আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উড়ন্ত অশ্বারোহী (গল্প)

timursblog@yahoo.com

মুল: অ্যামব্রোস বিয়ার্স শরৎকাল, 1861 সাল । আমেরিকান গৃহযুদ্ধ চলছে । পশ্চিম ভার্জিনিয়ার এক বনের ধারে লরেল ঝোপে নীচে একজন সৈনিক শুয়ে ছিল । শরীরটা পুরোপুরি লম্বা করে, উপুর হয়ে শুয়েছিল সে । তার বাড়ানো ডানহাতটা আলগোছে ধরে আছে রাইফেলটা ।

কিন্তু ওর ছড়িয়ে থাকা হাত-পাগুলো আর বেল্টের পিছন দিকে আটকানো কার্তুজের বাক্সের নিয়মিত ওঠানামা দেখে বোঝা যাচ্ছিল ও আসলে মরেনি, ঘুমিয়ে আছে । পাহারা দেয়ার সময়ে ঘুমিয়ে আছে ও । ধরা পড়লে সেজন্য মৃত্যুদন্ড হতে পারে ওর । লরেলের যে ঝোপটার পাশে ও ঘুমিয়ে আছে সেটা থেকে নেমে যাওয়া ঢালটার নীচ দিয়ে একটা পথ বাঁকাভাবে চলে গেছে । সোজা পশ্চিমে শ'খানেক গজ গিয়ে উপরের দিকে উঠে আবার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা সর্পিল গতিতে চলে গেছে ওটা ।

উপরের বাঁকটার ধারেই একটা মস্ত চ্যাপ্টা পাথরের চাঁই পড়ে আছে । উত্তরের দিকে বেরিয়ে আসা ঢালটার কাঁধে পাথরটার অবস্থান । পাথরের চাঙ্গরটা থেকে একটা নুড়ি ছুঁড়ে ফেললে সেটা দু'হাজার ফিট নীচের পাইন ঢাকা উপত্যাকায় গিয়ে পড়বে । সৈনিকটা যেখানে ঘুমিয়ে আছে সেটা থেকেও অনেকদূর চোখ পড়ে । ও যদি জেগে থাকতো তাহলে হয়তো ক্লিফের দৃশ্য দেখে ওর মাথা ঘুরে উঠত ।

উত্তরের উপত্যকাটার ছাড়া চারপাশটা বনে ঢাকা । উপত্যাকার মাঝখানে একটা প্রাকৃতিক খোলা জায়গা, সেটার মধ্যে দিয়ে একটা ছোট ঝর্ণা বইছে । খোলা জায়গাটা দেখতে একটা ঘরের দরজার সমান দেখালেও আসলে সেটা আয়তনে কয়েক একর জমি । চারপাশের বনভুমি থেকে সে জায়গাটার ঘাসের রং যেন আরো বেশি সবুজ । আসলে উপত্যকাটার গঠনটাই এরকম যে কীভাবে রাস্তাটা এরকম জায়গায় ঢোকার প্রবেশাধিকার পেল সেটাই আশ্চর্যের বিষয় ।

আসলে কোন জায়গা যত বুনো আর দুর্গমই হোক মানুষ সেটাকে যুদ্ধের ময়দান বানাতে দ্বিধা করবে না । নীচের বনটা একটা মস্ত ইঁদুর ধরা ফাঁদে পরিনত হয়েছে বলা যায় । বনে ঢোকার পথে পঞ্চাশজন সৈন্য একটা পুরো বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে । সেখানে ফেডারেল বাহিনীর পাঁচটা রেজিমেন্ট মোতায়েন আছে । গতকাল সারাদিন এবং সারারাত ওরা মার্চ করে এসে এখন বিশ্রাম করছে ।

আজ রাতেই আবার পথে নামবে ওরা । ঢাল বেয়ে যেখানে এখন ঘুমন্ত প্রহরী শুয়ে আছে সেখানে উঠে আবার অপরঢালে নেমে মাঝরাতের দিকে একটা কনফেডারেট ঘাঁটিতে আকস্মিক হামলা চালানোর উদ্দেশ্য ওদের । ওদের অভিযান ব্যার্থ হলে সাংঘাতিক বিপদে পড়তে হবে ওদের । পুরো অপারেশনটাই শত্রুকে চমকে দেয়ার উপর নির্ভর করছে । লরেল ঝোপে ঘুমিয়ে থাকা অল্পবয়সী ভার্জিনিয়ান সান্ত্রীর নাম কার্টার ড্রুজ ।

