ঝিমিত ঝিমিত জুনি জ্বলে / মুড়োর দেজর দেবার তলে/ এই মুড়ো জনম আমার, এই মুড়ো মরন/ এই মুড়ো ছাড়ি গেলে/ ন' বাঁচিব জীবন...চাকমা গান... ঝিকমিকি জোনাকী জ্বলছে ওই দেখ আমার পাহাড়ের দেশে, এই পাহাড়েই আমার জন্মমৃতূ্য, পাহাড় ছেড়ে গেলে আমি কি করে বাঁচবো বলো?
পাহাড়, অরণ্য, ঝর্ণা ধারার নিঃস্বর্গ ভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম বেড়াতে গিয়ে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। কাপ্তাই লেক, চাকমা রাজবাড়ি, সুবলঙের জলপ্রপাত, আকাশ ছোঁয়া চিম্বুক পাহাড়, ছবির চেয়েও সুন্দর বিলাইছড়ির জগ্নাছড়ার নির্মল পাহাড়ি গ্রাম, কি আলুটিলা বা হেতমুড়োর পাহাড়ের নৈস্বর্গিক দৃশ্য মুগ্ধ না করে ছাড়ে না।
প্রিয় পাঠক, আর যারা আরেকটু অনুসন্ধিৎসু হবেন, তারা দেখবেন অন্য এক বেদনা বিধুর পাহাড়...শুনবেন চাকমা লোক গানে বলা পাহাড়ি মানুষের বঞ্চনার কথা।
তখন হয়তো চোখ বুজলেই আকাশ সমান সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় দেখা যাবে কালচে লাল ছোপ ছোপ মানুষের রক্তচিহ্ন। গহীন অরণ্যের গভীরে হয়তো কান পেতে শুনলে কবে কোথাও নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যাওয়া মেশিন গানের প্রতিধ্বনীত গুলির আওয়াজ...ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদ পাগল প্রায় করে ফেলবে আপনাকে।
কাঁচের মতো স্বচ্ছ কাপ্তাই লেকের পানি পান করতে গিয়ে হয়তো লোনা ঠেকবে এর স্বাদ...মনে হতেই পারে এই লেকের পানির উৎস কর্ণফুলি নদী নয়...দু:খি পাহাড়ির চোখের লোনা অশ্রুতে সৃষ্টি এই কৃত্রিম লেক। আপনার মনে পড়ে যেতে পারে হারিয়ে যাওয়া দূর্গম বাঘাইছড়ির পাহাড়ি মেয়ে কল্পনা চাকমার কথা।
গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে পাহাড়ে, বনে --বাদাড়ে ঘুরে তথ্য সংবাদ সংগ্রহ করার সুবাদে পার্বত্যাঞ্চল বিষয়ে সমতলের মানুষের অনেক কৌতুহলি প্রশ্নে মুখোমুখি হতে হয়েছে, এর অধিকাংশই প্রশ্ন শুধু মাত্র কল্পনা চাকমাকেই নিয়ে। প্রশ্নগুলো অনেকটা এরকম:
আচ্ছা, কল্পনা চাকমাকে অপহরণ (১৯৯৬ সালের ১২ জুন) করেছে কারা? পাহাড়িদের সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীই নাকি তাকে অপহরণ করে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য সেনা বাহিনীর ওপর দোষ চাপাচ্ছে? সেনা বাহিনীই বা তাকে অপহরণ করবে কেনো? তাদের লাভ কি? কল্পনা চাকমা নাকি এখন ভারতের ত্রিপুরায়? তিনি এখন কোথায়?
