কিছু দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে এই জীবনে। ভ্রমণ আমার ভাল লাগে্ তাই সবার মাঝে তা জানাতে চাই। সবার উপরে ভালোবাসি বাংলাদেশ । ধন্যবাদ লন্ডনে থাকাকালিন বাংগালী ব্রিটিশ এক পরিবারে বেড়াতে গিয়েছিলাম, স্বামী স্ত্রী দুজনেই আর্কিটেক্ট ভাল বেতনে চাকুরী করেন । তাঁরা দুজনেই সৌদি আরবে চাকুরী করতেন বাচ্চাদের পড়াশোনার কথা ভেবে লন্ডনে চাকুরী নিয়ে স্থায়ীভাবে থাকতে এসেছেন ।
এদেশের নাগরিক , অভিজাত এলাকায় সুন্দর একতলা বাংলো টাইপ বাড়ী । ছেলে মেয়ে দুজনেই স্কুলে পড়ে । ভাইটা বোনকে সহ্য করতে পারে না । ছেলে ইংলিশ খাবার ছাড়া অন্য কিছু খায়না । মেয়ে বাবা মায়ের পছন্দের যে কোন খাবার খাবে ও বেশ ভাল ।
ছেলেটা বড় এবং বোনের সাথে কথাও বলে না । তার জন্য একটা ইংরেজ ন্যানী রেখেছে। সে এসে তাকে খাবার রান্না করে দেয় এবং অন্যান্য জিনিষ দেখা শোনা করে। যেহেতু বাবা মা দুজনেই ভাল আয় করে ও অভিজাত এলাকায় থাকে বাচ্চাদেরকে তেমন কোন বকাবকি করাও যায় না ,এতে বাচ্চারা যদি পুলিশ কে জানিয়ে দেয় তবে বাচ্চাকে সরকারের দায়িত্বে নিয়ে যাবে । অথচ এটা যদি ইষ্ট লন্ডনের কোন গরীব পরিবারের ছেলে হতো তবে এ আচরণ হতো না।
বাধ্য হয়ে বাবা মা মেনে নিয়েছে । আমরা সবাই মিলে পাকিস্তানী রেষ্টুরেন্ট এ গেলাম । প্রায় ১ কিলোর কাছাকাছি দুরত্বে গাড়ী পার্কিং করতে হলো । হেটে এলাম সেখানে। গল্প গুজব করে নান, কাবাব ও অন্যান্য খাবার খেলাম প্রচন্ড দাম খাবারের ।
দুজনকেই দেখলাম তেমন সুখী না । অনেক অর্থ উপার্জন করছে অথচ মনে শান্তি নেই । সব পেয়েও যেন কিছুর অভাব রয়ে গেছে ।
বাংলাদেশ সেন্টারে খুব ভাল ভাবে আমার সময় কেটেছিল । বোর্ডার তেমন ছিল না ।
রুমে আমি একাই ছিলাম । সারাটা দিন বাইরে থাকতাম, টিউবে করে সারা লন্ডনের সব ষ্টেশনের আশেপাশে দেখা হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন একটা টার্গেট সেট করে বের হতাম তারপর সন্ধ্যায় সব দেখে শেষ করে রুমে ফেরা । টিউবের ৭ দিনের ৪ টা জোনের টিকেট/পাশ কেনা আছে। পাতালে নেমে কার্ড পাঞ্চ করলেই ষ্টেশন।
ট্রেনে উঠে যে কোন ষ্টেশনে নেমে যাই । পাতাল ফুড়ে উড়ে আসে পাশের এলাকা দেখে আবার পাতালে ডুব দেই। দিনগুলো ভালই কেটেছিল ।
বার্কিংহাম প্যালেস, লন্ডন
ইংল্যান্ডের রাণীর প্রাসাদ বার্কিংহাম প্যালেস দেখার সখ । এক সময় এরা আমাদের দেশ শাসন করত ।
কথায় বলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে তখন নাকি কখনো সূর্য অস্ত যেত না । এখন ঠিক তার উল্টা। গত কদিন আকাশ মেঘলা থাকায় লন্ডনে সূর্যের চেহারাই দেখা যায়নি । ভিক্টোরিয়া মেট্রো ষ্টেশন থেকে বের হয়ে কিছু দুর হেঁটে গেলেই বার্কিংহাম প্যালেস এলাকা , ব্রিটিশ স্থাপত্যের সুদৃশ্য প্রাসাদ । অনেক পর্যটক আমার মত ব্রিটিশ রাণীর প্রাসাদ দেখতে এসেছে।
