লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। একশো বছর পরে
মোহাম্মদ ইসহাক খান
মানুষটি একটি ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বসে আছে। ইংরেজি ম্যাগাজিন।
প্রতি মাসে তার বাড়িতে এই ম্যাগাজিনের একটা করে কপি আসে। ট্যাবলয়েড পত্রিকা পড়া তার কাছে ঠিক বিলাসিতা নয়, ইংরেজিটা এতে সড়গড় হয় আর সেই সাথে নানা খবরাখবর জানাও হয়ে যায়।
আজকের ব্যাপার ভিন্ন। লোকটি কালো কালিতে ছাপা একটি বিশেষ নিবন্ধের নামের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে। বড় বড় করে লেখা আছে নিবন্ধের নাম, "একশো বছর পরে।
" লেখক রাউল্ট জোহানসেন, একজন গবেষক। কী সব খটমট বিষয় নিয়ে যেন মাথা ঘামান।
এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু একটু কৌতূহলোদ্দীপক। লেখক এতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন, আজ থেকে ঠিক একশো বছর পর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, মাটি-পাথর, কিছুই থাকবে না।
কেউ ভাবতে পর্যন্ত পারবে না যে ব্রহ্মাণ্ডে পৃথিবী নামে কোন একটি গ্রহ ছিল।
লেখকের ভাষ্যমতে, ধ্বংসের কারণ হতে পারে নানাবিধ। সন্দেহাতীতভাবেই আগামী একশো বছরের মধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে। সেগুলো আগের দুটোর মতো "কম ধ্বংসকারী" হবে না, কারণ পৃথিবীর মেজর পাওয়ারগুলোর হাতে এখন আছে ভয়াবহ সব অস্ত্র, যার একটি সুইচে অসাবধানে একটু "খোঁচা" লাগলেই একটা বিশাল জনপদ ধুলো হয়ে যেতে পারে। কাজেই আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ হবার পর পৃথিবীর যতটুকু অবশিষ্ট থাকবে (আদৌ যদি থাকে) তা হবে অত্যন্ত বিষাক্ত, মানুষের জীবনধারণের জন্য অনুপযোগী।
কাজেই মানুষ রসদ, পরিশোধিত বায়ু-পানি ইত্যাদির অভাবে বেঘোরে মারা পড়বে। ইতিহাস আমাদেরকে বলে, বহু লক্ষ বছর আগে এমনটা আরেকবার ঘটেছিলো। বিরূপ আর প্রতিকূল আবহাওয়ায় টিকতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো ইত্থিওসোরাস আর টাইরানোসোরাসের মতো বিশাল বপুধারী সব ডাইনোসর। মানুষ তো সে তুলনায় কোন্ ছার, শারীরিকভাবে কত দুর্বল। তাছাড়া পৃথিবী গরম হয়ে উঠবে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে ভূগর্ভস্থ লাভা সব উপচে বেরুবে, ব্যাপারটার সাথে একটা বিকট বিস্ফোরণের তুলনা করা চলে।
সবকিছুর যুগপৎ সম্মিলনে অবধারিত ফলাফল ধ্বংস, প্রলয়, পূর্ণচ্ছেদ।
লেখক আরও বলেছেন, প্রযুক্তিগত মহা-মহা উন্নতি মানুষের জন্য "বরে শাপ" হবে, বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে নিজের দিকেই। বিপুল শক্তিশালী সব যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে অবশ্যই এলিয়েন তথা মহাজাগতিক প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ হবে মানুষের। তারা যে এখানে এসে চা-নাস্তা খেতে খেতে গোলটেবিল বৈঠক করবে তা নয়, বরং তারা এসে প্রথম সুযোগেই সব মানুষকে মেরে ফেলবে, এবং কব্জা করবে এই পৃথিবীকে। তারপর সোজা এই গ্রহ বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেবে।
অন্য কোন কারণেও পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সৌরজগতের গ্রহগুলোর গতিপথ ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, গ্রহগুলো খুব ধীরে ধীরে নিজেদের কক্ষপথ থেকে সরে আসছে, এবং সরে আসার ধরণটা খুব একটা সুবিধের নয়। এমন বিচ্যুতি চলতে থাকলে আগামী একশো বছরের মাথায় পৃথিবী নামক এই গ্রহটির সাথে বড় কোন গ্রহ কিংবা গ্রহাণুর সংঘর্ষ ঘটবে এবং পৃথিবী নামের ক্ষুদ্র এই গ্রহটি আক্ষরিক অর্থেই "ছাতু" হয়ে যাবে।
