নিশীথ রাত্রি আমায় জন্ম দিয়েছে, ভোরের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছি তাই, আমায় শক্তি দিও হে স্রষ্টা যেন - সূর্যাস্তের আগেই সূর্যের দেখা পাই।
প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল চারপাশ। শত্রুপক্ষের মর্টারের আঘাতে সৈন্যদের ব্যারিকেডের এক অংশ ধ্বসে পড়েছে। কতজন হতাহত হয়েছে বোঝার উপায় নেই। তবে খানিক বাদেই ব্যারিকেডের এক পাশে লেফটেন্যান্ট বেনকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।
যাক, ছেলেটা বেঁচে আছে! লেফটেন্যান্ট বেন আর তার কিছু সাথি হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের দিকে আসতে থাকল। আমরা শুয়ে আছি ফেলে রাখা বেশ কিছু পাইন গাছের গুড়ির আড়ালে। প্রচণ্ড বন্দুকযুদ্ধ চলছে এদিকটাতে।
আমার সাথে আছে মিত্রবাহিনীর কিছু অকুতোভয় যোদ্ধা। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে খুব দ্রুত আমাদের লোকবল কমে যাচ্ছে।
ব্যাকআপ না পৌঁছালে আজ মৃত্যু নিশ্চিত। লেফটেন্যান্ট বেন কাছে চলে এসেছে। আমার উদ্দেশ্যে বলল, “ক্যাপ্টেন, উই আর ইন ক্রাইং নিড অফ ব্যাক আপ”।
আমি উত্তর দিলাম না। তবে একটা বিষয় লক্ষ করে আতঙ্কের ঢেউ নামল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে।
আমাদের অ্যামুনিশন প্রায় ফুরনোর পথে। ব্যাকআপ আসা পর্যন্ত টিকব বলে মনে হচ্ছেনা।
লেফটেন্যান্ট চিৎকার করছে, “ক্যাপ্টেন, ফর গডস সেক! কিছু একটা তো বলুন! এভাবে পরে থাকলে সবাই মারা পড়ব। আমরা কি অল আঊট এটাকে যাব?”
আমি বললাম, “অলআউট অ্যাটাকে যাওয়টা হবে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত। ওদের ভারী অস্ত্রের মুখে আমরা দু মিনিটে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।
আমাদের পিছু হটতে হবে”।
“তাহলে নির্দেশ দিন ক্যাপ্টেন, চুপ করে আছেন কেন?”
“সবাই একসাথে পিছিয়ে গেলে ওরা বুঝে ফেলবে লেফটেন্যান্ট। আমাদের কিছু সৈন্য এখানে থাকতে হবে কভার ফায়ার করার জন্য”।
“আমি থাকছি ক্যাপ্টেন”। দৃঢ় কণ্ঠে বলল বেন।
“আপনার দ্রুত পিছু হটুন”।
“না লেফটেন্যান্ট, আপনার অধীনস্থ সৈন্যদের নিয়ে আপনি পিছু হটতে থাকুন, আমরা কভার ফায়ার করছি”।
“না স্যার। আপনাকে এভাবে রেখে আমি পালাতে পারব না”।
“আহ! অযথা কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করবেন না লেফটেন্যান্ট।
এই যায়গাটা আপনি আমার চেয়ে অনেক ভাল চেনেন। খুব সহজেই সবার জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে পারবেন। সময়মত ব্যাকআপ নিয়ে হাজির হতে পারবেন”।
“কিন্তু স্যার........”
আমি বিরক্তির সাথে বললাম, “ইটস অ্যান অর্ডার!!”
“ইয়েস স্যার” বলে ঘুরল লেফটেন্যান্ট বেন। সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলল, “অ্যাটেনশন এভরিওয়ান।
উই আর রিট্রিটিং, ফলো মি। আই রিপিট- ফলো মি”।
কিছুক্ষন তাদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কেন যেন মনে হচ্ছে ওদের সাথে আর দেখা হবে না! আমি আবার শত্রুদের সম্ভাব্য অবস্থান লক্ষ করে গুলিবর্ষণে মনযোগী হলাম। নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছি আমরা।
সামান্য অমনোযোগ মৃত্যুর কারন হতে পারে।
কতটা সময় এভাবে পেরিয়ে গেল জানিনা, হঠাৎ বুকে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লাম। আওজায়টা পেলাম দু সেকেন্ড পর। মর্টারের শেল আঘাত করেছে। বুকের ভেতর থেকে সমস্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেছে যেন।
উফ! কি ভীষণ কষ্ট। শরীরের অংগ প্রত্যঙ্গগুলো থেকে কোন সাড়া মিলছে না। ঘুম আসছে! সহস্র বছরের ঘুম...
***
এই মুহূর্তে একবার নুবির সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু জানি নুবি বিজ্ঞান কাউন্সিলের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্ট নিয়ে ব্যাস্ত। তার সাথে এখন যোগাযোগ করা সম্ভব নয়।
তারপরও একবার চেষ্টা করে দেখতে তো ক্ষতি কি?
আমি বেডের পাশে একটা সুইচে চাপ দিলাম। ঘরের ঠিক মাঝখানে একজন সুন্দরী তরুণীর হলগ্রাফিক মূর্তি ভেসে উঠল। ও হচ্ছে কিটি, আমার ব্যাক্তিগত কম্পিউটার।
কিটি সুন্দর করে হাসল। “সুপ্রভাত রিমন? কেমন আছ তুমি?”
