হেথায় কিছু লিখব বলে চায় যে আমার মন, নাই বা লেখার থাকল প্রয়োজন!
হিমু হুমায়ূন আহমেদের এক অসাধারণ সৃষ্টি। হিমুর সৃষ্টি এবং পথচলা সম্পর্কে হুমায়ূন আহমেদ নিজেই লিগেছেন ময়ূরাক্ষীর তীরে প্রথম হিমু। লেখাটি সম্ভবত কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আমি এটা সংগ্রহ করেছি বাংলাদেশ ইনফো ডট কম থেকে। আমার কাছে অবশ্য হিমুর বইগুলো তেমন ভালো লাগে না। হিমুর চেয়ে আমার রবং মিসির আলীকেই বেশি পছন্দ। আমার কাছে ভালো না লাগলেও ব্লগে হয়তো এমন অনেক পাঠকই আছেন, যাদের প্রিয় চরিত্র হিমু। তাদের জন্যই এই লেখাটি দেওয়া হল।
পূর্ববর্তী পর্ব থেকে চলমান ...
গুলশান এলাকায় মুক্তি নামের একটা ক্লিনিক আছে| মানসিক রোগী‚ ড্রাগ অ্যাডিক্ট ধরনের সমস্যার চিকিৎসা করা হয়| মুক্তি ক্লিনিকের একজন চিকিৎসক (ঢাকা মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিভাগের প্রফেসর) একদিন আমাকে ক্লিনিকে ডেকে পাঠালেন| তার কিছু বিশেষ ধরনের রোগীর চিকিৎসায় আমার সাহায্য প্রয়োজন|
আমি অবাক হয়েই গেলাম| ভদ্রলোক অভিযোগের মতো করে বললেন‚ আপনি এসব কী করছেন? লেখার মাধ্যমে সমাজে অসুস্থতা ছড়াচ্ছেন? হিমু আবার কী? আমি বিনীত ভঙ্গিতে হিমু কী ব্যাখ্যা করলাম| প্রফেসর সাহেব ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হলেন না| গলা কঠিন করে বললেন‚ হিমু উপন্যাসের কোনো চরিত্র না| হিমু হলো একটা ব্যাধির নাম| তা কি আপনি জানেন?
আমি জানি না|
হিমু ছোঁয়াচে ধরনের ব্যাধি| কনটেজিয়াস ডিজিজ| এই ডিজিজ আপনি ছড়াচ্ছেন| আপনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন| অবশ্যই আপনার লেখালেখি বন্ধ করে দেওয়া দরকার| লেখকরা সমাজের উপকার করেন| আপনি করছেন অপকার| ইজ ইট ক্লিয়ার?
এখনো "ক্লিয়ার" না| আপনি ব্যাখ্যা করলে বুঝব|
ডাক্তার সাহেবের কাছে জানলাম‚ মুক্তি ক্লিনিকে অনেক বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের চিকিৎসার জন্য পাঠান যারা "হিমু" নামক অদ্ভুত অসুখে ভুগছে| এরা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে| গভীর রাতে কাউকে কিছু না বলে হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়| কয়েকদিন কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না| তারা মনে করে‚ ঐশ্বরিক কিছু ক্ষমতা তাদের হয়েছে| তারা যা বলবে তাই হবে|
আমি বললাম‚ এই মুহূর্তে আপনার ক্লিনিকে কি কোনো হিমু আছে যার চিকিৎসা চলছে? ডাক্তার সাহেব দু:খিত গলায় বললেন‚ তিনজন ছেলে হিমু আছে| একটা আছে মেয়ে হিমু| মেয়ে হিমুর কী আলাদা নাম আছে?
আমি বললাম‚ মেয়ে হিমুর আলাদা কোনো নাম নেই| মেয়ে হিমুও হিমু| যদিও কেউ কেউ বলেন হিমি| আমার হিমি পছন্দ না|
ডাক্তার সাহেব বললেন‚ যে তিন ছেলে হিমু আছে তার দুটা হিমু হওয়ার পরে ড্রাগ ধরেছে| ভয়ঙ্কর একডিলিউশনে ভুগছে| আসুন আপনার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেই| কী প্রচণ্ড ডিলিউশনে যে এরা ভুগছে দেখে আপনারই খারাপ লাগবে|
আমি ওদের দেখতে গেলাম| সত্যি মনটা খারাপ হলো| জীবনের আনন্দে এদের ঝলমল করা উচিত ছিল| তা না‚ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ক্লিনিকে| চোখের দৃষ্টিতে ঘোর| জীবন থেকে বিতাড়িত কিছু যুবক| আমি তাদেরকে ব্যাখ্যা করলাম যে‚ হিমু ফিকশন ছাড়া কিছু না| হিমুর চিন্তাভাবনা বা হিমুকে নিয়ে লেখকের চিন্তাভাবনা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার কিছু নেই| যেহেতু হিমুকে নিয়ে বইগুলো আমি লিখেছি, আমি জানি|
যুবকদের ভেতর একজন চাপা গলায় বলল‚ হিমুর বিষয়ে আমরা যা জানি আপনি তা জানেন না| আমি চমৎকৃত হয়ে বললাম‚ তোমরা কী জানো?