বিশাল লোহার গেট মাঝে তাদের চিহ্ন সোনালী রং করা । প্রাসাদে প্রহরী পরিবর্তনের জন্য একটা প্যারেড হয়, এটা বেশ আকর্ষণীয়। ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক চলছেই । সুন্দর সুন্দর ষ্টাচুর পাশে খোলামেলা জায়গা মানুষের ভীড়, অনেক দিনের সখ পুরন হলো । বেশ কিছুক্ষণ আশে পাশের এলাকায় ঘোরাফেরা করে ছবি তুললাম ।
এই প্রাসাদে বসবাসরত সম্রাট/সম্রাজ্ঞীরা দুইশত বৎসর ভারত শাসন করেছে । ভাবতে অবাক লাগে । গার্ড পরিবর্তনের যে আনুষ্ঠানিকতা তা দেখার মত । পরে দেখলাম এত জটলা সেই গার্ড পরিবর্তন অনুষ্ঠান দেখার জন্য । বার্কিংহাম প্রাসাদ এর ইতিহাস অনেক পুরানো ।
এটা ১৭০৩ সালে ডিউক অব বার্কিংহামের জন্য নির্মান করা হয়েছিল । পরবর্তীতে রাজা তৃতীয় জর্জ এটা তার রাণী ক্যারোলিন এর জন্য কিনে নেন । ১৮২০ সালে রাজা চতুর্থ জর্জ জন নাসকে একটা রাষ্ট্রীয় প্রাসাদ নির্মাণ করতে বলেন । বর্তমানের যে স্থাপত্য কলা ও অলকংরণ দেখা যায় তা তখনই রূপায়িত হয়েছিল । ১৮৩৭ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া প্রথম কোন রাণী হিসেবে এখানে বসবাস শুরু করেন এবং এটা সেই সময় থেকে রাজ পরিবারের লন্ডনের বাসস্থান হিসেবে পরিচিতি পায়।
রাণী প্রাসাদে অবস্থানকালীন সময়ে ইউনিয়ন জ্যাক উড়ে।
বার্কিংহাম প্যালেস, লন্ডন
আগষ্ট ও সেপ্টে¤¦রে কিছু সময়ের জন্য এই প্রাসাদের কিছু কিছু অংশ মূল্যের বিনিময়ে জনগনের জন্য উম্মুক্ত করা হয় । প্রতিদিন বেলা ১১-৩০ মিনিটে গার্ড পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিকতা হয় । এই বর্ণীল আনুষ্ঠানিকতায় ফুট গার্ডরা বিভিন্ন ধরনের মনোরম কসরৎ প্রদর্শন করে । এরা মূলত রাণীর ব্যক্তিগত প্রহরী, এরা সেনাবাহিনীর হাউসহোল্ড ডিভিশনের সদস্য ।
কর্তব্যরত গার্ডরা কর্তব্য শেষে যাওয়ার আগে প্রাসাদের সামনের কোর্ট ইয়ার্ড এ সমবেত হয় এবং নতুন কর্তব্যে আগমন কারী গার্ডদেরকে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয় । সাধারনত গার্ড বাহিনীতে তিন জন অফিসার ও চল্লিশ জন গার্ড থাকে । রাণী প্রাসাদে না থাকলে সংখ্যা কিছুটা কমে যায় । সবচেয়ে বর্ণিল অনুষ্ঠান এর নাম 'ট্রুপিং দি কালার' এটা রাণীর অফিসিয়াল বার্থডে প্যারেড । রাণী গার্ড পরিদর্শন করেন ও অভিবাদন গ্রহন করেন ।
এটা বছরে একবার হয় এবং বহু লোকজন এটা দেখতে আসে।
বিগবেন, লন্ডন
এরপর বিগবেন, ব্রটিশ পার্লামেন্ট ও ১০ নং ডাইনিং ষ্ট্রীট এর কাছে বেড়ানোর পরিকল্পনা করলাম । বিগবেন ও পার্লামেন্ট ভবনের কাছে এসে সেই ছোট বেলায় শোনা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম ।
