বাংলাদেশের প্রথম নারী স্পিকার নির্বাচনে আমাদের যত খুশি হওয়ার কথা ছিল, তা আমরা হতে পারলাম না। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী শিরীন শারমিন চৌধুরীকে অভিবাদন জানাই। হেফাজতের নারীবিদ্বেষী দাবির পটভূমিতে নারী স্পিকারের অধিষ্ঠান বহির্বিশ্বে নিশ্চয় একটা ভালো বার্তা পাঠাবে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চায় এটি একটি প্রতিষ্ঠানগত বিপর্যয় ডেকে এনেছে বলেই প্রতীয়মান হয়।
ব্যক্তির প্রতি আনুগত্যের যে মানদণ্ডে শিরীন শারমিন চৌধুরী সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য এবং তা থেকে প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই একই মানদণ্ডে তিনি এখন রাষ্ট্রের তিন নম্বর গুরুত্বপূর্ণ পদে উন্নীত হলেন।
তাঁকে বাছাইয়ের অরাজনৈতিক প্রক্রিয়াটা জাতীয় রাজনীতির জন্য একটি লজ্জা।
স্পিকার সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণ। সমাজের সম্পূর্ণ রাজনীতিটা তাঁকে ধারণ করতেই হয়। প্রাচীন ইংল্যান্ডে হাউস অব কমন্স যেসব প্রস্তাব নিত, স্পিকার তা রাজা বা রানির কাছে পৌঁছাতেন। এ দায়িত্ব পালন ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
বেশ কয়েকজন স্পিকার রাজা বা রানির রোষে পড়ে নির্মমভাবে নিহত, কারারুদ্ধ বা নিগৃহীত হয়েছেন। নির্বাচিত স্পিকার তাই তাঁর আসনে বসতে নিরাসক্ত থাকতেন। ব্রিটিশরা সেই তিক্ত স্মৃতি স্মরণে দীর্ঘকাল স্পিকারকে আক্ষরিক অর্থেই টানাহেঁচড়া করে তাঁর আসনে বসানোর রীতির প্রবর্তন ঘটিয়েছিল। ১৭২৮ সালে স্পিকার অনস্লো এই রীতির বিলোপ ঘটান।
ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯২১ সালে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে সর্বপ্রথম স্পিকার পদটি সৃষ্টি হয়।
যদিও ’৪৭ সাল পর্যন্ত এই পদটি প্রেসিডেন্ট নামে অভিহিত ছিল। এ পদে নিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি স্যার ফ্রেডরিক হোয়াইট হাউস অব কমন্সের সদস্য ছিলেন। তাঁর উত্তরসূরিরা সবাই কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ দ্বারা নির্বাচিত হন।
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকারগণের প্রত্যেকেই কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন। বাংলাদেশে তৃণমূলের রাজনীতির সঙ্গে জীবনের দীর্ঘ সময় ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা ব্যক্তিরাই স্পিকার হয়েছেন।
সাতবারের নির্বাচিতের স্পিকার থেকে একবারও নির্বাচিত না হওয়ার পর্যায়ে নেমে এল বাংলাদেশ। আগে প্রতিবারই স্পিকারের শূন্যপদ ডেপুটি স্পিকার পূরণ করেছেন। শাহ আবদুল হামিদ স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদে স্পিকার পদে নির্বাচিত প্রথম ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুতে বঙ্গবন্ধু ডেপুটি স্পিকার মুহাম্মাদুল্লাহকে স্পিকার করেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর ডেপুটি স্পিকার আবদুল হামিদ স্পিকার হন।
স্পিকার আবদুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি হলে ডেপুটি স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী স্পিকার হন। এ ছাড়া রাজনীতিতে নবীন কাউকে কখনো স্পিকার করা হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ ছেড়ে আবদুল মালেক উকিল স্পিকার হয়েছিলেন।
এমন এক অনির্বাচিতকে ৩০০ নির্বাচিতের অভিভাবক করা হলো, যাঁকে কনিষ্ঠ ও অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞ বিবেচনায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়েরও পূর্ণ মন্ত্রী করা যায়নি। মির্জা গোলাম হাফিজ, শামসুল হুদা চৌধুরী, শেখ রাজ্জাক আলী, জমির উদ্দিন সরকার—আর যাই হোক, এঁরা কেউ প্রত্যক্ষ সংসদীয় রাজনীতিতে নবিশ ছিলেন না।
সংসদ জাতির প্রতীক। স্পিকার সংসদের প্রতীক। ১৯৪৮ সালের ৮ মার্চ পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘স্পিকার জাতীয় স্বাধীনতার প্রতীক। তাই এই আসন সর্বদাই এমন ব্যক্তিকে দিতে হবে, যার রয়েছে অনন্যসাধারণ সামর্থ্য এবং নিরপেক্ষতা। ’ নতুন স্পিকারের এই যোগ্যতা থাকতে পারে।
