আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ময়ূরাক্ষীর তীরে প্রথম হিমু - দ্বিতীয় পর্ব - নয় নম্বর বিপদ সংকেত - হুমায়ূন আহমেদ

হেথায় কিছু লিখব বলে চায় যে আমার মন, নাই বা লেখার থাকল প্রয়োজন!

হিমু হুমায়ূন আহমেদের এক অসাধারণ সৃষ্টি। হিমুর সৃষ্টি এবং পথচলা সম্পর্কে হুমায়ূন আহমেদ নিজেই লিগেছেন ময়ূরাক্ষীর তীরে প্রথম হিমু। লেখাটি সম্ভবত কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আমি এটা সংগ্রহ করেছি বাংলাদেশ ইনফো ডট কম থেকে। আমার কাছে অবশ্য হিমুর বইগুলো তেমন ভালো লাগে না। হিমুর চেয়ে আমার রবং মিসির আলীকেই বেশি পছন্দ। আমার কাছে ভালো না লাগলেও ব্লগে হয়তো এমন অনেক পাঠকই আছেন, যাদের প্রিয় চরিত্র হিমু। তাদের জন্যই এই লেখাটি দেওয়া হল। চলমান ... পাঠকরা ভুলেও ভাববেন না ময়ূরাক্ষী বের হওয়ার পর পরই যুবক শ্রেণীর বিরাট অংশ হলুদ পাঞ্জাবি পরে রাস্তায় নেমে গেল| আমিও মনের আনন্দে একের পর এক হিমু বাজারে ছাড়তে লাগলাম| পাশ বইয়ের খাতায় টাকা জমা হতে লাগল| শুরুতে হিমুকে আমি মোটেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করিনি| তখন আমার প্রিয় চরিত্র মিসির আলি| আমি লিখছি মিসির আলি| এই ভদ্রলোকের লজিকে এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতায় আমি মুগ্ধ| এর মধ্যে আমার অর্থনৈতিক অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়েছে| বন্ধু-বান্ধব‚ ব্যাংক এবং প্রকাশকদের কাছ থেকে ধার করে এলিফ্যান্ট রোডে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছি| পনেরশ স্কয়ার ফিটের ছোট্ট ফ্ল্যাট| তাতে কী‚ দুটো বেডরুম আছে| একটা বারান্দা আছে| বারান্দায় বসলে সুন্দর কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পাই না| জুতার দোকান দেখতে পাই| ছয়তলা থেকে জুতার দোকান দেখা খারাপ কিছু না| বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে আমি জুতার দোকান দেখি এবং পরের লেখাটা কী হবে ভাবি| আমার তিন মেয়ে তখন সামান্য বড় হয়েছে| বড় মেয়েটি ক্লাস সিক্সে পড়ে‚ মেজোটি পড়ে ক্লাস ফোরে| ভোরবেলা স্কুলের পোশাক পরে তারা কিছুক্ষণ ধবল রঙের ডিপফ্রিজের সামনে দাঁড়ায়| কারণ তাদের বাবা রাতে যা লিখেছে তা ডিপফ্রিজের উপর সাজানো থাকে| আমার এই দুই কন্যা বাবার লেখার সর্বশেষ অংশ না পড়ে স্কুলে যাবে না| আমার লেখক জীবনে এর চেয়ে বড় পুরস্কার পেয়েছি বলে মনে পড়ে না| আমার এই দুই কন্যার কোনো একজন‚ খুব সম্ভব বড়জন আমাকে একদিন বলল‚ বাবা ময়ূরাক্ষীর মতো আরেকটা বই লেখ| হিমুর বই| হিমুকে নিয়ে কন্যার আগ্রহে লিখে শেষ করলাম দরজার ওপাশে| বই প্রকাশিত হলো| আমি পড়লাম মহাবিপদে| হাইকোর্টে বিচারকদের সমিতি আছে| সমিতির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো‚ এই বইটি লিখে আমি মহা অন্যায় করেছি| মহান বিচারকদের সম্মান ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছি| কারণ আমি লিখেছি জজ সাহেবরা ঘুষ খান| উপন্যাসে ঘটনাটা এ রকম - হিমুর মাতুল বংশ পিশাচ শ্রেণীর| তারা হেন দুষ্কর্ম নাই যা করে না| তাদের ধারণা যেকোনো কাজ টাকা দিয়ে করানো সম্ভব| তাদেরই একজন জজ সাহেবকে ঘুষ দিয়ে এই কাজটা করাতে চাচ্ছে| জজ সাহেবরা ঘুষ খান - এটি হিমুর ধান্ধাবাজ মামার কথা| বইতে কিভাবে এসেছে দেখা যাক| "মামা গোসল করে জায়নামাজে বসে গেলেন| দীর্ঘ সময় লাগল নামাজ শেষ করতে| তার চেহারা হয়েছে সুফি সাধকের মতো| ধবধবে সাদা লম্বা দাড়ি| মোনাজাত করার সময় টপটপ করে তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল| আমি অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখলাম| তারপর বল‚ কী ব্যাপার? একজন লোক জেলখানায় আছে মামা| ওর সঙ্গে দেখা করা দরকার‚ দেখা করার কায়দা পাচ্ছি না| দরখাস্ত করেছি‚ লাভ হয়নি| খুনের আসামি? তিনশ বারো ধারা? কোন ধারা তা জানি না‚ তবে খুনের আসামি| এটা কোনো ব্যাপারই না| টাকা খাওয়াতে হবে| এই দেশে এমন কোনো জিনিস নেই যা টাকায় হয় না| টাকা তো মামা আমার