খুব গোলমেলে, নিজেও ভাল জানি না। তবে আছে,এই ঢের।
জানি চলে যতে হবে, তবু কোন কোন জায়গা ছেড়ে যেতে বড় কষ্ট হয় আমার । আব্বার ছিল বদলির চাকরি,আমি প্রাইমারি স্কুল ছেড়ে সবে হাইস্কুলে গেছি তখনই আব্বার বদলি হল। আব্বা প্রথমে একলা গিয়ে সেখানে জয়েন করে বাসা ঠিক করে দিন পনের পর আমাদের নিতে এলো।
হাতে তিনদিন সময় । এই তিনদিনে জিনিস পত্র বাক্সবন্দী করা, ইশকুলে গিয়ে বদলীর সার্টিফিকেট আনা ও আরো সমস্ত কাজ গুছিয়ে এখানকার পাট চুকিয়ে অন্য জায়গায় যাওয়া । বাড়িতে কেউ কথা বলে না। কারোরই ইচ্ছে নয় এখান থেকে যায় কিন্তু আব্বার চাকরী । তাই যেতেই হবে।
সবাই ব্যস্ত জিনিসপত্র গোছাতে, বাঁধা-ছাদা করতে আমিই শুধু ঘুরে বেড়াই এঘর ওঘর । বারান্দায়, বাগানে, আমার ঐ ছোট্ট মাঠে, কদমতলায় । আমি এখন আর চেঁচিয়ে কাঁদি না, শুধু চোখ দিয়ে জল গড়ায় । সামনের ঐ টিলার উপর চোখ পড়ে যেখানে মাঝে মাঝেই চলে যেতাম প্রজাপতি কিংবা সবুজ ঘাসফড়িং ধরে আনতে। বুকের ভিতরে কিছু একটা হতে থাকে, বুঝতে পারি না ।
আসলে বুঝি নিজের বলে কিছু থাকতে নেই এই পৃথিবীতে । বড় হওয়ার সাথে সাথে কমতে থাকে মোহ । এই যে আমি রোজ এই রাস্তায় বাড়ি ফিরি । এখান থেকেই বাস ধরি । একটা কদমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকি! আর আজ প্রথম চোখে পড়ল! ঠিক এই জায়গাতেই তো দাঁড়াই ।
সি টি সি'র বাসগুলো ষ্টপ থেকে বেশ অনেকটা এগিয়ে এইখানটাতেই তো এসে দাঁড়ায় । অথচ কোনদিন চোখে পড়ল না এই কদমগাছ? বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে শুধু বাসই দেখি? রাস্তায় চোখ রেখে অপেক্ষায় থাকি টি -2র কিংবা কোন শেয়ারের ট্যাক্সির । বাসগুলো আসছে। আমতা, বাগনান, আলমপুর, সাঁত্রাগাছি, গাদিয়াড়া । প্রতিটা বাসের গায়ে লেখা আছে সে কোথায় যাবে তবুও হেঁকে হেঁকে যাত্রী তুলছে আর বেরিয়ে যাচ্ছে হুঁশ করে।
আমার বাস আসে না। আমি কদমগাছের দিকে মন দেই। এখানে যে একটা কদমগাছ দাঁড়িয়ে থাকবে সেটা কল্পনায়ও ছিল না। কিন্তু কেন ছিল না? থাকতেই তো পারে একটা কদমগাছ ! আমি দেখি না বলে কোন কদমগাছ নেই এশহরে এমনটা তো হতে পারে না! আমি কি এখনও সেই ছোট্টটি রয়ে গেলাম? আমি চোখ বন্ধ করলেই রাত ? এই গাছটা কি রকম যেন এক অদ্ভুত আকৃতির । যেন আধখানা চাঁদ কিংবা আধখানা তরমুজ ।
আমি জ্বরের ঘোরে দেখতে থাকি সেই গাছ আর তাসের মত ছড়িয়ে থাকা পাতা । টের পাই আমার পাশের অপেক্ষামাণ যাত্রীরা দু-একজন করে কমে যাচ্ছেন তাদের প্রার্থিত যান পেয়ে । না কি আমি টের পাই না । মনে হয় আমি একলাটি দাঁড়িয়ে ছিলাম এইখানে কদম গাছটার সাথে । কিন্তু এটাও ঠিক আমি দাঁড়িয়ে নেই এখানে , ছুটে যাচ্ছি এদিক-সেদিক।
কই কেউ মানাও তো করছে না আমায় ।
এলাটিং বেলাটিং সই লো।
। কি খবর আইলো?
