আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধন্য তুরাগ, ধন্য টঙ্গী, ধন্য দেশবাসী

অজ্ঞাতসারে আজ চলে যেতে চাই। দূরে. . . .বহু দূরে অজানায়. . . . একে বেকে বয়ে চলা তুরাগ নদী- তাতে কি মোহ! কি টান! কি মায়া! কিসের টানে লাখো মানুষ তুরাগ তীরে সমবেত হয়। কাঁধে লাকড়ি, হাতে হাড়ি-পাতিল আর চাল-ডালসহ একত্রিত হয়। কোন জিনিস তাদের টেনে নিয়ে আসে খোলা আকাশের নিচে, বাঁশ, চট, টিন ও লোহার পাইপের সামিয়ানার তলে। হোগলার বিছানা, কনকনে শীত- তবুও মানুষ আসে তুরাগ তীরে, বিশ্ব ইজতেমায়, আল্লাহ পাকের প্রেমের মেলায়।

লাখ লাখ মানুষের চোখের পানিতে সিক্ত হয় আমাদের দেশের মাটি। আল্লাহ পাকের প্রেমে ব্যাকুল লাখ লাখ উম্মতের ভক্তিপূর্ণ সেজদা পরশে ধন্য হয় আমাদের দেশের জমিন। অগণিত কণ্ঠে আমীন আমীন ধ্বনিতে আমোদিত হয় আমার দেশের আকাশ বাতাস। রাজধানীর সচিবালয় থেকে সীমান্তে ঘুমিয়ে থাকা নীরব পল্লী অবধি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এক পবিত্র অনুভূতি- ঢাকায় বিশ্ব ইজতেমা হচ্ছে। শুধু কি আমাদের দেশ, কতো ধনী দেশের কোটিপতি ছুটে আসেন এ মাঠে, বাংলাদেশের ইজতেমায়, যখন ভাবি, গর্বে আমাদের বুক ফুলে যায়, আপ্লুত হই এই ভেবে যে, আল্লাহ প্রেমে দায়বদ্ধ একজন মাওলানা ইলিয়াস কতো বিশাল দানে ধন্য করে গেলেন, আল্লাহ পাক তার কবরকে বেহেশতের বাগিচা বানিয়ে দিন।

যারা একবার ইজতেমায় এসেছেন তাদের নতুন করে বুঝিয়ে বলতে হবে না ইজতেমায় কতো মানুষের আগমন ঘটে। চটের সামিয়ানার নিচে ধনী-গরিব, আশরাফ-আতরাফ সবার অবস্থান। কতো মানুষ! কতো ভাষা! কতো বর্ণ! কেউ চীন, কেউ আরব, কেউ ভারত, কেউ বাঙালি-তবুও মনে হয় সবাই এক অভিন্ন। ইজতেমা যেন মহাঐক্যের নিদর্শন। তাবলীগ জামায়াতকে অসংখ্য মোবারকবাদ যে তারা এতো বড় একটি সম্মেলন আমাদের বাংলাদেশে প্রতি বছর আয়োজন করছে।

লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে তারা এ আয়োজন সম্পন্ন করে থাকে। বাংলাদেশ সরকার দেশি-বিদেশি মুসলমানদের যথাসাধ্য ব্যবস্থাপনা দিতেও এতটুকু কার্পন্য করে না। বর্তমান দুনিয়ায় ইসলামের নামে যতো মত ও পথের উদ্ভব হয়েছে তার মধ্যে দাওয়াতে তাবলীগ হলো অন্যতম বিশুদ্ধ তরিকা। এখানে কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে নেই কোনো তারতম্য। সবার মাথায় আপন আপন বোঝা।

এক পাত্রে সবার খাওয়া। এ তো স্মরণ করিয়ে দেয় সাহাবায়ে কেরামের যুগকে। এখানে কেউ কারো প্রভু নয়, আবার কেউ ভৃত্যও নয়। মানুষে মানুষে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের এ যেন জান্নাতি এক বিভা। ওয়াজ-নসিহত চলছে।

যিনি বয়ান করবেন তার নাম ঘোষণা করে আগেপিছে কোনো স্তুতি নেই। শান-শওকতের কোনো আয়োজন নেই। নেই স্টেজের ওপর গালিচা, সোফা আর সেলুন চেয়ারের কোনো রাজকীয় আসন। মাননীয় সভাপতি, সম্মানিত শ্রোতা বলে কোনো বিশেষণের ছড়াছড়ি নেই ভাষণের আগে পরে। এ ধরনের বিশেষণ যদিও রাজনৈতিক মঞ্চে শোভা পায়, কিন্তু ওয়াজ-নসিহতের মজলিসে তা একদম বেমানান।

