন। বললেন তোমার নামে এরকম মামলা থাকলে তোমাকে ঢাকার এয়ারপোর্টেই এরেস্ট করার কথা।
এই গল্পে ভুলছি না। তোমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। জাজের কথায় পড়ে গেলাম মহা ফাঁপরে। দেশে ফেরা যাবে না। আগে খুনের মামলা না থাকলেও এবার হবে।
যাদের টাকা ধার করে এসেছি, টাকা শোধ না দিতে পারলে তারাই জেলে দেবে। ভাবলাম শেষ চেষ্টা করে দেখবো নাকি একবার? বললাম মহা মান্য বিচারক জার্মান পুলিশের সুনাম সারা বিশ্বে, বিচারক আন মুভড, বললেন তোমাকে ধন্যবাদ জার্মান পুলিশের সুনাম করার জন্যে কিন্তু তোমাকে ফিরে যেতে হবে। বললাম এই জার্মান পুলিশের কড়াকড়ির মধ্যেও আমি যে ভাবে মিউনিখে পৌচেছি, ঠিক একই ভাবে আমি ঢাকা এয়ার পোরট্, পেরিয়েছি। আমার জীবন সত্যিই হুমকির মুখে। আমাকে জেলে পাঠান কিন্তু বাংলাদেশে পাঠাবেন না।
নড়ে চড়ে বসলেন জাজ। অনেকক্ষণ তাঁকিয়ে থাকলেন তারপর বললেন, "তিন মাসের মধ্য তোমার বক্তব্যের সমর্থনে প্রমান চাই"।
আমার ঠাই হল YMCA হোস্টেলে। ঠাঁই তো মিললো কিন্ত ঘুম হারাম হয়ে গেল। প্রমান পাব কই? হোস্টেলের একজন বুদ্ধি দিল, জার্মানিতে বিয়ে করে ফেল, থাকতে পারবা।
শুরু করলাম বউ খোঁজা। এখানে থাকতে টুক টাক কাজের চেষ্টা করেছি। মারসিদিঞ্জ বেঞ্জ কোম্পানীতে শ্রমিকের চাকরী পেলাম। তাও অস্থায়ী। কাজ করতাম বয়লারের মত একটা জায়গায়।
লোহা পুড়িয়ে, পিটিয়ে বিভিন্ন শেপ দেওয়া হয় সেখানে। দোজখের আগুণের তাপ কেমন হবে জানিনা। তবে জীবন থাকতে আর মারসিডিঞ্জ বেঞ্জের ওই জায়গায় যেন চাকরী করতে না হয়। গরমে মাথা ধরে যেত। ঘামের চোটে পানি শুণ্য হয়ে যেত শরীর।
সন্ধ্যায় গিয়ে বসতাম কোন পাবে। বউ যদি পাওয়া যায়! একদিন দেখি এক টেবিলে একা বসে মদ খাচ্ছে একটি মেয়ে, বয়স তিরিশের আগে পরে। চেহারা তেমন ভালো ন্য। দেখবেন জার্মান মেয়েরা একটু রুক্ষ ধরণের হয়। এই মেয়েটাও অনেকটা সেরকমই।
তবে আমার কাছে সেটি সেই মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। মেয়েটি প্রায় ঘন্টা দুই বসেছিল একা। মদ খাচ্ছিল কাঁদতে কাঁদতে। আমি সাহস করে পাশে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ সঙ্গ দিলাম তাঁকে।
এক কথায় দু’কথায় জিজ্ঞাসা করলাম তার কান্নার কারণ। প্রথমে তো বলেই না। শেষে বলল তাঁর বয় ফ্রেন্ড তাঁর সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। পরদিন আবার দেখা মেয়েতির সাথে। একই জায়গায়।
একই অবস্থায়। আমার কাছে মনে হল এইটিই মোক্ষম সময়। বললাম তোরও যেমন কষ্ট আমিও তেমনই একা। চল আমরা বন্ধু হই। সে খুব একটা আমলে নিল না আমার কথা।
এক সময় বলল, বাঙ্গালিরা বন্ধুত্ব করে এদেশে টিকে থাকার জন্যে। তোর মতলব আমি বুঝে গেছি।
তৃতীয় দিন মনে হয় মায়া হল তার। আমাকে বাসায় নিয়ে গেল সে।
আড়াই মাস খুব সেবা যত্ন করলাম তার।
মেয়েটির বয় ফ্রেন্ডের শোক তখনও কাটছে না। রোজ সেই বারে যেয়ে আকন্ঠ মদ গিলে বাসায় ফিরে বমি টমি করে একাকার। আমি সেই বমি ধুই। ঘরদোর পরিষ্কার করি। আড়াই মাস পরে একদিন তার মন ভাল হল।
আমাকে বলল না মানুষ্ টা তুই খারাপ নোস। চল আমরা বিয়ে করে ফেলি। দেশে বউ টউ নেই তো! আমাকে ছেড়ে পালাবি না তো? আমি সব কিছুতে শুধু তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি সে ছাড়া আমার কেঊ নেই, কিছু নেই। শেষ পর্যন্ত আমাদের বিয়ের দিন ঠিক হয়। বিচারকের বেঁধে দেওয়া তিন মাস শেষ হবার আগের রবি বারে।
শুক্রবারে সে হঠাত বলে বসলো, তোকে বিয়ে করা ঠিক হবে না। আমি আমেরিকায় চলে যাচ্ছি। (অসমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।