ইউ কে পার্লামেন্ট, লন্ডন
আমি একা তাই ছবি তোলার লোক পাচ্ছিলাম না । হঠাৎ করে এক জাপানী ভদ্রলোক হাসিমুখে এসে তাঁর ছোট্ট ভিডিও ক্যামেরাটা দিয়ে আমাকে ছবি তুলে দিতে বললেন।
আমি তুলে দিলাম ,বিনিময়ে তিনিও আমাকে আমার মিনোল্টা ক্যামেরাতে ছবি তুলে দিলেন । কথা হলো ভদ্রলোকের সাথে। আমাকে তাঁর কার্ড দিলেন। তিনি জাপানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বেশ বয়স্ক তবে বুঝা যায় না।
তাঁর স্ত্রী প্রয়াত তাই একাই এসেছেন ইংল্যান্ড সফরে । আমাদের দেশের পর্যটক তেমন নেই ।
টেমস নদীর উপর ব্রিজ, লন্ডন ব্রিজ
লন্ডনে থাকাকালীন টেমস্্ নদীর উপর সেই বিখ্যাত ব্রিজ দেখলাম জাহাজ এর নীচে দিয়ে যাওয়ার সময় ব্রিজটার দুই পার্শ্ব সরে যায় এবং জাহাজ চলে গেলে আবার আগের মত রাস্তা হয়ে যায় ও গাড়ী চলাচল করে । এখন অবশ্য এর নীচ দিয়ে তেমন জাহাজ চলে না । একটা জাহাজ টেমস নদীর উপর মিউজিয়াম হিসেবে রাখা আছে ।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের জাহাজ , এর পাশেই টাওয়ার অব লন্ডন নামে একটা প্রাসাদ । এখানে টিকেট করে ভেতরে যেতে হয় । আগেকার দিনের বন্দীদের নির্যাতনের জন্য এটা কুখ্যাত ছিল । একসময় সাধারণ জনতা এখানে আসতে ভয় পেত ।
প্রতিদিন যে কোন একটা জায়গায় যাওয়ার প্লান করে ম্যাপ দেখে সেখানে চলে যেতাম ।
টিকেট তো কোন সমস্যাই না। ৭ দিনের ট্রাভেল পাশ আছে সাথে। ইষ্ট লন্ডন বাংলাদেশীদের আস্তানা। ঠিক করলাম একদিন সেখানে গিয়ে তাদের অবস্থা দেখে আসব। পাতাল রেলে করে ঠিকই হাজির হয়ে গেলাম ইষ্ট লন্ডনে।
লন্ডনের অন্যান্য জায়গা যেমন রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় এ জায়গাটা মনে হলো তার উল্টো। তবে এসব এলাকায় বাংলাদেশী বা ইন্ডিয়ান হোটেল গুলো বেশ বিখ্যাত । এখানে বিদেশীরা তাদের স্বাদ পরিবর্তনের জন্য আসে। ঘুরে ঘুরে মানুষের জীবন যাত্রা দেখাই ঠিক করলাম। ২/৩ টা বাংলাদেশীদের দোকানে গেলাম, সবাই প্রায় সিলেটি ,সিলেটি ভাষায় কথা বলে বাংলা বুঝে ইংরেজীতে উত্তর দেয় আমি নন সিলেটি বলে।
দেখে কষ্টই লাগল । সাধারণ ছোট দোকান, পরিবেশ তেমন সুন্দর না । বেঁচে আছে প্রবাসে । অথচ দেশে এরা লন্ডনী। না জানি কত আনন্দ করে ।
হোয়াইট চ্যাপেল ও অন্যান্য বাংগালী এলাকায় ৪/৫ টা ষ্টেশনে গিয়ে উপরে উঠে আশেপাশের এলাকা দেখে আবার ফিরে এলাম রুমে । দ্বিতীয়বার আর যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি । বাংলাদেশ সেন্টারে হঠাৎ ২ টি ছেলের সাথে দেখা হলো নাম জিজ্ঞাসা করায় ইংরেজীতে তার নাম বলল । বাংলা বলতে লজ্জা পায় কারন এখানে জন্ম ও বেড়ে উঠা। তাই সিলেটি ভাষায় কথা বলে বাংলাতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না।