এতে কেবল দাওয়াতে ইলাল্লাহর মন মানসিকতা হওয়াই কাম্য। ইজতেমার মাঠ হোক আর অন্যত্র বয়ানের ক্ষেত্রে হোক, এ কাজটি এখলাসের সঙ্গে পালন করছে তাবলীগ জামায়াত। আলহামদুলিল্লাহ, দাওয়াত ও তাবলীগ এমন একটি পন্থা যাতে কোনো উঁচু-নীচুর ভেদাভেদ নেই। পেশাগত বিভক্তি বা রাজনৈতিক বিভেদ না থাকায় নেই কোনো হানাহানি। আমির-ফকির, মনিব-ভৃত্য, আরব-অনারব, মুর্শিদ-মুরিদ, শাসক-শাসিত, সামরিক-বেসামরিক, শিক্ষক-ছাত্র সবাই একাকার।

কারো ব্যক্তি জীবনে শ্রেণী বৈষম্যের অবকাশ থাকলেও জামায়াতবদ্ধ হওয়ার পর সেই ব্যক্তি থেকে তা বিদায় নেয় তার অজান্তেই- কোনো সময় দেখা যায় অফিসের বড় কর্তা ব্যক্তি হলেন ‘মামুর’ ও কর্মচারী হলেন ‘আমির’- জিম্মাদার। সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের এমন নজির মেলা কঠিন। তাবলীগের এ মেহনত মানুষকে নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রেরিত সর্বশেষ কাফেলার নেতৃত্বে ছিলেন দাসপুত্র হিসেবে খ্যাত উসামা ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু আর তাঁর অধীনে ছিলেন ‘উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু’সহ নেতৃস্থানীয় অনেক সাহাবায়ে কেরাম। এক রিওয়ায়াত অনুযায়ী হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুও ছিলেন অধীনস্থদের কাতারে।

দাসপুত্রের হওয়া সত্ত্বেও তিনি নবী (সা.) পরিবারে হাসান ও হোসেন রাদিয়াল্লাহু আনহু’-এর মতো সমাদৃত হতেন। দাওয়াত ও তাবলীগ হলো বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ব্যাপক ও গতিশীল একটি ইসলামী আন্দোলন। ইসলামী চিন্তা-চেতনায় বিশ্বজুড়ে সমাদৃত একটি নীরব বিপ্লব। আর তাবলীগ জামায়াত হলো ইসলাম ধর্মের আলোকে গড়া সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও মানবচিত্ত শুদ্ধির একটি আন্তর্জাতিক দাওয়াতি সংস্থা। অমুসলিমের পাশাপাশি মুসলিম জাতিগোষ্ঠীকে ধর্মের পথে ইসলামের দিকে আহ্বানকারী নিবেদিত প্রাণ মুবাল্লিগের একটি কাফেলা।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রবেশের প্রথম মাধ্যমও ছিল দাওয়াত ও তাবলীগ। মানুষকে ইসলামের পথে চলার দাওয়াত দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মীয় দায়িত্ব। আজকের এই সঙ্কটময় যুগে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মানুষকে আলোর পথে ডাকা জরুরি। নীতিগতভাবে প্রত্যেক মুসলমানকে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে বিশেষত ধর্মীয় শিক্ষিতদের। অতীতের মুসলমানরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করেছেন।

তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, সফর-পর্যটন, ভাগ্যান্বেষণ ইত্যাদির উদ্দেশে যেখানে গিয়েছেন কোথাও তারা ইসলামের দাওয়াত দিতে ভুলে যাননি। এভাবেই সারা দুনিয়ায় ইসলামের বিস্তার হয়েছে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে এবং এক জাতি থেকে আরেক জাতিতে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে। আজকের এ যুগেও মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব রক্ষার্থে ইসলামের পথে দাওয়াতের কাজ আরো বেগবান করতে হবে। ইউরোপের প্রধান শহরগুলোতে বসবাসরত মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম সচেতনতা ও ইসলামী পরিবেশ গঠনে তাবলীগ জামায়াত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

এই দাওয়াতের সূত্র ধরেই মুসলিম ঐতিহ্যের হৃতমৃত্তিকা স্পেনের বুকে পাঁচশত বছর পর আবার আজানের সুমধুর ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। ৪৮ হাজার বর্গমাইলের এ সবুজ ভূখণ্ডের মানুষ যে কতটা ধর্মপ্রাণ, তার বাস্তব উদাহরণ টঙ্গীর তুরাগ নদীর কোল ঘেঁষে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমায় মানুষের ঢল। লেখকঃ সৈয়দ মাহবুব আলম -প্রকৌশলী ও গবেষক, ফানার, কাতার। Click This Link  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.