কিটির এই ফালতু কুশল বিনিময় অংশটা আমার জন্য খুব বিরক্তিকর।
যে পোগ্রামার ওর পোগ্রামিং করেছে তার মাথায় কি ঘিলু বলে কিছু ছিলনা? একটা যন্ত্রের সাথে মানুষের কুশল বিনময়ের অর্থ কি? বিরক্তি গোপন করে বললাম, “ভাল আছি কিটি। তোমাকে ডেকেছি একটা বিশেষ প্রয়োজনে”।
“সানন্দে প্রয়োজনটি জানাও রিমন”।
“আমি এই মুহূর্তে নুবির সাথে একটু কথা বলতে চাই”।
“সেটা তো সম্ভব নয় রিমন।
নুবি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্টে ব্যাস্ত। তার সাথে এখন যোগাযোগ করা যাবেনা”।
“আমি জানি। তারপরও তুমি একবার বিজ্ঞান কাউন্সিলের জীববিজ্ঞান অনুষদের সাথে যোগাযোগ করে দেখ”।
“ঠিক আছে রিমন” বলে কিটির মূর্তিটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
ফিরল আবার মিনিট খানেক বাদেই। “আমি দুঃখিত রিমন। বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে অনুমতি পাওয়া যায়নি”।
আমি হতাশ হয়ে গেলাম। নুবি খুব ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে ইদানিং।
দেখা পাওয়াতো যাচ্ছেই না, কথা বলাও মুশকিল হয়ে পরেছে।
“তবে আমি তোমার জন্য একটা কাজ করেছি রিমন”।
“কি করেছ তুমি?” আমি শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। কিটি প্রায়ই আমার অনুমতি ব্যাতিত বিভিন্ন কাজ করে বসে যা আমার জন্য পরবর্তীতে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
“আমি জীববিজ্ঞান অধিদপ্তরের সাথে যোগাযোগের সময় জানিয়ে এসেছি, যখনই নুবির অবসর হয় একমুহূর্ত দেরি না করে যেন তোমার সাথে যোগাযোগ করে!”
“ওহ হ! কেন করেছ তুমি এটা? নুবি জানতে পারলে চিন্তিত হয়ে পরবে।
কাজে মনোযোগ দিতে পারবে না!”
“আমি তোমার কণ্ঠের অস্থিরতাটুকু টের পাই রিমন। তুমি তো জান আমাকে সেভাবেই পোগ্রাম করা হয়েছে”।
“হ্যা, তুমি উদ্ধার করেছ আমাকে!” এবার আর বিরক্তি গোপন থাকল না। “এখন দয়া করে আমার ব্যাক্তিগত সাইক্রিয়াটিস্ট রিগের সাথে যোগাযোগ কর”।
কিটি আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিছুক্ষন বাদে ঘরের মাঝখানে ভেসে উঠল রিগের মূর্তি। “কেমন আছ রিমন?”
“ভাল থাকলে কি তোমাকে ডাকতাম, রিগ?”
“কেন কি হয়েছে?”
“আজ আবার দুঃস্বপ্ন দেখেছি”।
“কি দেখলে আজ?”
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর একজন সৈন্যের ভুমিকায় দেখলাম নিজেকে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে শত্রুপক্ষের মর্টারের আঘাতে ছিটকে পড়লাম। সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা! আর ঘুম ভেঙে গেল তখনই”।
“নতুন কিছু নয়”।
“হ্যা, কিন্তু স্বপ্নগুলোকে এত জীবন্ত মনে হয় কেন? মনে হয় যেন এই ছোট ছোট ঘটনাগুলো আমার জীবনেরই অংশ”।
“এটা খুব হাস্যকর ধারনা, রিমন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেড় হাজার বছর পূর্বের ঘটনা। তোমার বয়স মাত্র ত্রিশ”।
“কিন্তু বিষয়টা লজিক্যাল নয় রিগ। আমি নিশ্চয়ই স্বপ্নে এমন কোন ঘটনা দেখতে পারিনা যার অংশ আমি নই। যে ঘটনা আমি স্বচক্ষে দেখিনি, শুনিনি বা কখনো ভাবিনি তা আমার কল্পনায় কেমন করে আসে?”
“আমাদের অবচেতন মন লজিক মানেনা। তুমি কি আমার নির্দেশগুলো মেনে চলছ?”
“হ্যা, রাতে শোয়ার আগে কম খাচ্ছি, হালকা ব্যায়াম করছি। অন্যান্য নিয়মগুলো সব মেনে চলছি কিন্তু তারপরও লাভ হচ্ছেনা”।
“হুম... বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবতে হবে রিমন। আমি তোমার সাথে পরে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলব। এখন বিদায় দাও”।
“বিদায় রিগ”।
রিগ চলে যেতেই আবার কিটির ছবি ভেসে উঠল।
“আর কিভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি রিমন.........”
আমি সুইচ টিপে কিটিকে নিষ্ক্রিয় করে দিলাম।
বাবার সাথে অনেক দিন ধরে দেখা হচ্ছেনা। তার সাথে একটু কথা বলতে পারলেও মনটা হালকা হত।
****
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে আমার পিছু নিল দুটি বিদঘুটে চেহারার রোবট। এই রোবটগুলোর দেহের গরন মানুষের মত।
হাত পা আছে ঠিক ঠাক কিন্তু যেখানে মস্তিস্ক থাকার কথা সেখানে আছে বিশাল আকৃতির একটা চোঙ। তার ভেতর বসান আছে কপরটন। প্রতিটি প্রতিরক্ষা রোবট একটি ফ্রিকোয়েন্সি দ্বারা পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। এই ফ্রিকয়েন্সির সাহায্যে এদেরকে প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে নিয়ন্ত্রন করা হয়।
এরা আমার ব্যাক্তিগত বডিগার্ড।
প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে এই রোবট দুটো আমার ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। আমার বাবা বিজ্ঞানী ইরিদ বিজ্ঞান কাউন্সিল কতৃক ঘোষিত বর্তমান পৃথিবীর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের মাঝে একজন। গত কয়েক দশকে পদার্থ বিজ্ঞানের নানান শাখায় বাবার সৃষ্টি কিছু ফর্মুলা আর আবিস্কার পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে কয়েক ধাপ। তার পুত্র হওয়ার সুবাদে আমিও নানা সুযোগ সুবিধা ভোগ করি, না চাইলেও এ সুবিধা আমাকে নিতে হয়।
আমার রুমের বাইরে ডানদিক বরাবর লম্বা একটা করিডোর।
এই করিডোরের শেষ মাথায় বাবার ব্যাক্তিগত ল্যাবরেটরি। গত কয়েকদিন যাবত বাবা কাজে মশগুল হয়ে আছে, ল্যাব ছেড়ে আর বেরোচ্ছে না। বাবা সময় পরিভ্রমনের উপর কাজ করছে। আমি বিস্তারিত জানিনা, বিজ্ঞান কখনোই আমার আগ্রহের বিষয় ছিলনা।
বাবার ল্যাবের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
দরজার মাথায় সবুজ বাতি জ্বলছে। অর্থাৎ এ মুহূর্তে বাবা খুব বেশি ব্যাস্ত না, যোগাযোগ করা যাবে। আমি ভয়েজ সেন্সরের বাটন চেপে বললাম, “বাবা আমি রিমন। তোমার সাথে কথা বলা যাবে এখন?”