নেই| টাকার চিন্তা তোকে করতে বলছি নাকি? আমরা আছি কী জন্য? মরে তো যাই নাই| টাকা সঙ্গে নিয়ে আসছি| দরকার হলে জমি বেঁচে দেব| খুনের মামলাটা কী রকম বল শুনি| আসামি ছাড়ায়ে আনতে হবে| তুমি পারবে না মামা| তোমার ক্ষমতার বাইরে| আগে বল‚ তারপর বুঝব পারব কী পারব না| টাকা থাকলে এই দেশে খুন কোনো ব্যাপারই না| এক লাখ টাকা থাকলে দুটো খুন করা যায়| প্রতি খুনে খরচ হয় পঞ্চাশ হাজার| পলিটিক্যাল লোক হলে কিছু বেশি লাগে| আমি মোবারক হোসেন সাহেবের ব্যাপারটা বললাম| মামা গালে হাত দিযে গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনলেন| সব শুনে দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে বললেন‚ পুলিশের সাজানো মামলা‚ পেছনে আছে বড় খুঁটি| কিছু করা যাবে না| ট্রাইব্যুনাল করলে কোনো আশা নাই‚ সিভিল কোর্ট হলে আশা আছে| জজ সাহেবদের টাকা খাওয়াতে হবে| আগে জজ সাহেবরা টাকা খেত না| এখন খায়| অনেক জজ দেখেছি কাতলা মাছের মতো হাঁ করে থাকে| কেইস সিভিল কোর্টে উঠলে আমারে খবর দিয়ে নিয়ে আসবি| মামলা মোকদ্দমা বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই| সব সময় শুনেছি মামলা লোয়ার কোর্ট থেকে হাইকোর্টে যায়‚ তারপর সুপ্রিম কোর্টে| আমার বেলায় সরাসরি হাইকোর্ট থেকে তলব| শুধু আমি একা আসামি তা কিন্তু না| আমাকে নিয়ে বিচারকরা মামলা করেছেন এই বিষয়টি যেসব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তারাও আসামি| তাতে আমার সুবিধা হলো‚ পত্রিকার সম্পাদকরা বড় বড় ব্যারিস্টার দিলেন| এই মুহূর্তে ড. কামাল হোসেন এবং ভাষাসৈনিক গাজিউল হকের নাম মনে পড়ছে| পত্রিকার সম্পাদকরা উপস্থিত হয়ে ক্ষমা চাইলেন এবং পার পেয়ে গেলেন| অ্যাটর্নি জেনারেল তার অফিসে আমাকে ডেকে নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বললেন| তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যে‚ ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং বিতর্কিত বইটি বাজার থেকে উঠিয়ে নিলে আমার আর কোনো ঝামেলা হবে না| আমি বললাম‚ ভুল করলেই ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্ন আসে| আমি ভুল করিনি| উপন্যাসের একটি দুষ্ট চরিত্র কী বলছে তার দায়ভার লেখকের না| তারপরেও যদি দায়ভার আমার থাকে তাহলে আমি জজ সাহেবরা ঘুষ খান এই মন্তব্য থেকে সরে আসব না| সব জজ সাহেবের কথা এখানে বলা হয়নি| জজ সাহেবরা ভিনগ্রহ থেকে আসেননি| মানুষের সাধারণ ত্রুটি তাদের মধ্যেও থাকবে| একজন লেখক হিসেবে আমি তা লিখব| আমাদের সংবিধান মতপন্সকাশের অধিকার দিয়েছে| অ্যাটর্নি জেনারেল বললেন‚ আপনি কিন্তু বিপদে পড়বেন| আমি বললাম‚ কী আর করা| না হয় একটু বিপদে পড়লাম| মামলা শুরু হলো| আমি হাইকোর্টে যাই| সঙ্গে আমার তিন কন্যা এবং তাদের মা| তারা ভয়ে অস্থির‚ এই বুঝি আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে| মামলার এক পর্যায়ে তিন বিচারক নিয়ে গঠিত বেঞ্চের একজন বললেন‚ তিনি বিব্রত| মামলায় থাকবেন না| কিছুদিন পর আরেকটি বেঞ্চ তৈরি হলো| সেই বেঞ্চের এক বিচারকও বললেন তিনি বিব্রত| পনেরো ষোল বছর তো হয়েই গেল‚ বিচারকরা আমার বিষয়ে বিব্রত রয়েই গেলেন| আমার খুব ইচ্ছা করে মামলাটা শেষ পর্যন্ত দেখতে| মামলায় আমি যদি জিতে যাই তাহলে প্রমাণ হবে জজ সাহেবরা সাধারণ লোভ লালসার ঊর্ধ্বে না| আর যদি হেরে জেলে যাই ততেও ক্ষতি নেই| অতীতে এই পৃথিবীতে লেখার মাধ্যমে মত প্রকাশের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে| আমি মনা হয় কিছুদিন জেলে থাকলাম| আমাকে জেলখানার মেঝেতে শুয়ে থাকতে হবে না| একুশে পদক পাওয়ার কারণে ডিভিশন দেওয়া হবে| বিছানায় ঘুমাব| ভাগ্য ভালো হলে মাথার উপর ফ্যান ঘুরবে| ফ্যান না ঘুরলেও ক্ষতি নেই, চোখ বন্ধ করে ময়ূরাক্ষী নদীকে জেলের ভেতর নিয়ে আসা কঠিন কোনো কাজ না| চলবে ... প্রথম পর্ব পড়তে হলে ক্লিক করুন এখানে।[wjsK=http://www.somewhereinblog.net/blog/toha_mhblog/28716904]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.