বাংলাদেশীদের পরবর্তী জেনারেশন আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগছে । খুব কমই পড়াশোনায় ভাল করতে পারছে। এটা সত্যই দুঃখজনক।
সেন্ট্রাল লন্ডনের এজওয়ার রোডের একটা হোটেলে থেকেছিলাম কয়েক দিন । হোটেলের রুমটায় একটা খাট রাখার ব্যবস্থা আছে ।
সেন্ট্রাল হিটিং উপরে একটা টিভি । চাপাচাপি করে বানানো এই হোটেল ভাড়া প্রায় ৫০ পাউন্ড এর মত। থাকা বেশ ব্যয়বহুল বেড এন্ড ব্রেকফাষ্ট অর্থাৎ সকাল এর নাস্তার বিল এর সাথে সংযুক্ত । হোটেলে সকালে সেলফ সার্ভিস না¯তা । এখানে মঙ্গোলিয়ান মেয়ে নাওমীর সাথে দেখা।
এ লেভেলে পড়ছে । পড়ার ফাঁকে ফাঁকে হোটেলে কাজ করে । কেমন লাগে জিজ্ঞাসা করায় বলল ভাল। পারিবারিক অবস্থা বেশ সচ্ছল। এখানে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে যাবে ।
বেশ হাসিখুশী। হোটেল রিসিপশনেও যারা বসে আছে তারা ভাল, তবে ব্যবহারটা কেমন যেন মেকী মনে হয় ।
হোটেলে সেট হয়ে খেতে বের হলাম। রাস্তায় জমে যাওয়া পানি দেখে মন খারাপ লাগল , কেএফসিতে ডিনারে গেলাম । প্রচন্ড ভীড় অনেক মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে , এক কর্ণারে গিয়ে আস্তে আস্তে ডিনার শেষ করলাম ।
তারপর আশে পাশের এলাকা ঘুরলাম। দোকান পাট কিছু কিছু খোলা আছে। একটা ছোট ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোরে ঢুকলাম । জিনিষ পত্র দেখছি হঠাৎ দেখি বাংলা কথা বলছে কয়েকজন ছেলে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি জেনে খুশী হলো ।
এরা সবাই ভাল ফ্যামিলির ছেলে এখানে পড়তে এসেছে । এখন কাজ করে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে, বেশ কষ্ট হচ্ছে। এখানে এরা সন্ধ্যার সময় এসে কাজ করে, দোকান গুছিয়ে দিয়ে যায় । একটা ইহুদীর দোকান এটা । কাজের বিনিময়ে ভাল মূল্য দেয় ও তার দোকান থেকে এরা যদি কিছু কেনে তবে দশ ভাগ ডিসকাউন্ট পায় এরা।
তাদের এই সুবিধা দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগল । কিছু চকলেট কিনলাম তাদের ডিসকাউন্ট সুবিধা নিয়ে। বলল না জানিয়ে কোন কিছু যেন এখান থেকে না কিনি। সন্ধ্যায় ওরা থাকলে আমরা যেন জিনিষপত্র কিনি। দেশে ফেরার সময় সবাই মিলে চকলেট এর একটা প্যাকেট দিয়েছিল ওরা , কোন দাম নেয়নি অনেক সেধেছিলাম।
লন্ডনে এসে একটা ব্রিটিশ হোটেলে ইংলিশ খাবার খেতে এলাম । ব্রিটিশ ট্রাডিশন মেনে খাবার দিল। ভালই লাগল। দেশী খাবার এখন পৃথিবীর সব জায়গায় পাওয়া যায় বলে বিদেশী খাবার খেতে হয় না বাংগালীদেরকে। তবে নতুন দেশে এলে সে দেশের খাবারের স¦াদ চেখে দেখা দরকার ।