ইন্টারকমে বাবার গমগমে আওয়াজ ভেসে এল, “অবশ্যই রিমন। ভেতরে এসো”।
স্বয়ংক্রিয় ভাবে দরজা খুলে গেল। আমি ভেতরে পা দিলাম, রোবট দুটো আর ফলো করছে না। ওদের এখানে আসার অনুমতি নেই।
বাবা বসে ছিলেন একটা কিম্ভুতকিমাকার যন্ত্রের আড়ালে। আমাকে দেখে উঠে এলেন।
“কেমন আছ রিমন?”
“ভাল আছি। তোমার কাজ কেমন চলছে?”
“ভালনা”। বাবাকে চিন্তিত দেখাল। “আমার ফর্মুলাতে কিছু একটা গলদ আছে, যুগান্তকারী এক আবিস্কারের দ্বারপ্রান্তে এসে থমকে দাঁড়িয়েছি”।
আমি হাসলাম।
“তুমি হাসছ রিমন? তুমি আসলে বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারছ না। আমি সফল হলে বদলে যেতে পারে পৃথিবীর ইতিহাস। যেকোনো সময় আমরা অতিত অথবা ভবিষ্যতে পরিভ্রমন করতে পারব! যে টাইম মেশিনের কথা এতদিন কল্পকাহিনীতে পরেছ তা আজ বাস্তব হতে চলেছে! কি উত্তেজনাকর বিষয় একবার ভেবে দেখ!”
আমি বললাম, “আমি বুঝতে পারছি বাবা। আসলে বিজ্ঞান নিয়ে আমি খুব বেশি আগ্রহী নই তা তো জানই”।
“এটা খুব লজ্জাজনক! আমার পুত্র হয়ে তুমি বিজ্ঞান ভালবাসনা!” বাবা আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।
তারপর বললেন, “তুমি বলেছিলে আমার সাথে কথা বলতে চাও। কি বিষয়ে?”
“আমার দুঃস্বপ্ন দেখা নিয়ে। সমস্যাটা তো যাচ্ছে না। দিন দিন বাড়ছে”।
“তোমার ব্যাক্তিগত সাইক্রিয়াটিস্ট রিগের সাথে কথা বলেছ?”
“হ্যা, তার দেওয়া নিয়মগুলো সব মেনে চলছি কিন্তু লাভ হচ্ছেনা”।
বাবা যেন আরও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। “বিষয়টা ভাবনায় ফেলে দিল রিমন! আমি বিজ্ঞান কাউন্সিলে যোগাযোগ করে তোমার সমস্যার কথা বলব”।
“আর একটা কথা বলতে চাই বাবা”।
“কি?”
আমি খানিক ইতস্তত করে বললাম, “বলতো আমার বয়স কত?”
বাবা হাসলেন, “আমি তো তোমার বয়সের হিসেব রাখিনি। ২৮-২৯ হবে বোধহয়”।
“ত্রিশ”।
“কাছাকাছি অনুমান করেছি”। বাবার হাসিটা প্রসারিত হল।
“কিন্তু আমাকে দেখলে মনে হয়না ২৫-২৬ বছরের যুবক?”
“সেটা কোন সমস্যা না রিমন। বয়সের সাথে সাথে সবার গ্রোথ তো এক হয়না!”
“কিন্তু বাবা, আজ থেকে ১০ বছর পূর্বে যখন আমার বয়স ছিল ২০ তখনো আমাকে ২৫ বছর বয়সী মনে হত!”
“সেটা হরমনজনিত কোন সমস্যা হতে পারে! আমি এ বিষয়টা নিয়েও ওদের সাথে কথা বলব”।
“কিন্তু বাবা.......”
বাবা হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিল, “আমি বুঝেছি বিষয়টা রিমন। তোমার সাথে এ বিষয়ে পরে আরও কথা হবে। আমি এখন একা একা একটু কাজ করব, ফর্মুলার সমস্যাটা মনে হয় ধরতে পেরেছি। তুমি যাও”।
আমি বেরিয়ে এলাম ল্যাব থেকে।
স্বয়ংক্রিয় দরজা বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় সাথে সাথে লাল বাতিটি জ্বলে উঠল। এর মানে হচ্ছে বাবা এখন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন, তার সাথে কথা বলা যাবেনা। আমি জানি এখন তিনি কি করবেন। বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধানের সাথে সরাসরি কথা বলবেন যোগাযোগ মডিউলের সাহায্যে।
পকেট থেকে একটা এয়ারবাড বের করে কানে প্রবেশ করালাম। আজকের কথোপকথনটুকু আমিও শুনতে পাব। বাবা টের পায়নি, তার অলক্ষ্যে একটা ছোট্ট বাগ লাগিয়ে রেখে এসেছি ঐ অদ্ভুত যন্ত্রের গায়ে। প্রতিপদার্থের তৈরি এই বাগ, নির্দিষ্ট সময় পর নিজ থেকে মিশে যাবে যন্ত্রের গায়ে। বাবা ঘুণাক্ষরেও সেটা জানতে পাবে না।
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি, “মহামান্য সভাপতি আমাকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ”।
অপর প্রান্ত থেকে কিছু বলা হল।
বাবা আবার বলল, “আমার মনে হয় আবার সময় চলে এসেছে। ওর মনে সন্দেহ দানা বাঁধছে, প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে চাইছে”।
আবার নিরবতা। অপর প্রান্ত থেকে কিছু একটা বলা হচ্ছে।
“না, এসবে কাজ হবেনা। আমার মনে হয় চুরান্ত ব্যবস্থা গ্রহন করা আবশ্যক!”