যুবক গলা আরও নামিয়ে ফিসফিস করে বলল‚ প্রতিটা বড় শহরে একজন প্রধান হিমু থাকেন| তিনি শহর কন্ট্রোল করেন| অনেক রাতে হাঁটাহাঁটি করলে উনার দেখা পাওয়া যায়|
উনি কী পীরটাইপ কেউ?
উনি পীরের বাবা!
যারা পীরের বাবার দেখা পেয়ে গেছে‚ তাদের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন| আমি চুপ করে গেলাম| একটা বিষয় আমাকে অবাক করল‚ হিমুর লেখককে নিয়ে তাদের নিস্পৃহতা| হিমুর যে জগৎ তারা তৈরি করেছে সেখানে আমার স্থান নেই|
চিকিৎসাধীন মহিলা হিমুকে দেখতে গেলাম|
কলেজ পড়া বাচ্চা একটা মেয়ে| সে কোনো এক হিমুর বইতে পড়েছে গভীর রাতে নির্জন রাস্তাগুলো সব নদী হয়ে যায়| হিমুরা সেই নদী দেখতে পায়| কাজেই এই মেয়ে রাস্তার নদী হওয়ার দৃশ্য চাক্ষুষ দেখার জন্য এয়ারপোর্ট চলে গেল| অনেক দূর দিয়ে বেড়া ডিঙিয়ে চলে গেল রানওয়েতে| গভীর রাতে রানওয়ের মাঝখানে ঘাপটি মেরে বসে রইল|
কোনো এক বিমানের পাইলট ল্যান্ড করতে এসে এই দৃশ্য দেখে প্রায় ভিরমি খেলেন| জানালেন কন্ট্রোল টাওয়ারকে| পুলিশ এসে মেয়েটিকে গেপ্তার করল| মেয়ের মা উপায় না দেখে তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করলেন|
মেয়েটি এখন সুস্থ| মেয়ের মা মেয়েকে নিয়ে নুহাশ পল্লীতে এসেছিলেন| আমি তাকে দিয়ে মিউজিক ভিডিওতে কিছু কাজও করিয়েছি| হিমুর এই ব্যাপারে আমি বুঝতে পারছি না| কেন কিছু মানুষ হিমুকে সত্যি ভাববে? এদের "সাইকি" কি আলাদা?
নিউইয়র্কের এক মহিলার কথা বলি| বাঙালি মহিলা| স্বামীর সঙ্গে বাস করেন| স্বামী ট্যাক্সি চালান| তিনি নিজেও ইন্ডিয়ান শাড়ির দোকানে সেলস গার্লের চাকরি করেন| ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা হচ্ছে| এক পর্যায়ে তিনি বললেন‚ হুমায়ূন ভাই‚ হিমু নিউইয়র্কে বেড়াতে এসেছে এরকম একটা উপন্যাস লিখুন|
আমি বললাম‚ লেখা যেতে পারে|
ভদ্রমহিলা বললেন‚ হিমুর আসা-যাওয়ার খরচ আমি দেব| সে আমাদের বাসায় থাকবে|
এবার আমি চককালাম| উপন্যাসের একটি চরিত্রের জন্য আসা-যাওয়ার খরচ দিতে হয় না| তার ঘুমুবার জন্য খাট লাগে না| আমি বললাম‚ হিমু আপনার বাড়িতে থাকবে?
তিনি লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, হ্যাঁ| তার সঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে| সে যে কদিন আমার সঙ্গে থাকবে আমি কাজ করব না| ছুটি নেব|
আমি বললাম‚ আপনি একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন হিমু বলে কেউ নেই| হিমু আমার কল্পনার একটি চরিত্র|
ভদ্রমহিলা রাগত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন‚ আপনি তাকে নিউইয়র্কে আনতে রাজি না সেটা সরাসরি বললেই হয়| অযুহাত দেওয়া শুরু করেছেন|
আমি চুপ করে গেলাম| কিছুক্ষণের জন্য আমার মধ্যেও বিভ্রম তৈরি হলো| আসলেই হিমু বলে কেউ আছে না কি?
চলবে ...
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।