একবার রাজার উপদেষ্টাগণ রাজাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, “রাজ্যে হু হু করে লোকসংখ্যা বাড়ছে। লোকজন ফসলি জমিতে বাড়িঘর বানাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে রাজ্যে খাদ্যসংকটসহ নানা সমস্যা দেখা দেবে। ফসলি জমিতে বাড়িঘর বানানো নিষিদ্ধ করে একটি আইন জারি করে দিলে কেমন হয় রাজামশাই?”
রাজা বললেন, “বিকল্প ব্যবস্থা না করে ফসলি জমিতে বাড়িঘর বানানো নিষিদ্ধ করলে রাজ্যে অসন্তোষ দেখা দেবে। প্রজারা নাখোশ হবে।
এমন একটা বুদ্ধি বের কর, যাতে সমস্যার সমাধান হবে, আবার রাজ্যে সৃষ্টি হবে না কোনো অসন্তোষ। তোমরা প্রত্যেকে একটি করে প্রস্তাব দেবে। তিনদিনের মধ্যে উত্তম সমাধান না দিতে পারলে গর্দান যাবে তোমাদের। ”
উপদেষ্টাগণ পড়ে গেলেন ভীষণ চিন্তায়। তারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বেরিয়ে গেলেন রাজদরবার থেকে।
চিন্তা করতে করতে চলে গেল দুইদিন। অথচ কোনো সমাধান বের করতে পারলেন না। সময় যতই কমে আসছে, উপদেষ্টাগণ ততই ছটফট করতে লাগলেন। রাজার সমস্যার সমাধান বের না করতে পারলেও, তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্য একটা বুদ্ধি বের করে ফেললেন। তা হল, ব্যর্থ উপদেষ্টা হয়ে রাজার সামনে গিয়ে গর্দান দেওয়া যাবে না; প্রয়োজন হলে যে যেদিকে পারবে, পালিয়ে যাবে।
রাজার বেঁধে দেওয়া সময়ের আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। এর মধ্যে একটা উপায় বাতলাতে হবে। উপদেষ্টাগণ কোনো উপায় বের করতে না পেরে এক রকম পালাবার আয়োজন করছেন। এমন সময় জলখাবার নিয়ে ঘরে এল এক দাসি।
সে উপদেষ্টাদের দুরবস্থা দেখে বলল, “আমি আপনাদের সমস্যার কথা জানি।
আবার এর সমাধানও জানি। ”
উপদেষ্টাগণ সমস্বরে বললেন, “কী বলতে চাস, খুলে বল। আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা। ”
দাসি বলল, “আমার কথাটা শুনলে আপনাদের কাউকে আর পালাতে হবে না, মরতেও হবে না। বরং আপনারা রাজার অনুগ্রহ পাবেন।
”
একজন উপদেষ্টা বললেন, “তাড়াতাড়ি বল, সময় নেই আমাদের হাতে। ”
দাসি বলল, “এ রাজ্যে পতিত অবস্থায় পড়ে আছে অসংখ্য ডোবা-নালা। অসংখ্য বাড়িঘর তৈরি করা যায় এই ডোবা-নালাগুলো ভরাট করে। এতে প্রজাদের সমস্যার যেমন সমাধান হবে, তেমনি প্রজাদের মধ্যে কোনো অসন্তোষও থাকবে না। ”
দাসির প্রস্তাব শুনে উপদেষ্টাগণ আনন্দে লাফালাফি করতে লাগলেন।
পালানোর পরিবর্তে দাসির প্রস্তাবটা নিজেদের প্রস্তাব বানিয়ে বুক ফুলিয়ে রাজদরবারে গিয়ে হাজির হলেন।
রাজা বললেন, “বল, কী সমাধান নিয়ে এলে তোমরা?”
