অরুণালোক ছেলেবেলায় আমার এক পরিচিত লোকের কাছে একটি গল্প শুনেছিলাম। তখন ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি। গল্প শুনতে ভালো লাগতো বিশেষত: রাজার বাদশার গল্প। তো এ গল্পটাতেও রাজা আছেন, মন্ত্র্রী আছেন। গল্পটা এরকম:
রাজবাড়ির অনতিদূরে এক পর্ণ কুটিশকে বিধবা যুবতি এক রজকিনী (ধোপিনী) বাস করতো।
হঠাৎ একদিন প্রতিবেশিরা ঐ রজকিনীকে অন্তসত্বা অবস্থায় আবিষ্কার করলো এবং তার চরিত্র সম্পর্কে স্বভাবতই আজে-বাজে কথা বলতে লাগলো। বদনামের গতিবেগ নাকি বাতাসের চেয়েও বেশি। তাই এ কথা রাজার কানেও পৌঁছুলো। রাজা তখন চিন্তিত হয়ে মন্ত্রির সাথে পরামর্শ করতে বসলেন। মন্ত্রি মহোদয় বললেন, ‘সত্যিই তো, বিধবা রজকিনী যদি অন্তসত্বা হয়, তবে তো ভারি মুশকিল! রাজ্যের মানুষ ভাববে, আপনি রাজকার্যে দুর্বল।
’ রাজা বললেন, ‘বিলক্ষণ। কিন্তু কী করা যায় বলুন তো মন্ত্রি?’
মন্ত্রি বললেন, তদন্ত করতে হবে, প্রয়োজনে সমস্ত দেশে পাহারা জোরদার করতে হবে।
রাজা: বেশ, তাই করুন।
রাজার আদেশ পেয়ে মন্ত্রি কাজে লেগে গেলেন। সারা রাজ্যে পাহারা জোরদার করা হলো কিন্তু কোন অপরাধীকে ধরা গেলো না।
দেশের মানুষ ক্ষেপে গেলো। শেষতক মন্ত্রি চিন্তা করলেন, একে একে সব নাগরিকের বাড়িতেই তদন্ত করা হয়েছে কিন্তু কোন ফল পাওয়া যায় নি। তবে কি আজ রাতে রাজবাড়িতে পাহারা বসাবো?’ বিষয়টি নাজুক বিধায় উনি কাউকে বললেন না, রাজার বদনাম হবে। দু-মন দু-আশা নিয়ে উনি রাতে কাউকে না জানিয়ে রাজবাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এদিকে রাত গভীর হচ্ছে, চারদিকে সুনসান নিরবতা।
ক্ষণকাল পর দেখলেন, রাজবাড়ির প্রধান ফটক খুলে যাচ্ছে। মন্ত্রির বুক দুরু দুরু কাঁপছে কী হয় কী হয় করে। কিন্তু এ কী! গভীর রাতে রাজা স্বয়ং গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে এসে রজকিনীর বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। মন্ত্রির নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে রাজার পিছু নিলেন। শেষে দেখলেন, রাজা সত্যিই রজকিনীর ঘরে প্রবেশ করলেন।
মন্ত্রি খানিকটা কৌতুক, খানিকটা ভয়, খানিকটা দ্বিধা নিয়ে রজকিনীর কুটিরের বেড়ার ধারে গিয়ে আড়ি পাতলেন ভেতরের কথাবার্তা শোনার জন্য। এদিকে রাজা গিয়ে রজকিনীর সাথে খোশালাপে মগ্ন।
রাজা: রজকিনী! প্রিয়া আমার! আমি খুবই ক্ষুধার্ত। দয়া করে আমাকে কিছু খেতে দাও।
রজকিনী : (আতকে উঠে) হায় ভগবান, আমি এতো রাতে কীভাবে খাবার দেবো আপনাকে প্রিয়তম! আমার ঘরে যে আজ পান্তাভাত আর কাচালঙ্কা ছাড়া আর কিছু নেই।
রাজা: (রজকিনীর ভাঙা চৌকিতে আয়েশে আধশোয়া অবস্থায়) তথাস্তু। আমাকে তাই দাও।
রজকিনী রাজার আদেশে পান্তা এনে ধরলেন রাজার সামনে। রাজা যেন রাজভোগ খাচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে খাওয়া শুরু করলেন। খাওয়ার পর রজকিনীকে আদর করে (পাঠক নিশ্চয় ন্যাকা নয়, তারা এ আদরের অর্থ বুঝতে পারছেন।
কিন্তু আমি যখন গল্পটা শুনি, তখন আদর বলতে শুধু আদরকেই বুঝতাম) রজকিনীর ভাঙা চৌকিতে মধ্যরাতের একচিলতে ঘুম দিলেন। শেষ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে গুটি গুটি পায়ে রাজবাড়িতে ফিরে গেলেন। পরের দিন সভা বসেছে। নাগরিকরা এসেছে রজকিনীর বিষয়ে জানতে।
রাজা: (মন্ত্রির দিকে ফিরে) কী হে মন্ত্রি মহোদয়! আপনাকে এতোটা দিন সময় দিলাম বিষয়টা জানার জন্য।
কিন্তু আজোবধি তো কোন খবর দিতে পারলেন না। বিষয় কি? আর কতদিন লাগাবেন?
মন্ত্রি : গোস্তাকি মাফ করুন রাজা বাহাদুর। আমি আসলে যা জেনেছি তা অত্যন্ত গোপনীয়। জনসম্মুখে তা বলা যাবে না।
মন্ত্রির কথা শুনে সভার মানুষ ক্ষেপে গেলেও সরাসরি কিছু বলতে না পারলেও গুঞ্জন তুললো।
শেষে রাজা বললেন-
রাজা: বলছেন কি? আরে বলুন বলুন, যা জানেন তা বলুন।
মন্ত্রি : (উপায়ন্ত না দেখে) আজ্ঞে, ভয়ে বলবো না নির্ভয়ে?
রাজা : (হাসতে হাসতে) আপনি নির্ভয়ে বলুন।
মন্ত্রি : আমি একটি শ্লোক দিয়ে বলছি। যারা বুঝার বুঝে নিক। আমি সরাসরি কথাটা বলতে পারবো না।
রাজা : (পূর্ববৎ হাসতে হাসতে) আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি শ্লোকের মাধ্যমেই রহস্য প্রকাশ করুন।
মন্ত্রি: (মুখ কাচুমাচু করে) আজ্ঞে, পিরিতে মানে না জাত আর অজাত, ক্ষুধায় মানে না পান্তা ভাত, আর ঘুমে মানে না ভাঙা ঘাট।
মন্ত্রির শ্লোক শুনে রাজার নির্বাক, প্রজারা ধোঁয়াশায়। মন্ত্রিই কেবল মিটি মিটি হাসছেন। তবে সে হাসিতে খানিক ভয়ও ছিলো।
সুপ্রিয় নাগরিক, আমার এ গল্পটা রূপক অর্থে কি বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সাথে মিলে যায়! যদি যায়, তবে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।