আবার নিরবতা।
“ঠিক আছে, দ্রুত ব্যবস্থা করুন”।
কথোপকথন শেষ হয়েছে। আমি কান থেকে এয়ারবাড খুলে নিলাম। আমি আজ এমন কিছু জেনে ফেলেছি যা আমার জানার কথা নয়!
****
“রিমন, তুমি কি সুস্থ মস্তিষ্কে কথা গুলো বলছ?”
কফির কাপে চুমুক দেয়ার ফাকে দেখে নিলাম আমার বডিগার্ড রোবট দুটি মোটামোটি দূরে আছে। এইমাত্র নুবি আমাকে কেলভার মেটালের তৈরি একটা লকেট উপহার দিয়েছে। লকেট থেকে চোখ ফিরিয়ে আমি নুবির দিকে তাকালাম।
“হ্যা, নুবি”।
“কিন্তু এটা কিকরে সম্ভব?”
“আমি জানিনা কিভাবে সম্ভব। কিন্তু এটাই সত্যি। আমার বয়সের সাথে সাথে দৈহিক বৃদ্ধি হচ্ছেনা। তোমার সাথে আমার পরিচয় দু বছর আগে একটা বিজ্ঞান বিষয়ক সেমিনারে।
তোমার কি মনে হয় গত দু বছরে আমার শরীরে একটুও পরিবর্তন এসেছে?”
“দু বছর খুব অল্প সময়, রিমন”।
“কিন্তু ১০ বছর অল্প নয় নুবি। ব্যাপারটা সিরিয়াস। গত দশ বছরে আমার শারীরিক বৃদ্ধি হয়নি একচুলও”।
“এটা কোন হরমোনজনিত সমস্যা হতে পারে”।
“ঠিক আছে মেনে নিলাম। কিন্তু আর একটা বিষয় দেখানো দরকার তোমাকে”। আমি একটা চাকু হাতে তুলে নিলাম ডান হাতের তালুতে একটা পোঁচ দিলাম। সাথে সাথে গভীরভাবে কেটে রক্ত বেরিয়ে এল।
“রিমন তুমি কি করলে এটা?” আঁতকে উঠল নুবি।
“রিল্যাক্স! কিচ্ছু হবেনা”।
নুবি অবাক চোখে দেখল আমার হাতের ক্ষতচিহ্নটি আপনা থেকেই ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। সে চিৎকার করে উঠল, “মাই গড! ইউ ক্যান হিল”!!
“ইয়েস, আই ক্যান”।
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, রিমন। এটা কিভাবে সম্ভব?”
“আমি জানিনা নুবি।
তবে এমন উত্তর না জানা আরও হাজারো প্রশ্ন আছে। গতকাল আমি আড়ি পেতে বাবাকে কথা বলতে শুনেছি বিজ্ঞান কাউন্সিল প্রধানের সাথে। বাবা বলেছেন আমি কিছু একটা সন্দেহ করছি। খুব তাড়াতাড়ি সত্য জেনে ফেলব। বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে বলেছে দ্রুত ব্যাবস্থা নেওয়া হবে”।
নুবির চোখে উদ্বেগ, “কেন রিমন, কেন হচ্ছে এসব তোমার সাথে?”
“কিছু একটা রহস্য লুকিয়ে আছে আমার মাঝে নুবি। আমার বাবা বা বিজ্ঞান কাউন্সিল চায়না আমি সেই রহস্যের সন্ধান পাই”।
নুবি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বলে চলেছি, “তবে আমার কি মনে হয় জান? আমি সম্ভবত এই রহস্যের উত্তর জানি। অন্তত আমার অবচেতন মন জানে।
সেজন্যই আমি প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখি। এই দুঃস্বপ্নের মাঝেই সব উত্তর লুকিয়ে আছে”।
“কিন্তু তুমি তো এই দুঃস্বপ্ন খুব বেশিদিন যাবত দেখছ না!”
“হ্যা। আমার যখন ২০ বছর বয়স তখন আমার মা মারা যায় এবং তারপর থেকেই আমার দুঃস্বপ্ন দেখার শুরু। প্রায় একই সময় থেকে আমার দৈহিক বৃদ্ধি গেছে থেমে।
আমার কেন যেন মনে হয় আমার দুঃস্বপ্নগুলো আসলে কল্পনা নয়, খুব বেশি জীবন্ত। আমার স্মৃতি নিয়ে কেউ খেলছে নুবি। মনে হচ্ছে আমার যে স্মৃতি আছে তা পূর্ণাঙ্গ নয়। কিছু স্মৃতি ভুলে গেছি আমি”।
“সেক্ষেত্রে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব”।
“কিভাবে?”
“মেডিকেল সায়েন্স বিভাগ মানসিক সমস্যা গ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য একটা বিশেষ সিমুলেশন টেকনিক আবিস্কার করেছে। এর সাহায্যে মানুষকে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করা হয়। তুমি যদি সত্যিই কোন স্মৃতি হারিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। এই জন্য কিছু ইকুইপমেন্ট আর খুব রেয়ার একধরনের ইঞ্জেকশন প্রয়োজন”।
“তুমি কিভাবে এগুলো যোগাড় করবে?”