এসব প্রশ্নের জবাবে অতি বিনয়ের সঙ্গে সংেেপ যা বলতে চেষ্টা করা হয়েছে, তা হচ্ছে:
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান -- এই তিন জেলা নিয়ে গড়ে ওঠা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি স্বারের আগে (১৯৯৭সালের ২ ডিসেম্বর) প্রায় দুদশক ধরে রক্তক্ষয়ী বন্দুক যুদ্ধ হয়েছে সেনা বাহিনীর সঙ্গে শান্তিবাহিনীর। হয়েছে লোগাং, নান্যাচর, লংগদু, বরকল, কাউখালি, পানছড়ি, দিঘিনালাসহ আরো অনেক গণহত্যা পর গণহত্যা, অপহরণের পর অপহরণ, ধর্ষণ আর গণধর্ষণ।
গ্রামের পর গ্রাম জ্বলেছে লোভি মানুষের লেলিহান অগ্নি শিখায়।
প্রায় ৭০ হাজার পাহাড়ি মানুষকে শুধুমাত্র জীবনটুকু সম্বল করে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিতে হয়েছে ত্রিপুরার শরণার্থী শিবিরে। যাদের এক সময় ছিলো পাহাড়ের মতো মুক্ত জীবন, সাজানো -- গুছানো বাড়ি -- ঘর, জমি -- জিরাত, সেগুন কি কাঁঠাল বাগান ছিলো যাদের, শরণার্থী শিবিরে এসে ঘিঞ্জি বস্তিঘরে একেবারে ভিখিরির মতো দীর্ঘ এক যুগ সামান্য রেশনের জন্য হাত পাততে হয়েছে তাদের!
মানুষ মরেছে গুলিতে, শরণার্থী শিবিরে -- একেবারে ঝাঁকে ঝাঁকে। একমুঠো চালের চেয়েও তখন বুঝি সস্তা ছিলো মানুষের জীবন!
এমন যুদ্ধ -- বিদ্ধস্ত দুদশকের অস্থির অনিশ্চিত পাহাড়ে কল্পনা চাকমার আরো কতো সহযাত্রী নিখোঁজ হয়েছে, হারিয়ে গেছে কতো শত হাজার কল্পনা চাকমা, নিখোঁজ হয়েছে কতো কল্পনার মা, কি বাবা , ভাই, বন্ধু বা স্বজন। কেউ খবর রাখেনি এসব নিখোঁজ সংবাদের।
হয়তো কল্পনা চাকমা হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভানেত্রি ছিলেন বলে তাকে নিয়ে তখন এতো হইচই হয়। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের কিছুদিন আগেই এই অপহরণের ঘটনা ঘটে বলে তাকে নিয়ে পত্র -- পত্রিকায় হয় বিস্তর লেখালেখি। সে সময় তাকে উদ্ধারের দাবিতে একই সঙ্গে পাহাড়ে ও সমতলে গণআন্দালন গড়ে উঠেছিলো -- এটিও এর কারণ হতে পারে। আর নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এনজিওগুলোর মানবাধিকার তথা আদিবাসী ইস্যূতে দাতাগোষ্ঠির কাছ থেকে বিদেশী মূদ্রা হাতিয়ে নেওয়ার বানিজ্যিক স্বার্থে তুমুল চিৎকার তো ছিলোই।
কল্পনা চাকমা অপহৃত হওয়ার কিছুদিন পর (সম্ভবতঃ সেটা ১৯৯৬ সালের জুনের শেষে আথবা জুলাইয়ের শুরুতে) পেশাগত কারণে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির নিউ লাইল্লাঘোনা গ্রামে কল্পনাদের বাড়িতে যাওয়া হয়।
কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে অখণ্ড পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের যে চারজন তরুন ছাত্রকর্মি প্রাণ দিয়েছিলেন, রূপকারী গ্রামের স্কুল মাঠে সেদিন আয়োজন করা হয়েছিলো তাদের স্মরণ সভা।
শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদে ছোট্ট একটা স্কুল মাঠে অনেক দূর -- দুরান্ত থেকে হত দরিদ্র পাহাড়ি নারী --পুরুষ, ছোট -- ছোট ছেলেমেয়ে, এমনকি অনেক বুড়ো -- বুড়িও পাহাড় জঙ্গল ভেঙে এসেছিলেন সেই স্মরণ সভায়।
পুরো স্কুল মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। চাকমারা ছাড়াও মারমা ও ত্রিপুরা ভাষী পাহাড়িরা আছেন সেখানে। এটিই দেখা পাহাড়ি জনতার প্রথম সমাবেশ নয়।
তবে এটিই বোধহয় এখনো দেখা সবচেয়ে বেদানার্ত মানুষের পাথর চাপা কান্নার সমাবেশ।