রাতের বেলা একটা ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে গেলাম। মালিক বাংলাদেশী এখানে ওয়েটার কয়েকজন আমাদের দেশী । একজন দেখলাম শুকনো ও বয়ষ্ক প্রায় ২০ বছর ধরে লন্ডনে আছে । অর্কিটেক্ট পড়াকালীন এখানে চলে এসেছে। দেশে বউ ও মেয়ে আছে, ২০ বছর দেখা নেই ।
যেতে পারে না । টাকা পাঠায় । এখানে সুবিধা করতে পারছে না । একটা কোর্স শেষে অন্য কোর্সে ভর্তি হয় এভাবে লন্ডনে দুঃসহ জীবন যাপন করছে। খুব খারাপ লাগল শুনে ।
বিদেশ নামের সোনার হরিণ কত জীবনকে যে গ্রাস করেছে তার খবর কে রাখে।
লন্ডনে আমাদের এক ভাই এর বাসায় যাব । ১০ টার দিকে ভাই গাড়ী নিয়ে এলেন । এই রাস্তায় উনি আগে কখনো আসেননি। প্রায় দেড় ঘন্টার মত লাগল ভাই এর বাসায় যেতে।
রাস্তা ঘাট পরিচ্ছন্ন। সকাল বেলা রোড ফাঁকা ছিল । আমরা আসতে আসতেই বৃষ্টি, ঝুম বৃষ্টি হলো কিছুক্ষণ । বাসা থেকে আধা মাইলের মধ্যে একটা টিউব ষ্টেশনও আছে তবে তাতে কম যাত্রী চলাচল করে বলে সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায় । বাসাটা বেশ সুন্দর, আশে পাশে সব ডুপ্লেক্স বাড়ী, ভাল এলাকা ।
এন্ট্রিতে ছোট্ট একটু প্যাসেজ এখানে সবাই জুতা ও বাইরের কাপড় চোপড় খুলে ক্লিন হয়ে ঘরে ঢুকে । ঘর ময়লা হলে মেইনটিন করা কষ্ট বলে সবাই এখানে যতটা সম্ভব গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করে। ওদের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটা ছোট । ভাই মোটামুটি ভাল অবস্থানে আছে ।
ভাবীরা আগেই এখানকার নাগরিক, এখন ভাইও একজন ব্রিটিশ নাগরিক। নিজের বাড়ী নীচের তলায় লিভিং রুম , সিড়ি ও ডাইনিং রুম। ভাবীর বাসার পিছনে এক চিলতে জায়গা। এখানে বিভিন্ন রকম শাক সব্জীর চাষ হয় । কাঁচা মরিচ, টমাটো দেখলাম সুন্দর ভাবে গাছে ফলন্ত।
ভাই-ভাবীর সংগে কিছুক্ষণ গল্প হলো ভাবী অনেক আন্তরিক আমাদের জন্য অনেক রান্না বান্না করেছেন, মজা করে খেলাম । বিকেলে কিছুক্ষণ রেষ্ট নিয়ে আমরা বের হলাম । ভাই আমাদের টাওয়ার ব্রিজ ও লন্ডনের বড় নাগর দোলার পাশ দিয়ে নিয়ে গেলেন ও আশে পাশের এলাকা ঘুরে দেখালেন ।
লন্ডনে থাকা কালীন পিকাডলী সার্কাস এলাকায় গেলাম । এখানে মেট্রো ষ্টেশন বহু নীচে ।
এক্সেলেটরে ২/৩ বার করে নীচে নামতে হয়। এখান থেকে ট্রেন গুলো টেমস নদীর নীচে দিয়ে যায় । প্লাট ফর্ম অনেক নীচে। কৃত্রিম ভাবে বাতাস সরবরাহ করা হয় এইসব ষ্টেশনে । ষ্টেশনের বাইরে সুন্দর মুর্তি ও ফোয়ারা পর্যটক ও জনগন বসে গল্প করছে ।
আশেপাশে অনেক বার ও ডিসকো আছে । সেখানে যাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই । ঘুরে ফিরে চলে এলাম । হ্যারডস ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোরের নাম শুনেছিলাম, লন্ডনে এসে তাই সেটা ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করল । যেই কথা সেই কাজ, রওয়ানা হলাম ।