স্বচ্ছল বাবা-মার একমাত্র সন্তান, পশ্চিম ভার্জিনিয়ার মত জায়গায় উচ্চবিত্তের আয়েশী জীবনে অভ্যস্ত ছিল সে । ওর বাড়ি এখান থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে । একদিন সকালে ব্রেকফাস্ট শেষে উঠে গম্ভীরভাবে বলল ও, 'বাবা, গ্রাফটন শহরে একটা ইউনিয়ন রেজিমেন্ট এসেছে । আমি ওতে নাম লেখাতে যাচ্ছি । ' লম্বা চুলওয়ালা সিংহের মত মাথাটা ওর দিকে ফেরালেন বাবা ।

এক মুহুর্ত চুপ থেকে তিনি বললেন, 'কার্টার, তোমার যা ভাল মনে হয় তুমি তাই করবে । ভার্জিনিয়ার কাছে তুমি একজন বিশ্বাসঘাতক, তোমাকে ছাড়াই চলে যাবে তার । তোমার মা, ডাক্তারের মতে খুব নাজুক অবস্থায় আছেন, এবং সম্ভবত কয়েক সপ্তাহ বাঁচবেন । তাঁকে এ কথা বলে বিরক্ত না করাই ভাল হবে বেল আমি মনে করি । ' অতএব কার্টার ড্রুজ উঠে মাথা নুইয়ে তার ছোটবেলার বাসা ছেড়ে বেরিয়ে সেনাদলে যোগ দিল ।

অধ্যাবসায় আর সাহস দেখিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ও বাহিনীতে নাম করে ফেলল । এ তল্লাটটা তার ভাল জানা আছে বলেই তাকে আজকের এই আউটপোস্ট ডিউটি তাকে দেয়া হয়েছে । সে যাই হোক, ক্লান্তির জোর দায়িত্ববোধ থেকে শক্তিশালী প্রমানিত হয়েছে, সে ঘুমিয়ে পড়েছে । কিন্তু কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে নিঃশব্দ হুঁশিয়ারি দিয়ে জাগিয়ে দিল । বাহু থেকে মাথা তুলে লরেলের গোড়ার ফাঁক দিয়ে সে চাইল সামনের দিকে ।

রাইফেলের বাঁটের উপর নিজের অজান্তেই শক্ত হল তার আঙ্গুল । তার প্রথম অনুভুতিটা ছিল শৈল্পিক আনন্দের । সোজা উপরে উঠে গেছে আকাশ ছোঁয়া ক্লিফটা । শৈলশিরাটার গায়ে ফুটে আছে একজন অশ্বারোহীর দেহরেখা । কোন পৌরাণিক গ্রীক দেবতার মত বলিষ্ঠ স্বাচ্ছন্দ্যে বসে আছে সে ।

পরনের কন ফেডারেট বাহিনীর ধুসর উর্দি আর ঘোড়ার গায়ে ধাতব বাকলস চমৎকার ভাবে মিশে গেছে সিলুয়েটে । অশ্বারোহীর ডানহাত লাগামে ধরা আর বাঁ হাতে একটা খাটো ব্যারেলের কার্বাইন ধরা । গোটা দৃশ্যটাই একটা ক্যামিও ছবির মত, আরোহীর বাঁ দিকে ফেরানো মুখে পাশ থেকে আসা আলোয়ে দাড়ি আর কপালের রেখা দেখা যাচ্ছে । লোকটা নীচের ইউনিয়ন বাহিনীর শিবির গুলো দেখছে । এক মুহুর্তের জন্য ড্রুজের মনে হল ও যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিল, এখন জেগে উঠে সে একটা অসামান্য শিল্প কর্ম দেখছে ।