কিন্তু ওপর থেকে তা চাপানোর পর আমাদের জানতে হবে? এটা তো ওপর থেকে চাপানোর বিষয় নয়। সংসদীয় রাজনীতিতে আমরা তাঁকে চিনি না। অবশ্য কেউ বলতে পারেন বাংলাদেশ তো এভাবেই চলেছে। সংসদীয় রাজনীতি সেটা আবার কী। সোনার পাথর বাটি আবার কী বস্তু।
এভাবে দেখলে আমরা হার মানব।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পরই স্পিকারের অবস্থান। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার সমন্বয়ে গঠিত সংসদ সচিবালয় কমিশনের সভাপতির দায়িত্ব স্পিকারের ওপর ন্যস্ত। সংসদ নেতা সদস্য রয়েছেন এমন দুটি সংসদীয় কমিটি স্পিকারের সভাপতিত্বে গঠিত। স্পিকার একই সঙ্গে দেশের ছায়া রাষ্ট্রপতি।
এর মানে যেকোনো সময় তিনি হয়ে উঠতে পারেন জাতির অভিভাবক। আসন্ন দিনগুলো প্রধানমন্ত্রীর জন্য ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ হতে পারে। এই অভাবনীয় নিয়োগ হয়তো তাঁর একটি ব্যক্তিগত রক্ষাকবচ। প্রথম নারী স্পিকার এর বাহ্যিক দিক মাত্র।
দুই দশকের বেশি সময় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফ।
৭৫ বছর বয়সী এই নেতার উক্তি: ‘চলতি রাজনীতিতে ব্যক্তির মেধা ও যোগ্যতা কাজে লাগতে পারে কিন্তু “রুট কানেকশন” অর্থাৎ তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও চলবে। ’
পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের প্রথম নারী স্পিকার প্রাপ্তি শুধু জাতীয়ভাবেই নয়, এটি একটি উপমহাদেশীয় বিড়ম্বনার নজিরও বটে।
পাকিস্তানে প্রথম ২০০৮ সালে নারী স্পিকার নির্বাচিত হন ফাহমিদা মির্জা। পেশায় চিকিৎসক। স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি তিনবার এমপি নির্বাচিত হন।
৫২ বছর বয়স্ক মির্জা একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে স্বীকৃত। তিনি ৩৪২ আসনের পার্লামেন্টে ২৪৯ ভোট পেয়েছিলেন। এক বছরের ব্যবধানে ভারতের শুরুটা আরও অনেক উত্তম। ২০০৯ সালে ভারত সত্যিকার অর্থেই ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ শুধু একজন নারী নন, একজন দলিত অর্থাৎ অস্পৃশ্য সমাজ থেকে তুলে আনে মীরা কুমারকে। তিনি ভারতের উপপ্রধানমন্ত্রী জগজীবন রামের মেয়ে।
পাঁচবারের নির্বাচিত সাংসদ। স্পিকার হওয়ার আগে পাঁচ বছর পূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন।
১৯৭৭ সাল থেকে ভারতে সরকারি দল থেকে স্পিকার ও বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হয়। কংগ্রেস যখন মীরা কুমারকে স্পিকার প্রস্তাব করল, তখন বিজেপিও ডেপুটি স্পিকার পদে অনগ্রসর অংশ থেকে একজনকে বেছে নিল। ঝাড়খন্ড থেকে সাতবারের নির্বাচিত উপজাতি সাংসদ করিয়া মুন্ডাও তাই নির্বাচিত হলেন।
দুজনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কণ্ঠভোটে নির্বাচিত হলেন। আওয়ামী লীগও বলছে আমরাও ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ নারী স্পিকার করেছি। অথচ রূঢ় বাস্তবতা হলো এখানে জাতীয় ঐকমত্যের তো প্রশ্নই নেই, এমনকি দলের ভেতরেও এ নিয়ে টানাপোড়েন তীব্র। বাইরে থেকে এর ততটা হয়তো চোখে পড়বে না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সমাজের অনগ্রসর অংশ থেকে আসা নারীনেত্রীর স্পিকার হওয়াকে যখন ঐতিহাসিক এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারের প্রতিফলন হিসেবে বর্ণনা করেন, তখন আমরা তার গ্রহণযোগ্যতা অনুধাবন করতে পারি।
কিন্তু আমাদের দেশে যখন একত্রে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা ও স্পিকার পদে নারী দুনিয়ায় প্রথম এবং তাকেই নারীর ক্ষমতায়ন হিসেবে দাবি করা হয়, তখন খটকা লাগে।
গত ১৪ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরে প্রথম নারী স্পিকার হলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত হালিমা ইয়াকুব। তিনিও প্রতিমন্ত্রীর পদ ছেড়ে স্পিকার হন। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে কত তফাত। হালিমা একজন নন্দিত শ্রমিকনেত্রী।
স্পিকার হওয়ার আগে তিনি টানা এক যুগ নির্বাচিত এমপি ছিলেন।