বেশ সুন্দর ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর, ট্রাডিশনাল স্থাপনা, সব কিছুতেই হ্যারডস্্ এর ছাপ । ষ্টোরে ঢুকলাম, থরে থরে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সুগন্ধি সাজানো আছে । যে কেউ ইচ্ছে করলে স্প্রে করে গন্ধ দেখে নিতে পারে । শত শত রকমের স্প্রে করে সুগন্ধীতে গোসল করে বেরিয়ে আসতে পারে । এগুলো হলো টেষ্টার, কোনটা পছন্দ হলে তবেই দাম পুষিয়ে কিনে নিতে হয় ।
হ্যারডস্্ এ বাইরের চেয়ে যে কোন জিনিষের দাম ৫/১০ গুন বেশী । ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন অংশ দেখছিলাম শেষে ফেরার পথে একটা কেক কিনলাম । সুন্দর ভাবে প্লাষ্টিক এর মোড়ক জাত একটা সীল লাগানো আছে হ্যারডস এর। দেখতেই অভিজাত লাগে । সখ ছিল দেখে এলাম ।
আমাদের দেশে তখন মার্কস এন্ড স্পেনসর এর কাপড় চোপড়ের বেশ সুনাম ছিল । লন্ডনে তাই মার্কস এন্ড স্পেন্সর এর দোকানে গেলাম । তিন তলা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর । বাচ্চাদের, মহিলাদের ও পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা সেকশন, স্যুট দেখলাম বেশ সুন্দর, ক্লিয়ারিং সেল চলছিল । সি এন্ড এ নামেরও এমনি একটি ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর আছে ।
এখানেও কাপড় চোপড় পাওয়া যায় । ছোট খাট ২/১ টা জিনিষ কিনলাম । আমাদের দেশে জামাকাপড় অনেক সস্তা । তারপরও লন্ডন থেকে কেনা কাটি করা এই যা । আমাদের দেশের লোকজনকে দেখলাম বেড়াতে এসে এসব দোকান থেকে স্যুট শার্ট ইত্যাদি কিনছে।
ন্যাচারাল হিষ্টোরী মিউজিয়াম, সাউথ কেনসিংটন
ন্যাচারাল হিষ্টোরী মিউজিয়াম সাউথ কেনসিংটনে ক্রোমওয়েল রোডে অবস্থিত বিশাল বিল্ডিং । অনেকগুলো সিড়ির ধাপ পেরিয়ে এন্ট্রিতে যেতে হয় । সপ্তাহে প্রায় সবদিনই এটা খোলা থাকে । ১৮৮১ সালে এটা জনগনের জন্য চালু হয় । এটা দেখতে অনেকটা সুন্দর ক্যাথেড্রাল এর মত ।
প্রাচীন কালের পৃথিবীর অবস্থা, জীবজন্তু প্রাণীদের ডিসপ্লে রয়েছে। ভুমিকম্প, অগ্নুৎপাত ইত্যাদি সিমুলেশন এর মাধ্যমে দেখানো হয়েছে । পুরো মিউজিয়ামটা অনেক ভাগে বিভক্ত । ডাইনোসর এর জন্য একটা গ্যালারী আছে। ছবি এবং মানব দেহের কংকাল এর বিশাল গ্যালারী আছে ।
মোটামুটি একবার ঘুরে আসলে পৃথিবী ও প্রকৃতি স¤¦ন্ধে বাস্তব জ্ঞান লাভ করা যায় । ঘুরতে গেলেও ভাল করে দেখতে হলে সারাদিনই চলে যাবে। ঘুরতে ঘুরতে টায়ার্ড হবার জোগাড়। দুই/তিন ঘন্টা ঘুরে টায়ার্ড হয়ে ফিরে এলাম গেইটে। বাইরের বাতাস নিলাম ।
