যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে
ধানমন্ডি ওয়েস্টার্ন গ্রীলের পাশের পেট্রল পাম্পের ফুটপথে দাড়িয়ে হাতের তালু হলুদ করে মুড়ি খাচ্ছি। রাত তখন পোনে দশটা। সিএনজির চাপ কমে যাওয়ায় প্রাইভেট কারের লম্বা লাইন লেগেছে। আমি মুড়ি খাচ্ছি আর অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দি হ্যামলেট, হেমায়েত স্যারকে দেখে আমি চমকে উঠলাম।
তিনি রাস্তার অন্যপাশে কিছু দেখার চেষ্টা করছেন আর হাঁটছেন। 7 বছর পর দেখা। আমি মুড়ি ফেলে স্যারের সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। স্যার আমাকে দেখে, আরে, ওহ, বলতে বলতে জরিয়ে ধরলেন। তার হাতে আমার হাত।
তুমি ফয়সাল জামিল না! আমি বুঝতে পারি তিনি আমার নাম হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। মনে করিয়ে দেই ডাক নাম। সাথে সাথে অফিসিয়াল নামটাও তার মনে পড়ে গেল! আমি তাকে পেয়ে মহাখুশী। জিজ্ঞেস করলাম, স্যার কেমন আছেন, কোথায় আছেন! যতদূর জানি তার অবসর নেয়ার কথা দুইবছরের আগে। তাই বললেন, এলপিআর শেষ হলো! এখন একটা চাকরী পেয়েছে ঢাকায়।
তার সেই বিখ্যাত নাইদার আর নর দিয়ে কথা বলার অভ্যাস এখনও বহাল আছে। বুঝলে, নাইদার ইটস মাই টাইম ফর এ জব, নর ইটস মাই নেসেসারী, কিন্তু কাজ ছাড়া ভাল লাগছিল না! মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজীর হেড হিসাবে জয়েন করেছি!
স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার খবর কি! বললাম বৃত্তান্ত। শুনে খুশী। অন্যান্য ক্লাসমেটদের খবর জিজ্ঞেস করলেন, জানালাম জামিল ব্রাক ব্যাংকে, রমন পুলিশ, রুশো এডুকেশন অফিসার, সেলিম স্টামফোর্ডে, পনির একটা বিদেশী কোম্পানীতে, ইভা পনিরের বউ হয়েছে, চাকুরী করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। ঢাকায় যারা আছে তাদের এই খবর জানি, বাকীরা সব কলেজের শিক্ষক হয়েছে।
হেমায়েত হোসেন স্যার ক্লাসে আমাদের সেক্সপিয়ার পড়াতেন। হ্যামলেটের ডায়লগ এত চমৎকারভাবে বলতেন, মনে হতো পড়াশুনা শেষ করে আমিও তার মত হ্যামলেট পড়াবো। সবসময় ক্লিনশেভ, সু্যট পরিহিত হ্যামলেটস্যারকে প্রথম দেখি তার 44 বছরে বয়সে যখন সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি। আজকে 16 বছর পরে তিনি বার্ধক্যের ছায়াতলে সমস্ত স্নায়ুকে সমর্পন করে কিছুটা প্রগলভ হয়েছেন কিন্তু আমার চোখে তার সেই সৌম্যকান্ত, নির্ভিক, পরিষ্কার ঋজুবদ্ধ একটা মানুষের প্রতিচ্ছবি নাড়া দিয়ে উঠল। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি, তিনি বলেন তার দুঃখের কথা, কোন স্টুডেন্ট তার সাথে দেখা করতে আসে না যাদেরকে তিনি নিজের ছেলের মত ভালবাসতেন।
নিজের তিনটি মেয়ে, সেজন্য ছেলেদের জন্য মায়া একটু বেশী। স্যারের আপন করে নেয়া আন্তরিক গ্রহণ অনেক দিন আগের একটা ঘটনার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করলো।
তখন আমরা অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি। আমাদের ডিপার্টমেন্টের ভাইভার একটা বদনাম ছিল। যে 50 মার্ক সেখানে বরাদ্দ থাকে তার মধ্যে সবের্াচ্চ দেয়া হয় 25।
যদি 10 মার্ক বেশী দেয়া হয় তবে অনেক স্টুডেন্টের রেজালট ভাল হতে পারে। ভাইভার আগে আমরা এ নিয়ে ডিপার্টমেন্ট হেড হেমায়েত স্যারের হস্তক্ষেপ চাইলাম। এক্সটারনালদের যেভাবে পারে সে যেন ম্যানেজ করে। কিন্তু ভাইভার সময় এমন উলটা পালটা প্রশ্ন করলো যে আমাদের 15 পাওয়াই কষ্টকর হয়ে গেছে। পরীক্ষা শেষে মার্কিং এর নাম্বার একজন স্টাফ মারফত আমাদের হাতে চলে আসে।
দেখলাম হাইয়েস্ট হচ্ছে 22। মুহূর্তের মধ্যে আমরা মিছিল করলাম, হেমায়েতের চামড়া, তুলে নেব আমরা, পাড়ার কয়েকটা ফ্রেন্ড ছিল তাদের কাছে রেডিমেড বোমা থাকতো, খবর দেয়ার সাথে সাথে তারা এসে ডিপার্টমেন্টের সামনে কয়েকটা হাতবোমা মেরে পুরো ক্যাম্পাস অচল করে ফেললো। আমরা হেডের রুমে গিয়ে তার সামনে টেবিল, চেয়ার, ফার্নিচার ভাঙলাম, তারপরে তাকে তালা দিয়ে বের হয়ে আসলাম! প্রেসক্লাবে গিয়ে স্মারক লিপি, সন্ধ্যায় টাউন হলের সামনে সমাবেশ, সে এক বিশাল আন্দোলন!
মাস্টার্স পরীক্ষার সময় ভাইভায় তিনি আর সে ভুল অবশ্য করেননি। এর মাঝে তার কাছে আমরা ক্ষমা চেয়ে এসেছিলাম। আজকে প্রায় 10 বছর পরে সে ঘটনার জন্য নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।
আমার প্রিয় তিনজন শিক্ষকের মধ্যে দুইজন আগেই মারা গেছেন। স্কুলের ছিলেন তারা। বেঁচে থাকা এই প্রিয় শিক্ষকের সানি্নধ্য পাবার জন্য এখন আমি উতলা হয়ে আছি। তাকে আমার জানাতে হবে দ্যা টাইম ইজ নট আউট অফ জয়েন্ট!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।