রাজায় একটা মাইয়া চাইলো ।
কোন মাইয়া চাইলো?
আমি মাঝে মাঝেই দরগাহে চলে যাই।
একা একা। দরগায় যাওয়ার রাস্তার দুপাশে সব দোকান যাতে ময়দার হালুয়া বিক্রী হয় । বড় গামলায় উঁচু ঢিবির মত করে হালুয়া রেখে তার উপরে কিশমিশ বাদাম ছড়িয়ে রাখে দোকানি । অন্যান্য আরও সব জিনিসের সাথে দোকানগুলোতে থাকে মোমবাতি আগরবাতি । যারাই দরগায় যায় সেই আগরবাতি মোমবাতি কিনে নেয় ঐসব দোকানগুলো থেকে।
মসজিদ, দরগায় ফটফটে বিজলী বাতি কিন্তু তবুও লোকে কেন মোমবাতি কেনে ? আমি ভেবে পাই না । আমি যখনই দরগায় যাই রাস্তার পাশের দোকান থেকে হালুয়া কিনে খেতে খেতে যাই । পৃথিবীর সবচাইতে সেরা ময়দার হালুয়া বানায় দরগাহের সামনের ঐ দোনাকিরা! শুনেছি ওখানে এক ফকিরের ক্কবর আছে কিন্তু আমি কোনদিন সেই ক্কবর দেখিনি কারণ মেয়েদেরকে নাকি ক্কবরস্থানে যেতে নেই । ঐ চত্ত্বরে বেশ বড় এক মসজিদ আছে আর ঠিক তার পাশেই আছে ছোট্ট একটা ঘর । মেয়েদের নামাজ পড়বার জায়গা ঐ ঘরে।
আম্মা , ছোটো ফুপুরা দরগায় এলে বিকেলে আসে আর বিকেলের নামাজ ঐ ছোট ঘরে গিয়ে পড়ে। খানিক এগিয়ে গিয়ে এক বিশাল পুকুর আর সেই পুকুরে গিজগিজ করছে বিশাল সব গজাল মাছ। অগুন্তি মাছ। পুকুরের পাশেই ছোট ছোট একচালা ঘরে বিক্রী হয় কুঁচো মাছ । পঁচিশ পয়সা, পঞ্চাশ পয়সা আর একটাকার সব টুকরি ।
সবচাইতে ছোট টুকরি টা পঁচিশ পয়সার আর বড় টুকরিটা একটাকার। মাছেদেরকে মাছ খাইয়ে সেই টুকরি ফেরত দিতে হয় । সেই টুকরিতে আবার মাছ ভরে হাঁক দেয় দোকানি । যারাই এই দরগায় আসে এখানে এসে এই কুঁচো মাছ কিনে পুকুরের গজাল মাছেদের খাইয়ে যায় । আমার খুব ভাল লাগে মাছেদের খাওয়াতে ।
আমি একটা ছোট টুকরি কিনে একটা একটা করে মাছ খেতে দি ঐ বড় মাছেদের । পুকুরের চারটি পারই বাঁধানো একপাশে শুধু চওড়া সিঁড়ি যেখানে বসে নামাজীরা ওজু করে । ঐ সিঁড়িতেও মাছেরা থাকে । জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়ালে পায়ে এসে ঠুকরে দেয় । এই গজাল মাছগুলো মানুষকে ভয় পায় না ।
দরগায় সারাক্ষণ মানুষের যেন মেলা লেগে আছে । পূর্বদিকে আছে এক দেওয়ালবিহিন ঘর । থামের উপর ছাদ দেওয়া সেই ঘরে বসানো আছে বিশাল বিশাল তামার ডেগ আর সেই ডেগগুলির মুখ ঢাকা থাকে সরু তারের জাল দিয়ে। এমনভাবে আটকানো সেই জাল যে কেউ খুলতে পারবে না । দরগার যারা আসে তারা সব এই ডেগে টাকা দিয়ে যায় ।
