সযতনে খেয়ালী!
আগের পর্ব পড়ুন
বিপরীত থেকে আসা রিক্সাটা চুড়ির ভ্রাম্যমান দোকান ছাড়িয়েই থামলো। রিক্সাটা যখন শুভ্রার সামনে দিয়ে চলে যায় তখন একটা শীতল স্রোত তার গা বেয়ে নিচের দিকে নেমে যায়। "হুট" করে একটা ধাক্কা লাগে, তাহলে কি শিপলু তাকে দেখতে পায়নি! বেশি চালাকের গলায় দড়ি, নিজে থেকে হাত নাড়লে কি হতো তখন! ভালো হয়েছে, একদম বেশী বেশী - স্বগতোক্তি শুভ্রার। নিজের আচরণে নিজেই ক্ষুব্ধ হয়ে ঘাড় কাৎ করে চোরা চোখে শিপলুর পথের দিকে তাকিয়ে দেখে শিপলু রিক্সা থেকে নেমে তার দিকেই আসছে। মূহুর্তেই অন্যরকম একটা শিহরণ খেলা করে যায় শুভ্রার সারা শরীরে।
অব্যবহিত আগের কঠিন স্বগতোক্তি ভুলে যায়, ভালো লাগতে থাকে চুড়িওয়ালা মামার মরিচা পড়া দাঁতের হাসিও, ইচ্ছে করে পুরো লটটাই কিনে নিতে।
: এই যে কেমন আছেন? কি করছেন এখানে?
: চোখের সানগ্লাসটা খোলেন তারপর বলছি!
শিপলু হাসি দিয়ে কালো রোদচশমাটা খোলে।
: এই চশমাটার আড়াল থাকার কারণে অনেক কিছুই দেখেন না আপনি। নইলে এতো অল্প বয়সে তো চোখে কম দেখার কথা না!
: জ্বি মানে ইয়ে, আপনার মনেহয় মুড খারাপ!
হঠাৎ বাউন্সারে শিপলু হতচকিয়ে যায়।
: হাহাহাহা, নাহ্ মুড ভালোই আছে।
আমাকে দেখছেন দিব্যি চুড়ি কিনছি তারপরেও কিনা জিজ্ঞেস করছেন, "এখানে কি করছি"! এটা কোন প্রশ্ন হলো?
এবার শিপলুও হেসে ওঠে। শুভ্রার মতো 'ব্যাটসম্যান' কে লুজ বল দিলে সে ওভার বাউণ্ডারী হাঁকাবেই। মনেমনে খুশী হয় শিপলু, চটপটে আর স্মার্ট মেয়েদের সাথে শিপলুর দারুণ সম্পর্ক জমে ওঠে। 'বার্ডস উইথ সেম ফিদার ফ্লক টুগেদার'- শিপলুর ক্ষেত্রে কথাটি আংশিক না বরং পুরোপুরি সত্যি।
: এতো কাগজ কীসের, এগুলো নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন! কোন বিজ্ঞাপন দিতে যাচ্ছেন নাতো!
শিপলুর হাতের একগাঁদা কাগজের দিকে তাকিয়ে শুভ্রা বললো।
: ওহ, তেমন কিছুই না। এই দরকারী কিছু কাগজপত্র।
: আচ্ছা আপনার হাতে সময় আছে? থাকলে চলুন একটু হাঁটি বরং!
শুভ্রা বললো বন্ধুদের কার্জনে থাকার কথা। একসাথে কোথাও ঘুরতে যাবার প্ল্যান আছে।
: তাহলে চলুন কার্জনের দিকেই হাঁটা যাক।
: আপনার রিক্সা!
শিপলু গিয়ে ভাড়া মিটিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে-
: চুড়ি কিনবেন না? আমিতো মনেহয় বাগড়া বাঁধিয়ে দিলাম। চলুন আমি পছন্দ করে দিই!
: আপনার কী রঙ পছন্দ?
: মেরুণ, কিন্তু আপনার হাতে মেরুণের চাইতে গাঢ় নীলের চুড়ি মানাবে ভালো!
: তাই, কী করে বুঝলেন!
: এটা হলো ইনস্টিংক্ট, বুঝলেন হেহ হেহ হেহ!
শুভ্রাও হেসে ফেললো তার "ইনস্টিংক্ট" বলার ধরণে। চুড়ি কিনে দাম দেবার সময় শিপলু জোর করে দিয়ে দিলো। শুভ্রা সেটা কিছুটেই হতে দেবে না।
হাজার হোক বাঙালী ললনা, কোন অপরিচিত কিংবা আংশিক পরিচিত পুরুষের কাছ থেকে উপহার পাবার জন্য তখনো তৈরী হয়নি। শিপলু বললো, "দেখুন কাঁচের চুড়ি আমার ভীষন পছন্দের। এতোটা পছন্দ করি যে বলার মতো না। কিন্তু ছেলে বলেতো পড়তে পারি না। নিজে কিনে কিনে তো আর ঘর ভরে রাখতে পারি না, লোকে কী বলবে! এখন আপনাকে দেবার সুযোগটা পেয়েছি।
আপনি না নিলে চুড়ি গুলো বয়ে আমার ঘরেই নিয়ে যাওয়া লাগবে। শিপলুর কথা শোনার পর শুভ্রা আর না করে নি, নিয়ে নিয়েছে।
হেঁটে দোয়েল চত্ত্বরের এখানে এসে তারা রাস্তা ক্রস করে শিশু একাডেমির সামনের ছোট্ট দোকানটাতে দাড়ালো। শুভ্রা বললো, চা খাবেন?