লন্ডনে সানডে মার্কেট বলে একটা বাজার বসে। লোকজন বাসায় বানানো খাবার দাবার ,হাতের কাজের জিনিষ পত্র এখানে এনে বিক্রি করে। বাসার গ্যারেজে বা কোন খোলা জায়গায় ছাতার নীচে অথবা যে কোন ধরনের টেম্পোরারি তাবুর ব্যবস্থা করে পশরা সাজিয়ে বসে । বহু লোকজন এখানে কেনাকাটা করতে আসে। পর্যটকদের জন্য আরেকটা ভাল ব্যবস্থা এখানে দেখলাম বিবি বা বেড এন্ড ব্রেকফাষ্ট ।
লোকজন নিজের বাসার অব্যবহৃত রুমটা এক রাতের জন্য পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেয় । সাথে সকালের নাস্তাও বানিয়ে খাওয়ায় । যে কেউ লন্ডনে এসে হোটেলে না থেকে পারিবারিক আতিথেয়তায় সময় কাটাতে পারে স্বল্প খরচের বিনিময়ে। অনেক জায়গায় এ রকম হাতে লিখা কিংবা বানানো বোর্ডে এই কথা লিখা আছে দেখা যায় । সেপ্টেম্বর -অক্টোবর মাসে লন্ডনের শীত তেমন তীব্র না।
বৃষ্টিও হতো মাঝে মাঝে, বাতাস বেশ ঠান্ডা তাপমাত্রা ৭-৯ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড, আমাদের দেশের তুলনায় বেশ ঠান্ডা, তাই জ্যাকেট পরেই থাকতে হতো।
লন্ডনের আরেকটা সমস্যা হলো ট্রাফিকজ্যাম , সেন্ট্রাল লন্ডন থেকে হিথরো এয়ার পোর্ট যেতে টেক্সিতে করে প্রায় ২ থেকে আড়াই ঘন্টা লেগে যায় জ্যামের কারনে অথচ পাতাল রেলে ট্রেন চেইঞ্জ করে হিথরোর ৪ টা টার্মিনালের মধ্যে যে কোন টাতে যেতে ৪০ মিনিটের মত সময় লাগে এবং ভ্রমণও বেশ আরামদায়ক । পাতাল রেলের বগিগুলো বেশ সুন্দর, বসার জন্য সিট আছে। দাড়িয়ে থাকার জন্য হাতল ও ধরে রাখার সাপোর্ট দেয়া আছে । ষ্টেশনে ট্রেন আসলে দুম করে দরজা খুলে যায় ।
প্রথমে লোকজন নামে তারপর উঠে। রেকর্ড করা ওয়ার্নিং বাজে যে দরজা থেকে দুরে থাকুন দরজা বন্ধ হবে । এরপর দুম করে দরজা বন্ধ হয়ে যায় । ট্রেনে পরবর্তী ষ্টেশনের কথা ঘোষণা করে । এছাড়া বগিতে ট্রেন লাইন ও ষ্টেশন এর ম্যাপ আছে ।
কোন ষ্টেশনে অন্য লাইনের ট্রেন পাওয়া যাবে তাও রং এর মাধ্যমে বোঝানো আছে । সেন্ট্রাল, সার্কেল, পিকাডেলী, হ্যামার স্মীথ এন্ড সিটি ইত্যাদি আরো অনেক লাইন কালার কোড এর মাধ্যমে বোঝানো আছে । যে কেউ তা বুঝতে পারবে এত সহজ ।
লন্ডনের দিন গুলো শেষ হয়ে আসছিল আমিও মোটামুটি ঘোরাফেরা করে বেশ তৃপ্ত। খাওয়া দাওয়া , বেড়ানো থাকা সব কিছুই বেশ সুন্দর ভাবেই হচ্ছিল ।
যথা সময়ে বিদায়ের পালা, মালপত্র নিয়ে পাতাল রেলে হিথ্রো এয়ারপোর্ট চলে এলাম । টার্মিনাল চার থেকে বিমান এর ফ্লাইট উড়াল দেয় । চেক ইন করলাম, তেমন কোন সমস্যা হলো না । তবে ব্যাগটা তারা পুরোপুরি খুলে চেক করল । যথারীতি সব কাজকর্ম শেষ করে অপেক্ষার পালা।
আমি ফিরছি আমার স¦দেশে, প্রিয় দেশে, হোকনা তা প্রথম বিশ্বের কোন দেশ নয় । ওটাই আমার দেশ বিমানে উঠে মনে হলো দেশে এসে পড়েছি । “আকাশে শান্তির নীড়” সত্যিই বেশ ভাল লাগল ।
স্মৃতিতে রংগীন হয়ে থাকল ইংল্যান্ডের কয়েকটা দিন ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।