এক টাকা দুটাকা পাঁচ টাকা দশ টাকা একশ টাকা । কেউ বা দু-তিন খানা করে নোট দিয়ে যায়। সারা বছর এই ডেগে টাকা জমা হয় । বছরে একবার এখানে ওরশ হয় । ফকিরের মৃত্যু দিবসে।
তখন এই ডেগের ঢাকনা খোলেন মোতয়াল্লি সাহেব । মোতয়াল্লি সাহেবই দরগার সবকিছু দেখাশোনা করেন । এই ডেগের জমা টাকায় আসে গরু, চাল আর মশলাপাতি। ভক্তরাও ওরশে গরু দেয় । সেই সব গরুর শিং সহ গলায় জড়ানো থাকে সোনালী-রূপোলী জরির মালা ।
সেই গরুর গলায় বাঁধা দড়িটি ধরে থাকে ফকিরের ভক্ত । পেছন পেছন আসে ছেলের দল। যারা ওরশের দুই দিন দরগাতেই থাকবে । ওরশে যে আখনি রান্না হয় তাতে গরুর মাথা দেওয়া হয় না । কেন কে জানে ।
সেই মাথাগুলো কসাইরা দরগার বাইরে এনে বিক্রী করে দেয় আর সেই মাথা কেনার জন্যে মানুষের সে কি কাড়াকাড়ি । কিনেই আনা হচ্ছে কিন্তু তবুও গরুর মাথা তো ওরশের!
সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরতে দেরি করতাম বলে রোজ মায়ের হাতে বকুনি আর মাঝে সাঝেই পিটুনি অবধারিত । আর বাড়ি ফিরতে দেরি তো রোজই হয় । মাঠে খেলতে গেলে দেরি । রিনিদের পুকুরে সাঁতার কাটতে গেলে দেরি ।
রিনি আমার স্কুলের বন্ধু । রিনিদের বাড়িটা আমাদের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয় পেছনের দেওয়াল টপকালেই ওপাশে রিনিদের বাড়ি । দেওয়ালের ঠিক ওপাশেই পুকুর আর তারপর খানিকটা জঙ্গলমত জায়গা পেরোলে রিনিদের বাড়ি । কিন্তু সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে গেলে বেশ অনেকটা পথ হেঁটে বড় রাস্তা পার হয়ে তবে রিনিদের বাড়ি । একেবারে আমাদের স্কুলের উলটোদিকে ।
সামনের মাঠ পেরিয়ে কদমতলা দিয়েও ওদের বাড়ি যাওয়া যায় কিন্তু ওদিকটা একদম জঙ্গল হয়ে আছে কেউ চলাফেরা করে না বলে । রিনি আমার থেকে মাথায় বেশ খানিকটা বড় । ক্লাসে সে আমার পাশে বসে,ও এই ক্লাসে দুবছর আছে। রোজ বকুনি খায় আপাদের কাছ থেকে কিন্তু তাও পড়ার বই সামনে খুলে রেখে যত রাজ্যের গল্প মিশুর সাথে। মিশু আর রিনিদের বাড়ি পাশাপাশি আর ওদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে বেশ একটু দূরে ।
রিনি আর মিশু দুজনে খুব বন্ধু । মিশুর মেয়ে পুতুলের বিয়ে হয়েছে রিনির ছেলে পুতুলের সঙ্গে। রিনি এখন আমার ছেলে পুতুল চাইছে ওর মেয়ে পুতুলকে বিয়ে দেবে বলে আমি তাই সেটা নিয়ে একটু ভাবনা চিন্তা করছিলাম। বিয়ে দেব বললেই তো আঅর হয় না । দাওয়াত্ করতে হবে সবাইকে ।