প্রস্তাব তো মোটে একটা। আগে যে বলতে পারবে, জয় হবে তার-ই। উপদেষ্টাদের মধ্যে তাই রীতিমতো প্রতিযোগিতাই শুরু হয়ে গেল।
একজন বললেন, “আমি আগে বলি, এটা আমার বুদ্ধিতে নেওয়া প্রস্তাব।
”
আরেকজন খিচ মেরে বললেন, “আরে রাখ তো। কে বলেছে এটা তোমার নেওয়া প্রস্তাব? এটা তো আমার প্রস্তাব। তোমরা সরে যাও, বলতে দাও আমাকে। ”
আরেকজন বললেন, “আমিই দাসিকে প্রস্তাব করার অনুমতি দিয়েছিলাম, এটা আমার...”
এ কথা শুনেই পেছন থেকে দুজন তার মুখ চেপে ধরলেন, “হায় হায়! বলে কী! বলে কী! এই পাঁজিটা তো আমাদের শূলে চড়াবে দেখছি। ” হ্যাঁচকা টানে সবার পেছনের নিয়ে যাওয়া হল তাকে।
আবার সব উপদেষ্টা রাজাকে বুদ্ধি বাতলানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লেন। কার কথা কে শোনে! একজন রাজার দিকে এক কদম এগিয়ে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রস্তাবটা বলার চেষ্টা করতেই আরেক উপদেষ্টা পেছন থেকে উড়ে এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, “চুপ চুপ, মিথ্যাবাদী কোথাকার, চুপ। ”
আরেকজন পাশ থেকে বলে ওঠেন, “মহারাজের অনুগ্রহ পাওয়ার অধিকার আমার বেশি। আমার প্রস্তাব আমাকে বলতে দাও। ”
কেউ থামে না, কেউ দমে না।
শুরু হয়ে গেল হাতাহাতি।
রাজা উপদেষ্টাদের কাণ্ড দেখে বিরক্ত হয়ে কোতোয়ালকে আদেশ করলেন, “প্রত্যেককে বন্দি করে আলাদা আলাদা কুঠুরিতে নিয়ে রাখা হোক। ”
যেমন কথা তেমন কাজ। ক্লান্ত-শ্রান্ত উপদেষ্টাগণ আলাদা আলাদা কুঠুরিতে বন্দি হলেন।
রাজা গেলেন প্রথম কুঠুরির সামনে।
বললেন, “তোমার প্রস্তাবটা বল। ”
প্রথমেই প্রস্তাব শোনানোর সুযোগ পেয়ে উপদেষ্টা নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলেন। এই সুযোগে প্রস্তাব গ্রহণে তার কী ভূমিকা ছিল, তা পেশ করার লোভও সামলাতে পারলেন না তিনি। বললেন, “এই সামান্য সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের বিস্তর সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। তবে এত সময় দেওয়ার আদৌ প্রয়োজন ছিল না রাজামশাই।
আপনি নির্দেশ দেওয়ার পর রাজদরবার থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময়ই এই কঠিন সমস্যার একটা সহজ সমাধান বের করে ফেলেছিলাম আমি। সমাধানের কথা আপনাকে সঙ্গে সঙ্গেই জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অন্যরা আমাকে বলতে দিল না। তাদের কথা, সমস্যা সমাধানের জন্য আরও তো তিনদিন সময় আছে। ”
রাজা বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে বললেন, “প্রস্তাবটা কী, তাই বল।
”
উপদেষ্টা আবেগভরে বলতে লাগলেন, “মহারাজ, প্রস্তাব শোনার পূর্বে এর পূর্বের কাহিনি শোনা জরুরি। আমার প্রস্তাবটা এতটাই যুৎসই ও মঙ্গলজনক, এটা অন্য উপদেষ্টাদেরও পছন্দ হয়ে যায়। তারা আমার প্রস্তাব ছিনিয়ে নিয়ে যার যার প্রস্তাব আকারে আপনার বরাবরে পেশ করবার জন্য নানা কূট-কৌশল শুরু করে দেয়। আমার প্রস্তাবটা আমার কাছে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ”