নুবি ঠোঁট টিপে হাসল।
“ভুলে যাচ্ছ কেন? আমি একজন জীববিজ্ঞানী, গবেষণার কাজে প্রয়োজন বলে নিজের আইডি দেখিয়ে ওগুলো যোগাড় করা খুব বেশি সমস্যা হবেনা”।
“কিন্তু ওরা যদি ধরে ফেলে তোমার এগুলো নেওয়ার উদ্দেশ্য গবেষণার জন্য নয়?”
“সেটা বুঝতে ওদের অন্তত দুদিন সময় লাগবে। ততদিনে আমাদের কাজ হয়ে যাবে”।
“কিন্তু একদিন তো ওরা জানবেই, তোমার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে নুবি”।
“তোমার চাইতে ক্যারিয়ার বড় নয় আমার কাছে”।
হাত বাড়িয়ে নুবির একটা হাত দুহাতের মাঝে তুলে নিলাম আমি। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। নুবি আছে বলেই তো বেঁচে আছি, ও না থাকলে এই একঘেয়ে বেঁচে থাকার আশা আমার অনেক আগেই নিঃশেষ হয়ে যেত।
****
আমার পায়ের নিচে পাহাড়ের চুড়ো, সম্মুখে বিশাল সাগর। আমি প্রস্তুত হচ্ছি, এক মুহূর্ত পরেই আলিঙ্গন করে নেব মৃত্যুকে।
আরও একটি শেষ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে হবে সকল জাগতিক যন্ত্রণার অবসান। শেষবারের মত চিরচেনা পৃথিবীকে একনজর দেখে নিয়ে আমি ঝাপ দিলাম, আপন করে নিলাম ভীষণ শূন্যতাকে। পতনের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। সামুদ্রিক বাতাস কানের দুপাশ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যাওয়ার সময় ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে “আর কয়েক মুহূর্ত পরেই তোমার মুক্তি”।
যেন একযুগ পরে আমার দেহ লবণাক্ত পানির স্পর্শ পেল।
কি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা! শরীরে কাপন ধরে যাওয়ার এক তীব্র অনুভূতি। আমি হারিয়ে যাচ্ছি অতলে, গভীর থেকে গভীরে। প্রশ্বাসের সাথে বুক ভরে যাচ্ছে লোনা পানিতে। বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে, পুরে যাচ্ছে অক্সিজেনের অভাবে। মুক্তি এত কঠিন কেন?
কোথায় সমুদ্র? এতো দেখছি ব্যাস্ততম এক সড়ক।
আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি করছি? গায়ের পাশ ঘেঁষে ছুটে যাচ্ছে দূরপাল্লার ভারী যানবাহন। নাহ, ওরা যানবাহন কেন হতে যাবে? ওরা আমার মুক্তির দূত। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি একটা যাত্রীবাহী বাস। আমার মুক্তির পয়গাম নিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসছে। আমি দু হাত প্রাসারিত করে করে চেয়ে আছি সেই বিশাল মুক্তিকে গ্রহন করার জন্য।
একমুহূর্ত বাদেই লক্ষ করলাম জাহাজের নির্জন ডেকে বসে সমুদ্রের ঢেউ অবলোকন করছি। মৃদু ঢেউয়ের ধাক্কায় দোদুল্যমান অনুভূতি নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্র ডাকছে আমায়, কোন অপ্রতুল মাদকের প্রতি আসক্ত ভবঘুরের মত আমি এগিয়ে গেলাম ডেকের কিনারে। ঝাপ দেব বলে প্রস্তুত, আরও একবার মুক্তির দ্বারপ্রান্তে আমি। দেহটা পানি স্পর্শ করতেই আবার সেই তীব্র অনুভূতি! এই অনুভূতি আমার অনেক দিনের চেনা।
মুক্তির নেশায় আসক্ত ক্রীতদাসের প্রচণ্ড আর্তনাদ শুনছি সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে।
কিন্তু এটা কি হচ্ছে? আমার প্রসারিত দুহাতে অস্ত্র কেন? আর কোথায় গেল ব্যাস্ত সড়ক? এতো এক যুদ্ধের ময়দান। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। আমি অনবরত গুলি করে চলেছি আর দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি সম্মুখে শত্রুর অবস্থান বরাবর। আমার মনে ভয় ডর বলে কিছু নেই।
আমি স্বাধীনতার নেশায় বুঁদ। হঠাৎ বুকে ভারী বুলেটের ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লাম। সমস্ত দম বেরিয়ে গেছে বুক থেকে। বার কয়েক কেশে উঠলাম। তবে কি এই আমার মুক্তি?
নাহ! ওটা মুক্তির নামে ছিল প্রহসন।
নইলে আমি এখন একটা চলন্ত মহাকাশযানে কেন? ওজনের তারতম্যের ঝক্কি সামলে মহাকাশযানটির হ্যাচ বরাবর দাঁড়িয়ে যেতে খুব বেশি বেগ পেতে হলনা। হ্যাচ ধরে টান দিতেই সম্মুখে দেখলাম বিশাল শুন্যতা। এই শূন্যতার ভিড়ে কোথাও হারিয়ে যাব আমি আজ। নাহয় এটাই হোক আমার মুক্তির নামান্তর। বিশাল শূন্যতাকে গ্রহন করে নিলাম অনায়াসেই।
শরীরের ওপর আর কোন নিয়ন্ত্রন নেই, ভেসে চলেছি অজানার উদ্দেশ্যে। অনেক দূরে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখতে যাচ্ছে। তার উজ্জ্বল আভা যেন প্রশ্ন করে চলেছে “তুমি মুক্তি চাও নাকি মৃত্যু চাও”। এই প্রশ্ন আমাকে করা অবান্তর। আমার কাছে মুক্তি বা মৃত্যু ভিন্ন কিছু নয়।
ধীরে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। নক্ষত্রের অবয়বটি ক্রমশ কোন মানব মূর্তির আঁকার ধারন করছে। এই মুখশ্রী আমার অনেক দিনের চেনা, অনেক বেশি আপন। এটা নুবি, আমার নুবি। নক্ষত্র মিলিয়ে গিয়ে সেখানে নুবির মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠল।
তার চোখ দুটো আমাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে চলেছে, “তুমি কি মুক্তি চাও, তুমি কি মৃত্যু চাও?”