কল্পনা চাকমাকে নিয়ে রূপালী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামান্য এক শিক ব্রকুমার (লালফা) চাকামা খোলা গলায় গাইলেন গান। পুরো সমাবেশে ওঠে শব্দহীন কান্নার রোল। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বিপ্লবী নেতা -- নেত্রিরাও বক্তব্য দিতে গিয়ে বার বার কথাই খেই হারিয়ে ফেলেন, গলা ধরে আসে কান্নায়।
মাইকে যখন শোনা হয় বক্তব্যের পালা পড়েছে এবার ঢাকা থেকে আসা সাংবাদিকের, তখন ঝাঁপসা হয়ে আসা চশমার কাঁচ মুছে কোনো রকমে জানিয়ে দেওয়া হয় নেতিবাচক মনোভাব।
ওই স্মরণসভা শেষে চারজন শহীদ স্মরণে স্কুল মাঠের মাথায় প্রতিষ্ঠা করা হয় চারটি স্তম্ভের স্মৃতির মিনার।
আরো পরে কল্পনা চাকমার বাড়ি যাওয়ার পথে পাহাড়ি বন্ধুরাসহ এক বৌদ্ধ মন্দিরে (কিয়াং) বিশ্রামের সময় কথা হয় অতি বৃদ্ধা এক সন্নাসীর সঙ্গে। সাধু মা নামেই যিনি সেখানে পরিচিত, কথা বলেন ীণ কন্ঠে ভাঙা ভাঙা বাংলায়, তার চাকমা উচ্চারণেও ফুটে ওঠে আদি চাকমা ভাষার বোল।
তিনিও জানেন কল্পনার অপহরণের কথা। তবে ভুল করে তিনি ভেবেছিলেন, এরা বোধহয় কল্পনার উদ্ধারকারী দল।
করোজোড়ে কপালে প্রনাম ঠেকিয়ে বলেন, তোমারাই বোধহয় ভগবান!
এরপর সন্ধ্যা থেকে মাইলের পর মাইল পাহাড় ভেঙে ঝির ঝির বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল দুর্গম পথ ধরে সামান্য টর্চের আলো ধরে পথচলা। জুতো হাতে প্যান্ট গুটিয়ে কাঁদা মাখা পিচ্ছিল পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আছাড় খেতে খেতে কল্পনাদের বাড়ি পৌঁছে যাওয়া।
এক চিলতে উঠোন ঘিরে ছোট একটি কুঁড়ে ঘর, অভাবের চিহৃ সর্বত্র প্রকট। ঘুটঘুটে অন্ধকারে হ্যারিকেন আর টর্চ হাতে পুরো গ্রাম ভেঙে পরে আগত বাহিনীকে দেখতে। কথা হয় কল্পনার জুম (পাহাড়ে ঢালে বিশেষ ধরণের চাষাবাদ) চাষী দুই ভাইয়ের সঙ্গে।
তখনো পুরো পরিবারটির আতংক কাটেনি। নিরাপত্তার জন্য বৃদ্ধ মা বাঁধুনী চাকমাসহ তাদের রাত কাটছে অন্যের বাড়িতে।
তারা দু'জন অর্নগল চাকমায় বর্ণনা করেন কি ভাবে লেফটেন্ট ফেরদৌসের নেতৃত্বে পোষাকধারী সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় সেদিন রাতে তাদের আদরের ছোটবোন কল্পনাকে।
একভাই বেশ কিছুদূর সন্ত্রাসীদের অনুসরণ করলে ব্রাশ ফায়ার করে ওরা। প্রাণ বাঁচাতে কাচালং নদীতে ঝাঁপিয়ে পরে জীবন রা হয় তার।
কিন্তু এরপর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি তাদের বোনের।
কল্পনাদের বাড়ি উঠানেই কথা হয় নানান বয়সী গ্রামের মানুষের সঙ্গে, এমন কি সাদা পোষাকের একজন শান্তিবাহিনীর ক্যাডারের সঙ্গেও। সেদিন কল্পনার মা বাঁধুনী চাকমার দেখা মেলেনি। তবে আরো কিছুদিন পরে বৃদ্ধা মা বারবার চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন, তার একমাত্র মেয়ে অপহরণের পর এই অপহরণকে নিয়ে হেলিকপ্টার -- রাজনীতির কথা।
পরে বাঘাইছড়ির ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, রাঙামাটি পুলিশ সুপার, সেনা কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকের ভাষ্যসহ দৈনিক আজকের কাগজে কল্পনা চাকমা অপহরণের ওপরে যে কয়েকটি প্রতিবেদন তৈরী করা হয়েছিলো, এর একটির সূচনা কথা ছিলো: রক্তের ধারা পেছনে যায় না! ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।