রাজা বিরক্ত হয়ে তার কথা শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন।
চলে গেলেন পরের কুঠুরিতে। এ কুঠুরির উপদেষ্টাও মূল প্রস্তাবের চেয়ে অন্যদের তুলনায় তার ভূমিকা যে বেশি, সে কথা বলতে শুরু করলেন। রাজা চলে গেলেন পরের কুঠুরিতে। এভাবে রাজা এগার উপদেষ্টার কুঠুরি পার হলেন। কিন্তু কারও কাছেই মূল প্রস্তাবটি শুনতে পারলেন না।
শেষের কুঠুরিতে যে উপদেষ্টা বসে ছিলেন, তিনি আবার একটু মিনমিনে ধরনের। রাজাকে দেখেই তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। রাজা ধমক দিয়ে বললেন, “এত কান্না কীসের? অন্য উপদেষ্টারা মূল প্রস্তাব না দিয়ে উল্টো নিজেদের নানান ভূমিকার কথা বলতে ব্যস্ত। আর তুমি কী কান্না জুড়ে দিলে! প্রস্তাবটা কী, বল তো আমাকে। ”
উপদেষ্টা হতাশার সুরে বলল, “তারা তাদের ভূমিকার কথা আপনাকে বলে ফেলেছে? আর আপনিও তা শুনে ফেলেছেন মহারাজ? তাহলে আমার কথাটুকু শুনুন।
আমার বুদ্ধিতেই দাসি এত মূল্যবান পরামর্শটা দিয়েছে। অন্য কারও কথায় নয়। এখন এ ব্যাপারে কার কতটুকু ভূমিকা আর কৃতিত্ব, তা আপনার বিচার মহারাজ। ”
রাজা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন দরবারে। তার নির্দেশে সকল উপদেষ্টাকে কুঠুরি থেকে বের করে নিয়ে আসা হল।
ডাকা হল সকল দাসিকে।
রাজা বললেন, “আমার উপদেষ্টাদের উপদেশ দিয়েছে কে?”
দাসিরা ভয়ে মুখ খুলছে না। সবাই মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।
এক দাসি সভয়ে বলল, “মহারাজ, আমরা হলাম দাসি। সারাদিন আপনাদের সেবায় নিয়োজিত থাকি।
তবে মাঝে-মধ্যে ওই কালোদাসিকে দেখতাম, উপদেষ্টাদের উপদেশ দিতে। ”
রাজা কালোদাসির দিকে তাকিয়ে বললেন, “সত্যি করে বল, তুমি কি তাদের পরামর্শ দিয়েছ?”
কালোদাসির প্রাণ যায় যায়। সে বারকয়েক ঢোক গিলে কোনোমতে বলল, “এ আমার কাজ নয় মহারাজ। আমি শুধু উপদেষ্টাদের জীবন বাঁচানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছিলাম। ”
রাজা অবাক হয়ে বললেন, “জীবন বাঁচানোর জন্য মানে?”
দাসি ভয়ে ভয়ে বলল, “মহারাজ, আপনি উপদেষ্টাদের কাছে সমস্যা সমাধানের জন্য যে পরামর্শ চেয়েছিলেন, তা ছিল তাদের জ্ঞানের অতীত।
তারা সমস্যার কোনো সমাধানই করতে পারছিল না। তখন তারা চিন্তা করছিল, পালিয়ে দেশান্তরী হবে। সেই প্রস্তুতি-ই নিচ্ছিলেন তারা। তাদের বিপদ দেখে আমি একটা প্রস্তাব দিয়েছি মাত্র। ”
রাজা দাসিকে বললেন, “কী ছিল তোমার সেই প্রস্তাব, নির্ভয়ে বল।
”
দাসি তার প্রস্তাব পেশ করল। প্রস্তাবটি শুনে সত্যি সত্যি রাজা মহাখুশি হয়ে গেলেন।
বিলম্ব না করে রাজা কালোদাসিকে উপদেষ্টা পদে, আর বার উপদেষ্টাকে রাজবাড়ির দাস পদে নিয়োগের আদেশ জারি করে দিলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।