অনুভুতিটা থাকল না যখন ঘোড়াটা সামান্য নড়ে উঠল, যদিও সওয়ারী একই রকম স্থির রইল জিনের উপর । রাইফেলের বাঁটটা সাবধানে গালের পাশে টেনে এনে ঝোপের মধ্যে দিয়ে ব্যারেলটা তাক করল ও । রাইফেলটা কক করে সাইটের মধ্যে দিয়ে অশ্বারোহীর বুকের উপর স্থির করল নিশানা । এবারে ট্রিগারে চাপ দিলে কাজ শেষ হয় কার্টার ড্রুজের । এমন সময়ে ঘোড়সওয়ার লোকটা ঘুরে একদম ঝোপের মধ্যে কার্টার ড্রুজের লুকানো জায়গাটার দিকে চাইল ।

ড্রুজের মনে হল লোকটা একেবারে ওর অন্তরের অন্তস্থল পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে । কেন যুদ্ধে একজন শত্রুকে হত্যা করা এত কঠিন কাজ ? একজন শত্রু যে তার রেকি করতে গিয়ে এমন গোপন খবর জেনে ফেলেছে যা জানলে পুরো বাহিনীই আক্রান্ত হবে ? হঠাৎ রক্তশুন্য হয়ে পড়ল কার্টার ড্রুজ । সে মনে মনে দেখতে পাচ্ছে তার সঙ্গী সাথীরা সব এক এক করে শুন্যে উঠে যাচ্ছে আগুন রঙা আকাশে । রাইফেলটা পড়ে গেল ওর হাত থেকে, আরেকটু হলেই জ্ঞান হারাতো কার্টার । একটু পরেই মুখ তুলে চাইল কার্টার ।

হাতে উঠে এসেছে রাইফেল । তর্জনি খুঁজে পেল ট্রিগার । শত্রুকে বন্দী করা যখন সম্ভব নয়, ওকে হুঁশিয়ার করে দিলে লোকটা পালাবে, সাথে নিয়ে যাবে তার গোপন খবর । সৈনিকের কর্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার, বহিরাগত শত্রুর স্কাউটকে দেখা মাত্র গুলি করতে হবে । অবশ্য একটা আশা আছে, ঘোড়সওয়ার লোকটা হয়তো কিছুই দেখতে পায় নি ।

ওকে শান্তিমত চলে যেতে দিলে কিছু আসে যায় না । ভেবে নীচের দিকে মাথা ঘোরাল কার্টার, ঢালের নীচের সৈন্য আর ঘোড়ার সারি চলাচল করছে । কোন এক আহাম্মক কমান্ডার দিনের আলোয় ঘোড়াকে পানি খাওয়ানোর হুকুম দিয়েছে । দৃশ্যটা আশপাশের একশোটা পাহাড়ের চুড়া থেকে দেখা যাবে ! উপত্যকা থেকে চোখে ফিরিয়ে অশ্বারোহীর দিকে চোখ ফেরাল কার্টার, এবারেই রাইফেলের সাইটের মধ্যে দিয়ে । এবারে কার্টারের নিশানা ঘোড়াটা, এমন সময় বাবার কথা মনে পড়ল তার 'যাই ঘটুক না কেন তোমার দায়িত্ব তুমি পালন করবে ।

' শান্ত বোধ করল সে কথাটা মনে করে । কার্টারের দাঁত জোড়া শক্ত হয়ে চেপে বসে আছে, স্নায়ু শিথিল । বন্ধ করে রাখা নিশ্বাস এখন নিয়মিত ছন্দে চলছে । দায়িত্ববোধ পরাস্ত করেছে বিবেককে । গুলি করল কার্টার ।

ঠিক সেই মুহুর্তে একজন ইউনিয়ন অফিসার আশপাশের এলাকা ভাল করে দেখার জন্য বেরিয়ে ছিলেন । ক্লিফের গোড়ায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে প্রায় সিকি মাইল দূরে পাইন গাছেগুলোর গোড়ার কাছ থেকে একটা খাড়া পাহাড়ের ঢাল উঠে গেছে । ক্লিফের দিকে চাইলে মাথা ঘুরে যায় উচ্চতার কারনে । সেদিকে তাকিয়ে আশ্চর্য এক দৃশ্য দেখতে পেলেন তিনি । ক্লিফের মাথার প্রান্ত থেকে একজন অশ্বারোহী আকাশে ভেসে চলেছে ! শক্ত জিনের উপর পিঠ সোজা করে ফৌজি কায়দায় বসে আছে আরোহী, লাগামটা শক্ত করে ধরা যেন এমন সাংঘাতিক একটা পথে ঘোড়াকে হুঁশিয়ারভাবে ধরে রাখতে চায় সে ।