“না, নুবি আমি মৃত্যু চাই না। অন্তত তুমি যতক্ষণ পাশে আছ ততক্ষন নয়! আমার মুক্তি তোমার মাঝে, মৃত্যু আমার মুক্তি নয়”।
“কি আবল তাবল বলছ তুমি, রিমন?”
নুবির কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম। আমি শুয়ে আছি বিছানায়। মাথা হাত বুক ও শরীরের অন্যান্য অংশে নানান ইকুইপমেন্টের সংযোগ।
আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম। নুবি বাধা দিল “আস্তে! ওষুধের প্রভাব কাটতে কিছুক্ষন সময় লাগবে”। সে ব্যাস্ত হাতে আমার শরীর থেকে ইকুইপমেন্টগুলোর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় মনযোগী হল। বলল, “কি কিছু উপকার হল”।
“হ্যা”।
আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
“কি জানতে পারলে?”
“বিজ্ঞানী ইরিদ আমার বাবা নন। আমার ২০ বছর বয়সে আমার মা মারা যাননি। সমস্ত স্মৃতি মিথ্যে। আমার মাথায় ২০ বছর বয়স পর্যন্ত সময়ের অসংখ্য স্মৃতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যার পুরোটাই মিথ্যে”।
“তাহলে সত্যি কি?”
“আমার জন্ম দেড় হাজার বছর পূর্বের পৃথিবীতে। আমার আসল বাবা ছিলেন কৃষক। আমার বাবা মার মৃত্যু হয়েছে আমার সামনে। তখন আমি ২৫ বছরের যুবক। এর পর আরও অসংখ্য পরিবারের সাথে থেকেছি আমি, সবাই বুড়ো হয়ে একসময় মরে গেছে কিন্তু আমি মরিনি, আমি মরিনা, আমার বয়স বাড়েনা।
একসময় অতিষ্ঠ হয়ে মুক্তির নেশায় আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছি। অসংখ্যবার চেষ্টা করেছি মরে যেতে। পানিতে ডুবেছি, সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েছি, পাহারের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, গুলি খেয়েছি- কিন্তু আমি মরতে পারিনি, কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে”।
নুবিকে একটুও বিচলিত মনে হচ্ছেনা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি ব্যাপার নুবি? তুমি অবাক হচ্ছনা একথা শুনে?”
“না, আমি পুরো বিষয়টা আন্দাজ করতে পারছিলাম”।
“কিভাবে?”
“এখানে আসার আগে আমি আমাদের বিজ্ঞান কাউন্সিলে ডাটাবেজে খোঁজ নিয়েছি। তুমি তো জানই বিজ্ঞান কাউন্সিলের ডাটাবেজে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ সম্পর্কে তথ্য রাখা আছে। তোমারটাও আছে। একজন সদস্য হিসেবে সে তথ্য জানার অধিকার আমার আছে। কিন্তু আমাকে সেই তথ্য জানতে দেওয়া হচ্ছেনা।
বলা হচ্ছে তুমি সম্পর্কে সকল তথ্য ক্লাসিফাইড। শুধুমাত্র প্রধান বিজ্ঞানী সভার সদস্য না হলে এই তথ্য জানা যাবেনা। তারপর আমি একজন প্রধান বিজ্ঞানী সভার সদস্যের পাস চুরি করে তথ্যটুকু বের করে এনেছি। সেখানে শুধু দুটো বাক্য বলা তোমার সম্পর্কে বলা আছে, ১. তুমি একজন অমর মানুষ ২. বিজ্ঞান কাউন্সিলের সর্বোচ্চ দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি হল তোমাকে রক্ষা করা। এর চেয়ে বেশি তথ্য জানার অধিকার একমাত্র বিজ্ঞান কাউন্সিল প্রধান ছাড়া কারো নেই”।
“তুমি এত বড় ঝুকি নিয়েছ কেন?”
“তোমার জন্য রিমন... আমি যেকোনো ঝুঁকি নিতে পিছপা হবনা”।
“কিন্তু এখন কি হবে? ধরা পরলে ওরা তো আমাদের কঠিন শাস্তি দিবে!”
“আমরা পালিয়ে যাব”। নুবির চোখে মুখে দৃঢ়তা।
“কিন্তু প্রতিরক্ষা রোবটগুলো আমাদের ঠিকই ধরে আনবে। ওরা ওদের ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে যেকোনো জিনিসের সন্ধান পেয়ে যায়।
পৃথিবীর কোন প্রান্তই আমাদের জন্য নিরাপদ নয়”।
“সেটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও”। নুবির ঠোঁটের কোনে হাসির আভাস। “ তুমি তো জানই প্রতিটি প্রতিরক্ষা রোবট ফ্রিকোয়েন্সি দ্বারা একটি অন্যটির সাথে কানেক্টেড। আমি ওদের ফ্রিকোয়েন্সিতে একটা ভাইরাস আপলোড করে দিয়েছি।
ওদের পক্ষে এখন আর তোমাকে আইডেন্টিফাই করা সম্ভব নয়। আমরা পৃথিবীর উত্তর প্রান্তের কোন বিরান অঞ্চলে পালিয়ে গিয়ে পরিচয় গোপন করে নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারব। ”
আমি নুবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। অস্ফুট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে বসলাম, “আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তুমি আমার পাশে থাকবে তো?”