তাদেরকে খাওয়াতে হবে । সেসব যোগাড় করতে হবে । মেয়ে অবশ্য রিনির । পুতুল মেয়ের যা যা লাগে সব রিনিই করবে বলেছে কিন্তু আমারও তো ঝামেলা কম নয়! আর এই পুতুলের বিয়েটা আম্মাকে না বলে দেওয়াও যাবে না কারণ লোকজনকে তো খাওয়াতে হবে । এমনিতে তো রাজি হবে বলে মনে হয় না কারন আমার এই পুতুল নিয়ে খেলা, তাদের বিয়ে দেওয়া আম্মার একদম পছন্দ নয় ।
আম্মা বলে, মানুষে কি কিছুর প্রাণ দিতে পারে? তুমি কি জান দিতে পারবে পুতুলের শরীরে? হাশরের দিন আল্লাহ তোমাকে জিজ্ঞেস করবে, তুমি যে দুনিয়াতে থাকার সময় পুতুল বানাতে, তাতে এখন প্রাণ দাও; কিন্তু মানুষ ওতে প্রাণ দিতে পারবে না। সেই ক্ষমতা মানুষের নেই, সে তখন আল্লাহকে বলবে, ইয়া আল্লাহ, আমি পারছি না পুতুলের শরীরে প্রাণ দিতে তখন আল্লাহ বলবেন, তোমাদেরকে আমি বারণ করেছিলাম পুতুল বানাতে, মুর্তি বানাতে তবুও তোমরা বানিয়েছ, কথা শোননি এখন তার শাস্তি ভোগ কর আর তাকে শাস্তি স্বরূপ দোজখে ফেলে দেবেন ।
হা জিহি জাহান্নামুল্লাতি ইউকায্যীবু বিহাল মুজরিমুন ।
ইয়াতুফু না বাইনাহা ওয়া বাইনা হামিমি আ'ন ।
ফাবি আইয়ি আ'লা ইরাব্বিকুমা তুকায্যীবান ।
(সুরা রাহমান। আয়াত 43,44,45
রিনিকে আম্মা খুব একটা পছন্দ করে না যদিও রিনি এলে সামনে কিছু বলে না । প্রায় দিনই রিনি আমার সাথে টিফিন খেতে দুপুরবেলা আমাদের বাড়ি আসে। আম্মা দুজনকেই খেতে দেয়, রিনি খুব ভালোবেসে খায় কিন্তু আমার একদম ভাল লাগে না এই টিফিন খাওয়াটা । আমি বরং এক খাবলা আচার তুলে নিয়ে আবার স্কুলে যেতেই বেশি আগ্রহী কিন্তু আম্মা পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে যে! আমাদের স্কুলটা বাড়ি থেকে একদম কাছে আর আব্বা স্কুলে বলে রেখেছে বলে আমাকে রোজ দুপুরে বাড়ি আসতে হয়।
টিফিন খেতে। রোজ দুপুরে বাড়ি আসো ! অথচ ঐ সময়টায় স্কুলে সবাই খেলে। গোল্লাছুট, স্কিপিং, ইচিং বিচিং, সুর করে ছড়া কেটে কেটে খেলতে হয়,
ইচিং বিচিং তিচিং চা
প্রজাপতি উড়ে যা। ।
এক লাঠি চন্দন কাঠি
চন্দন বলে চা চা
প্রজাপতি উড়ে যা ।
।
কানামাছি, দুচোখে কারও ওড়না বেঁধে নিয়ে সবাই খেলে,
কানামাছি ভোঁ ভোঁ,
যারে পাবি তারে ছোঁ
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।