সওয়ারীর খোলা মাথার চুল উড়ছে । ঘোড়াটা এমনভাবে চলছে যেন সমান মাটির উপর ওর চার পায়ের খুর পড়ছে, যদিও ওর পা ছোঁড়ার ভঙ্গি ছুটন্ত ঘোড়ার মতই । পাখির মত উড়ে যাচ্ছে ঘোড়াটা ! আকাশে উড়ন্ত ঘোড়াটাকে দেখে অফিসারের হাঁটু দুর্বল হয়ে ভাঁজ হয়ে গেল । প্রায় সাথে সাথেই আশপাশে কোথাও একটা কিছু ধসে পড়ার শব্দ পাওয়া গেল । কোন প্রতিধ্বনি ছাড়াই মিলিয়ে গেল শব্দটা ।

কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন অফিসার । ঘষা খাওয়া হাঁটুতে জ্বালা ধরার ব্যাথা বাস্তবে নিয়ে এল তাঁকে । জোরে হেঁটে ক্লিফের আধা মাইল দূরে গিয়ে কোন কিছু দেখতে ব্যার্থ হলেন তিনি । আরেকটু ভাল ভাবে ভাবলে বুঝতে পারতেন তিনি, শুন্যে মার্গের অশ্বারোহীর গতি আসলে ছিল নীচের দিকে । ক্লিফের গোড়ার দিকে খুঁজলেই যা খুঁজছেন পেয়ে যেতেন তিনি ।

প্রায় আধঘন্টা পরে ক্যাম্পে ফিরে আসলেন তিনি । অফিসার বুদ্ধিমান লোক ছিলেন, যা দেখেছেন সেব্যাপারে তিনি কিছুই বললেন না । কিন্তু কমান্ডার যখন জিগ্যেস করলেন স্কাউটিংএ গিয়ে কোন নতুন কিছূ জেনেছেন কি না অফিসার । 'ইয়েস স্যার । দক্ষিন দিক বের হবার কোন রাস্তা নেই ।

' কমান্ডার হাসলেন, আসলে তিনি জানেন কথা তা নয়, এ এলাকা ভাল করে জানেন তিনি । গুলি করার পর রাইফেল রিলোড করে চুপচাপ আবার পর্যবেক্ষণ চালিয়ে গেল কার্টার ড্রুজ । দশ মিনিট মত পরে একজন ইউনিয়ন বাহিনীর সার্জেন্ট সাবধানে হামাগুঁড়ি দিয়ে তার পাশে এল । কিন্তু ড্রুজ একভাবে নিঃসাড় হয়ে পড়ে রইল । 'তুমি গুলি করেছিলে?' 'হ্যাঁ ।

' 'কীসের দিকে?' 'একটা ঘোড়া । ওই পাথরটার উপর দাঁড়িয়ে ছিল ওটা । সোজা নীচে পড়ে গেছে ওটা । ' ড্রুজের মুখ রক্তশুন্য কিন্তু ভাবলেশহীণ । কথা বলে পাশ ফিরে শুয়ে থাকল সে ।

সার্জেন্ট কিছু বুঝতে পারছে না । 'দেখো ড্রুজ,' মুখ খুলল সার্জেন্ট । 'এরকম রহস্য করে কোন লাভ নেই । তুমি রিপোর্ট করে আসো ঘটনাটা । ঘোড়াটায় সওয়ারী ছিল ?' 'হ্যাঁ ।

' 'কে সে?' 'আমার বাবা । ' উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল সার্জেন্ট । 'গুড গড!' আপন মনে স্বগোতক্তি করল সে । শেষঃ ল্প

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।