সংরক্ষিত মহিলা আসনের উদ্দেশ্য ছিল নারী-পুরুষের সমতা অর্জন করা। সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে স্পিকার হওয়ার পথে প্রত্যক্ষ কোনো আইনি বাধা নেই। কিন্তু তা সংসদীয় ঐতিহ্য শুধু নয়, বাংলাদেশ সংবিধানেরও চেতনাবিরুদ্ধ। নির্বাচিত অনির্বাচিতদের দ্বন্দ্বের তর্ক তুলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা হয়েছে, শিরীন শারমিনকে স্পিকার করে সরকারি দল তার সেই নীতিকেও প্রকারান্তরে ভেংচি কাটছে।
কারণ, সংসদের মূল ভিত্তি হচ্ছে ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী নির্বাচিত ৩০০ সদস্য। ’
সংরক্ষিত মহিলা আসন বিতর্কমুক্ত কোনো ব্যবস্থা নয়। অব্যাহতভাবে এর বৈধতা উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এরশাদ আমলে সংসদের ‘৩০ সেট অলংকার’ একটি নিন্দিত উচ্চারণ ছিল। প্রত্যক্ষ নির্বাচনে নির্বাচিত ৩০০ সাংসদের সৃষ্টি হলো ৫০ নারী সদস্য।
এখন সংরক্ষিত আসন থেকে স্পিকার নিয়োগ মানে স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টি বড় করে তোলা। যেভাবে বলা বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়।
সংবিধানের দশম সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ আরও বৃদ্ধি করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। এটা যে একটা সাময়িক ব্যবস্থা, সেটা উচ্চ আদালত স্বীকার করেছেন। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামের মন্তব্য ব্যাখ্যা করে বলতে পারি, সংরক্ষিত আসন থেকে স্পিকার নির্বাচনটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ‘বোনাসের’ অপব্যবহার।
মাহমুদুল ইসলাম লিখেছেন, ‘সংরক্ষিত আসন বাস্তবে সংসদের ৩০০ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠের দল বা দলসমূহের জন্য বোনাস। মহিলা আসনে সংরক্ষণ সংবিধান প্রণেতাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু এর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে নারী পুরুষে সমতা অর্জন করা। ’ এখন নারী-পুরুষে সমতা নয়, নির্বাচিত ও অনির্বাচিতের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হলো।
স্পিকার নিয়োগ যদি ওই সমতা অর্জনে বাধা না হয়ে সহায়ক বলেই বিবেচিত হয়, তাহলে আমরা কি আশা করব যে, সংরক্ষিত আসন থেকে জাতি ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রীকেও বেছে নিতে পারবে।
অর্থাৎ ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী ঘুমিয়ে আছে সংরক্ষিত আসনের অন্তরে!
সংবিধান কার্যত সাধারণ আসনে নির্বাচন ও মহিলা নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। সংবিধান বলছে, সাধারণ আসনে নির্বাচন করতে ‘কোনো মহিলার নির্বাচন নিবৃত্ত করবে না। ’ সুতরাং সর্বতোভাবেই প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন ও পরোক্ষ ভোটে নির্বাচনের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা আছে। এখন প্রশ্ন দাঁড়াল, নারীরা তাঁদের ক্ষমতায়নের মসৃণ সিঁড়ি হিসেবে সংসদে তাঁদের আসন সংরক্ষণকেই কি আরও দীর্ঘকাল ধরে রাখার মধ্যেই সন্তুষ্টি খুঁজবেন?
শামিমা সুলতান বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত হচ্ছে সাধারণ আসনে যখন পর্যাপ্তসংখ্যক নারী নির্বাচিত হবেন, তখন মহিলা আসন সংরক্ষণের দরকার পড়বে না। এর অর্থ হচ্ছে সংরক্ষিত আসন কমিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রত্যক্ষ ভোটের নির্বাচনে নারীদের উৎসাহিত করা।
আর সে জন্য দলকে সেভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। কিন্তু তার কোনো প্রস্তুতি নেই। এখন বরং দেখানো হলো ফাউ থেকে আরও ফাউ কীভাবে লুটে নিতে হবে। বিএনপি এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করবে না। কারণ, এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের তফাত নেই।
অবশ্য স্পিকার নিয়োগ-প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করলেও ইতিহাসের প্রথম বাঙালি নারী স্পিকারের জন্য রইল শুভ কামনা।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।