এগুলো তো গেল বড় বড় সব কারণ। পৃথিবীর সাধারণ দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর ফুরিয়ে আসা, এসব সহ আরও নানা কারণ হতে পারে পৃথিবীর প্রলয় ঘটার জন্য যথেষ্ট।
লেখক ধাপে ধাপে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বলার ভঙ্গিটা ছিল এমনঃ যদি পৃথিবী গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে ধ্বংস না-ও হয়, এলিয়েনরা ধ্বংস করবে। যদি এলিয়েনরা ধ্বংস না-ও করে, গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষ ঘটবে। আর যদি গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষ না-ও হয় ... ... ইত্যাদি ইত্যাদি। যেন পৃথিবী ধ্বংস হওয়া চাই-ই চাই, কিছুতেই একশো বছরের চেয়ে বেশি টিকে থাকা চলবে না।
নিবন্ধের সার কথা হল এই। একেবারে শেষের দিকে লেখক ভয় ধরানো আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছেন, "আমি আর মানবজাতির জন্য কোন আশা দেখছি না। আপনি এখন কী করবেন তা নিজেই ঠিক করে নিন। আমি হলফ করে বলছি, পৃথিবীর ধ্বংসের বছর হবে দুই হাজার একশো তেরো সাল। আর সামনের দিকে এগিয়ে লাভ নেই, এখন সময় গালে হাত দিয়ে নিজেদের শেষ সময়ের জন্য ভাবা।
"
মানুষটি ম্যাগাজিনটা টেবিলে রেখে দিলো। যাঁরা বিনোদনের জন্য কিংবা নিছক সময় কাটানোর জন্য পত্রিকা, ট্যাবলয়েড এসব পড়ে থাকেন, তাঁরা পড়া শেষ হলে পত্রিকা বাতিল মালের ছকে ফেলে দেন, ওটার কথা আর তাঁদের খেয়াল থাকে না। বোধহয় এটাই সব পত্রিকার শেষ গন্তব্য। হয়তো সঠিক গন্তব্য।
এই মানুষটি তা করলো না।
সে মন খারাপ করে বসে রইলো। একশো বছর পরে সে বেঁচে থাকবে না, এটা ঠিক। কোন প্রযুক্তিই মানুষকে অমর করতে পারে নি, ভবিষ্যতে পারবে, সে আশাও নেই। কিন্তু পৃথিবীর আয়ু, এই সুন্দর গ্রহটির আয়ু আর মাত্র একশো বছর? তারপরই সব শেষ? কেন যেন ঠিক মেনে নেয়া যায় না। সব মানুষই যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়, এই কামনা অবচেতন মনে করে যায়, যেন সে নিজে না থাকলেও এই পৃথিবী থেকে যায় ঠিক আগের মতোই।
কারণ এই পৃথিবীর আলো বাতাসে সে চলেছে, ফিরেছে, বড় হয়েছে, বুড়ো হয়েছে। তার পায়ের ছাপ এই গ্রহের যত্রতত্র পড়েছে। পৃথিবীর সব আনন্দের উপকরণে তার জীবন ধন্য হয়েছে। পৃথিবী, ধরিত্রী, বসুন্ধরার সাথে তো মায়ের আছে এক আশ্চর্য মিল। মা যেমন কোমল হাতে এই মানুষটিকে লালন করেছেন, পৃথিবীও তো তা-ই করেছে।
এই পৃথিবী থাকবে না, ধ্বংস হয়ে যাবে? মাত্র একশো বছর পরে? বড় কম সময় হয়ে গেল না?
মানুষটি নিবন্ধ পড়ে মন খারাপ করে বসে রইলো। আজ বিকেলে সে বেড়াতে যাবে না, বসবে না নদীর ধারে, বেরুবে না রাস্তায়, পর্দা সরিয়ে উঁকি দেবে না বাইরে, তাকাবে না অস্তপ্রায় সূর্যের দিকে। লাভ কী, একশো বছর পর তো এসব কিছুই থাকবে না। মায়া বাড়িয়ে কী দরকার? সহসা মানুষটির কাছে সবকিছু অর্থহীন বলে মনে হয়। চোখের কোণে একটু পানিও হয়তো জমে।
পৃথিবী নামক এই আপাতদৃষ্টিতে নোংরা, ধুলো-কাদামাখা গ্রহটিকে সে কত ভালোবাসে, আজ সহসাই সে বুঝতে পারে।
*****
একশো বছর পর।
আজ দুই হাজার একশো তেরো সালের পনেরোই জানুয়ারী।
আমাদের গল্পের সেই মানুষটি অনেকদিন আগেই মারা গেছে। বুড়ো হয়েছিলো।
শেষ সময়েও সে মন খারাপ করে ছিল। আমি থাকবো না, পৃথিবীও থাকবে না, এই আক্ষেপ করতে করতে সে মারা গিয়েছিলো।
পৃথিবী কিন্তু ধ্বংস হয় নি। কেনই বা হবে? একটা নিবন্ধে কোথাকার কে কী একটা বলল, আর অমনি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেল? এতই সহজ?
ঐ তো, আজও ফুল ফুটছে, পাখি ডাকছে। আজও মানুষ মানুষকে ভালবাসছে।
সূর্য উদিত হচ্ছে, অস্ত যাচ্ছে। সবই আগের মতোই আছে, স্বাভাবিক আছে, নিয়মমাফিক আছে। শুধু শুধু বোকা মানুষটা মন খারাপ করেছিল।
(১৫ জানুয়ারী, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।