শিপলুও চা খাওয়ার কথা ভাবছিলো অনেক্ষণ ধরেই। সকালে বাসা থেকে হুড়মুড়িয়ে বের হয়ে গেছে এম্বেসীতে যাবার জন্য।
চা খাওয়া হয়নি। সেখান থেকে মালিবাগ গিয়ে অয়ন কে সঙ্গে করে কর্ণফুলি টাওয়ার হয়ে সোজা কার্জন। ভেবেছিলো নীলক্ষেতের বেস্ট ইন ঢাকা তেহারী মেরে দিবে আয়েশ করে। কবে না কবে আবার এই তেহারীর স্বাদ নেবার সুযোগ সে পাবে! কতকিছুই বদলে যেতে পারে, উবে যেতে পারে নীলক্ষেতের অমন 'আনহাইজেনিক' পরিবেশের তেহারী খাওয়ার শখও।
: কী হলো, কী ভাবছেন!
: কিছু না, চলুন চা খাই।
আজকে চিবিয়ে চিবিয়ে চা খাবো আপনাকে নিয়ে। চললুন!
হাসলে দারুন লাগে মেয়েদের। শুভ্রাকে যেনো খানিকটা বেশিই সুন্দর লাগে। হাসতে হাসতে যখন মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে মুখের ওপর থেকে চুল গুলো সরালো, শিপলু তন্ময় হয়ে তাকিয়ে দেখছিলো। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো শুভ্রাকে বলে, "আরেকটাবার করেন তো ওরকম করে..."।
চায়ের সাথে একটা করে সমুচাও আসলো সবুজ রঙের প্লাষ্টিকের প্লেটে করে। সমুচা জিনিষটা ভীষন ভালো লাগে শিপলুর। ভাজাপোড়ার দিকে বিশেষ ঝোঁক আছে সেটা যে কেউ বুঝতে পারে শরীরের কাঠামো দেখেই। একবার এই সমুচা খাওয়ার জন্য রাত সাড়ে এগারোটার সময় দুই বন্ধুকে হাঁটিয়েছে কয়েক মাইল।
সমুচা মেলেনি তারপরেও, দোকানীরা তখন ব্যবসা গুটাতে ব্যস্ত ঘরে যাবার তাড়ায়।
সারা দিনের শেষে সমুচা বেঁচে আছে এমন কোন দোকানই তারা খুঁজে পায়নি। বন্ধু দুজনও নাছোড় বান্দা, একজন বলে, "আজ তোকে সমুচা না খাইয়ে ঘরে ফিরতে দেবো না। শালা এতো রাতে এতোটুকু হাটাইছস দরকার হলে বাকীরাত ও হাঁটবো, তবু তোরে সমুচা খাইয়ে ছাড়বো"!
এবার বাকি জন বলে, "হাঁটা যখন দিয়েছি, হাঁটা আরও দেবো, তবু তুমি চান্দুরে সমুচা খাওয়াইয়া ছাড়ুম ইনশাল্লাহ্"!
অবশেষে মেডিক্যাল কলেজের এদিকে কোন এক কনফেকশনারীতে ঠান্ডা জিড়জিড়ে অবস্থায় পাওয়া গেলো অতিকাঙ্খীত সেই নীলমনি সমুচা।
: আরে কী হলো আপনার? কোথায় ডুবে যাচ্ছেন বারবার। আপনি তো দেখি বুদ্ধিজীবিদের মতো করছেন খালি ভুরু কুঁচকিয়ে কি জানি ভাবেন!
: বুদ্ধিজীবি হলে তো ভালোই হতো! তখন হাজার হাজার মেয়ে মানুষ লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকতো একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য।
আপনি চা খাওয়ার জন্য ডাকলেই চলে আসতাম ভেবেছেন!
: তো ভ্রু বাঁকা করে, উদাসী দৃষ্টিতে কি ভাবেন হে?
: আমার বন্ধুগুলা একটু পাগলাটে ছিলো জানেন! মাথায় কোন ভূত চাপিয়ে দিলেই হলো, ব্যস।
: আপনার বন্ধুদের গল্প শোনাবেন? - আব্দারটার সাথে কেমন একটা সুর নিজেই টের পেলো শুভ্রা।
: শোনাতে তো কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আপনার না কোথায় যাবার কথা!
: এই রে... ওরা সবাই মনেহয় ওয়েইট করছে আমার জন্য। আচ্ছা আপনার সাথে দেখা হবার কোন সুযোগ আছে।
নিজের ধারার বিপরীতে গিয়েই যেন কথাটা বলে ফেললো শুভ্রা।
: কাল দেখা হতে পারে। বেলা সাড়ে এগারোটায়, টিএসসির সামনে।
: ঠিক আছে। সাড়ে এগারোটায়
শুভ্রা চোখে মুগ্ধতার হাসি ধরে রেখে রাস্তা পার হয়ে কার্জনের দিকে পা বাড়ায়।
শিপলু মাথা চুলকায়, মেয়েটাকি দিন দিন বদলায় নাকি?
: মামা একটা বেনসন লাইট দেনতো!
সিগারেট টা নিয়ে ধরিয়ে রাস্তা বদলিয়ে কি মনে করে শিপলু হাইকোর্টের দিকে হাঁটা শুরু করে।
চলুক!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।