নুবি হাসল। “কথাটা উলটো করে বললে ভাল হবে রিমন।
তোমার নয়, আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তোমার পাশে থাকব”।
আমিও হাসলাম। নুবির কথাই ঠিক। আমাদের সংসার হবে, সন্তান হবে, ভালবাসার মেয়েটি ধীরে ধীরে বুড়িয়ে যাবে, একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। কিন্তু আমি থাকব একই রকম।
তাতে কি? একটা জীবন এই মেয়েটির সাথে পার করে দিতে পারলে আমার আর কিছুই না পাওয়া থাকবেনা। এই মৃত্যুহীন অস্তিত্ব নিয়ে সারাজীবন আমার যে আক্ষেপ ছিল তা এক পলকেই দূর হয়ে গেল। নিজের এই বেঁচে থাকাটা সার্থক হয়েছে নুবির জন্য। দেড় হাজার বছর পর জীবনে এসেছে সত্যিকারের ভালবাসা।
****
ঘাড়ের কাছে একটা শীতল স্পর্শ টের পেলাম।
ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার। আমি শুয়ে আছি বাম দিকে কাত হয়ে। নুবি আমার বাহুতে মাথা রেখে বাচ্চাদের মত আমার বুকের কাছে গুঁটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। জানালার ফাক গলে অল্প একটু জ্যোৎস্নার আলো এসে বিছানায় পড়ছে।
সেই আলোতে এই অনিন্দ্য সুন্দর মেয়েটির দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। তবে ঘুম ভেঙে যাওয়ার কারণটা পরিষ্কার নয়।
আরও একবার ঘাড়ের কাছে শীতল ছোঁয়া! এবার টের পেলাম কি ওটা। সম্ভতবত অন্ধকারে কেউ একজন আমার ঘাড়ের কাছে অস্ত্র ঠেকিয়ে রেখেছে। তবে যেই হোক, তার উদ্দেশ্য আমাকে মারা নয়, গ্রেফতার করা! দ্রুত হাতে বালিশেরর নিচে তল্লাশি চালালাম স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের খোঁজে।
পিস্তলের বাটটা হাতে পড়তেই এক ঝটকায় উঠে বসলাম।
ঠিক সাথে সাথেই কয়েকশ পাওয়ারের লাইট জ্বলে উঠল। তীব্র আলো থেকে বাঁচার জন্য আমি এক হাত দিয়ে চোখ আড়াল করলাম। এরই ফাকে দেখে নিয়েছি ঘরের ভেতর পাঁচ-ছয়টি কিম্ভুতদর্শন রোবট, সবার হাতেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। এরা প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত।
কিন্তু আমার খোঁজ ওরা পেল কি করে? নুবি তো ওদের ট্র্যাকিং ফ্রিকোয়েন্সিতে ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে এসেছিল!
মুহূর্তেই ব্যাপারটা বুঝলাম আমি। মারাত্মক একটা ভুল হয়ে গেছে আমাদের। ভাইরাসের কারনে প্রতিরক্ষা রোবটদের পক্ষে আর আমাকে চেনা সম্ভব নয়। কিন্তু এরা নুবিকে ঠিকই চেনে। তাই নুবির সুত্র ধরে এসে আমাকে বের করে ফেলেছে।
সম্ভবত প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে ওদের বলা হয়েছে নুবির সাথে যাকে পাওয়া যাবে সেই হচ্ছে রিমন!
একটি রোবট যান্ত্রিক সুরে বলল, “মিস্টার রিমন। অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করুন”।
আমি প্রমাদ গুনলাম। নিজের জন্য চিন্তা হচ্ছেনা, সব চিন্তা নুবিকে নিয়ে। আমাকে মারার ক্ষমতা এদের নেই।
কিন্তু নুবিকে ধরে নিয়ে গিয়ে যদি নিয়ম ভঙ্গের জন্য কঠিন শাস্তি দেয়!
ঘাড়ের কাছে আবারো খোঁচা। খুব বেশি চিন্তা করার সময় নেই। আমি সামনের রোবটটির কপোটন লক্ষ করে গুলি করে বসলাম। নিঃশব্দ মৃত্যু বর্ষণ, মুহূর্তে হাটু ভাজ হয়ে পড়ে গেল রোবটটি। অপর একটি রোবট গুলি ছোরার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এটারও কপোটন গুঁড়িয়ে দিলাম।
এবার ডান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোবটটির দিকে মনোযোগ দিলাম কিন্তু গুলি করার আগেই ঘাড়ের কাছটায় তীব্র ইলেক্ট্রিক শক সমস্ত শক্তি শুষে নিল। উপুর হয়ে বিছানায় পড়লাম, সারা শরীর কাঁপছে। কয়েক সেকেন্ড বাদেই অজ্ঞান হয়ে যাব, তাকিয়ে আছি নুবির দিকে। কি সুন্দর ঘুমিছে আছে নিশ্চিন্ত মনে!
***
বার কয়েক চোখ মিট মিট করতেই চোখের সামনে পৃথিবীটা পরিষ্কার হয়ে এল। এই যায়গা আমার অনেক দিনের পরিচিত।
এটা বাবার ল্যাব। আমি বসে আছি একটা চেয়ারে। হাত-পা চেয়ারের সাথে শক্ত ইলাস্টিক রোপ দিয়ে বাধা। সামনেই বসে আছে বাবা। তার চোখে মুখে কৌতূহল।
নুবিকে কোথাও দেখছি না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “নুবি কোথায়?”
বাবা হাসল, “নুবি ফিরে গেছে তার আপন ভুবনে, তার কর্মক্ষেত্রে”।
“নুবি আমাকে ফেলে কাজে ফিরে গেছে! এটা অসম্ভব”।
“সম্ভব, কারন ও এখন আর তোমাকে চেনেনা। নুবির মস্তিস্ক থেকে তোমার সকল স্মৃতি মুছে দেওয়া হয়েছে।
তীব্র এক হতাশার অনুভূতি গ্রাস করল আমাকে। কয়েক মুহূর্ত কিছুই ভাবতে পারলাম না। তারপর আস্তে ধীরে বললাম, “আমাকে বাদ রাখা হল কেন? আমাকেও সব কিছু ভুলিয়ে দিচ্ছ না কেন তোমরা?”
“হুম.. বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আনা হচ্ছে। তোমার সমস্ত স্মৃতি মুছে দিয়ে নতুন স্মৃতি প্রবেশ করান হবে, দেওয়া হবে নতুন পরিচয়। এখনও কাজটা করা হয়নি আমার অনুরোধে।
আমি চাইছিলাম সব কিছু ভুলে যাওয়ার আগে তুমি সবটুকু জেনে নাও”।
“সর্বমোট কতবার আমাকে এভাবে স্মৃতি ভুলিয়ে নতুন স্মৃতি দেওয়া হয়েছে?”
“আমার অধীনে মোট তিন বার তোমার পুনর্জন্ম হয়েছে। এর আগে আমার শিক্ষকের অধীনে ছিলে তুমি। আমার পরে অন্য কারো অধীনে নেওয়া হবে। প্রতিবার ঠিক ১০ থেকে ১২ বছরের মাথায় তুমি নিজ সম্পর্কে সবটুকু জেনে যাও।
আর জানার পর পরই খুব ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠো, আত্মঘাতী কাজ কর, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা কর। তাই তোমার কাছ থেকে তোমাকে রক্ষা করতেই প্রতি ১০ বছর পর পর তোমার স্মৃতি রিবুট করতে হয়”।
“কেন এমন হচ্ছে আমার সাথে? আমার বয়স বাড়েনা কেন? আমি অমর হলাম কিকরে?” একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে বসলাম আমি।
“এই সব প্রশ্নের উত্তর আমারও জানা নেই। তোমার সম্পর্কে সব তথ্য জানার অধিকার একমাত্র বিজ্ঞান কাউন্সিল প্রধান ছাড়া আর কারো নেই।
অনুমান নির্ভর হয়ে বলতে পাড়ি, সম্ভবত তুমি গোপন কোন প্রজেক্টের অংশ, কিন্তু এই প্রজেক্টের কি উদ্দেশ্য তা আমি জানিনা”।
আমি চুপ করে থাকলাম।
বাবা প্রশ্ন করলেন, “আর কিছু জানতে চাও তুমি?”
“না”
“ব্যাস! প্রতিবার তো তুমি অসংখ্য প্রশ্ন কর। এইবার আর কিছু জানতে চাইছ না কেন?”
“যত দ্রুত সম্ভব আমাকে আমার স্মৃতি ভুলিয়ে দাও”। নুবির কথা মনে হচ্ছে বার বার।
নুবিহীন বেঁচে থাকার কথা ভাবতেও অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা হচ্ছে।
“একটু অপেক্ষা কর। বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে সরঞ্জাম এলেই ব্যবস্থা নেব”।
আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। বাবা উঠে ল্যাবের অপর প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেল তার সেই কিম্ভূতকিমাকার টাইম মেশিনের কাছে।
ঝুঁকে পরে কাজ শুরু করল।
কিছু মুহূর্ত পেরিয়ে গেল। আমার তন্দ্রামত এসছিল, হঠাৎ মাথার অভ্যন্তরে তীক্ষ্ণ একটা ব্যাথা অনুভব করলাম। কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। “রিমন!! রিমন!!”
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “কে? কে ডাকে?”
আমার মাথার ভেতরে থেকে উত্তর এল, “আমরা”।
“কোথথেকে কথা বলছ তোমরা?”
“আমরা কথা বলছি অনেক ভবিষ্যতের এক পৃথিবী থেকে। এ এমন এক পৃথিবী যেখানে সব কিছুই আছে, শুধু মানুষ বলে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। সমস্ত মানবজাতি হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে”।
বিষয়টা আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা, এটা কোন কল্পনা নয়ত? আমি কোন স্বপ্ন দেখহি না তো? জিজ্ঞেস করলাম, “কারা তোমরা?”
“আমাদেরকে বোঝার সাধ্য তোমার নেই রিমন। আমরা মানবজাতির হিতাকাঙ্খি।
আমরাই তোমাকে এতদিন বাচিয়ে রেখেছি। প্রতিবার মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়ার পর আমরা তোমাকে ফিরিয়ে আনি। আমরাই তোমার জিনে খুব সুক্ষ কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে বয়সটা একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে আঁটকে রেখেছি”।
“কিন্তু কেন করেছ তোমরা এটা?” আমি অস্থির কণ্ঠে বললাম।
“মানবজাতিকে রক্ষার করার জন্য, রিমন।
মানবজাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার হাতে। তুমিই শুধু পার মানবজাতিকে সম্ভাব্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে”।
“আমি কীভাবে মানবজাতিকে রক্ষা করব?” এতক্ষনে আমি একটু ধাতস্থ হতে পেরেছি।
“বিজ্ঞানী ইরিদ, যাকে তুমি বাবা বলে ডাক সে আর কিছুক্ষন বাদেই তার টাইম মেশিন তৈরির কাজে সফল হবে। তার আগেই তোমাকে যন্ত্রটা ধ্বংস করে দিতে হবে রিমন।
তাহলেই মানুষ রক্ষা পাবে”।
“আমি কিছু বুঝতে পারছিনা”। অসহায় কণ্ঠে বললাম আমি।
“রিমন, মানবজাতীকে সময় পরিভ্রমনের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি কারন এই ক্ষমতা তোমাদের টাইম লাইন ভেদে সাহায্য করবে। তোমরা নিজেদের খেয়াল খু।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।