গত রোববার রাতে দিল্লির জওহরলাল ইউনিভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষার্থী এসেছিলেন আমাদের অস্থায়ী আবাস হোটেল সাংগ্রিলায়। তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম ভারতের রাজনীতির হালফিল সম্পর্কে। তাঁরা জানান, এক ভারতের মধ্যে রয়েছে বহু ভারত। এই ভারতেরই একটি শক্তি কয়েক দিন আগে মুজাফফরনগরে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ লাগিয়ে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। আবার এই ভারতেরই বহু শুভবোধসম্পন্ন মানুষ সেই মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।
তাঁদের প্রতিবাদের কারণেই উত্তর প্রদেশ সরকার বিলম্বে হলেও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী মুজাফফরনগর গিয়েছেন। উত্তর প্রদেশ সরকার নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর সদস্যদের সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব উপদ্রুত এলাকায় গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন।
ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মুজাফফরনগরে এই সাম্প্রদায়িক উসকানির পেছনেও ভোটের রাজনীতি কাজ করেছে।
দাঙ্গার উসকানিদাতারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, বর্তমানে যাঁরা কেন্দ্রে ও উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা সংখ্যালঘু মুসলমানের নিরাপত্তা বিধান করতে পারছেন না। অতএব, নিরাপত্তা চাইলে বিরোধী দলকেই ক্ষমতায় আনতে হবে। মুসলিম-অধ্যুষিত মুজাফফরনগর এলাকায় ১২টি লোকসভা আসন আছে। বর্তমানে সেখানে মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী দল ক্ষমতায় আছে, যারা কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারকে সমর্থন করছে।
এক ভারতের মধ্যে বহু ভারতের আরেকটি চিত্র তুলে ধরলেন দিল্লির কয়েক সাংবাদিক বন্ধু।
আলাপচারিতায় তাঁরা জানান, কয়েক দিন আগে নয়াদিল্লি ইউনিভার্সিটির ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বিজেপি-সমর্থিত ছাত্রসংগঠন। কিন্তু জওহরলাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ঠিক এর বিপরীত ফল ঘটবে বলে আশা করছেন তাঁরা। সেখানে বিজেপি কিংবা কংগ্রেস-সমর্থিত নয়, বরং বামফ্রন্ট-সমর্থিত ছাত্রসংগঠনই অনেক দিন ধরেই আধিপত্য বিস্তার করে আছে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে দিল্লির ধারণা কী, জানতে চাইলে তাঁরা আরও অনেক ভারতীয়র মতো জানান, বাংলাদেশ সম্পর্কে এখানকার মানুষ তেমন জানে না। পত্রপত্রিকায় কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের খবর তেমন প্রচার হয় না, বরং পাকিস্তান সম্পর্কে তাঁরা অনেক বেশি জানেন।
এই না-জানার জন্য বাংলাদেশ নাকি ভারতের দায় বেশি, সে সম্পর্কে পরে লিখব। আপাতত ২০১৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। বিশেষ করে, ১৩ সেপ্টেম্বর গুজরাটের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিজেপি আগামী নির্বাচনে তাদের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করার পর দিল্লিতে বিরোধী শিবিরে যেমন জয়োল্লাস লক্ষ করা গেছে, তেমনি ক্ষমতাসীন শিবিরে একধরনের শঙ্কা ও অস্থিরতা কাজ করছে। অনেকে বলেন, মোদি আসছেন। মোদির আসা মানে সাম্প্রদায়িকতার পুনরুত্থান।
বিজেপিতে নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে যে বিতর্ক চলছিল, তা তিনি নিজেই অনেকটা সামাল দিয়েছেন। দলের প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। দলের প্রধান রাজনাথ সিংসহ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাও আদভানিকে বোঝাতে চাইছেন যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়তে হলে নরেন্দ্র মোদির বিকল্প নেই।
ক্ষমতাসীন শিবিরে অস্থিরতার বড় কারণ, প্রধানমন্ত্রী পদে উপযুক্ত প্রার্থী নেই। মনমোহন সিং ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী পদে লড়বেন না।
সে ক্ষেত্রে তিনিসহ দলের একাংশ সোনিয়া-তনয় রাহুল গান্ধীর নাম প্রস্তাব করলেও দলের সভানেত্রী এখনো তাঁর ব্যাপারে মনস্থির করতে পারছেন না। প্রথমত, নরেন্দ্র মোদিকে মোকাবিলা করার মতো অভিজ্ঞতা ও ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারেননি রাহুল। দ্বিতীয়ত, মনমোহন সিং নিজে শতভাগ সৎ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী হলেও, তাঁর সরকারের আমলে বড় বড় কয়েকটি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে এবং একটিরও বিচার হয়নি। বিজেপি স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নির্বাচনী ইস্যু করবে। তৃতীয়ত, সাম্প্রতিক কালে অর্থনৈতিক মন্দা, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে রুপির দাম কমে যাওয়ায় সরকার ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে।
বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্যনিরাপত্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সরকার অতি সম্প্রতি সংসদে খাদ্যনিরাপত্তা বিল পাস করলেও এর সুফল তো জনগণ এখনই পাচ্ছে না। ফলে ভোটের রাজনীতিতে তার ফায়দা তোলাও সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে, সাংগঠনিকভাবেও কংগ্রেস বেশ নাজুক অবস্থায় আছে। দীর্ঘদিন পর পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের দুর্গ ভেঙে পড়লেও তার ফায়দা নিয়েছে তৃণমূল, কংগ্রেস নিজের ঘরে ফসল তুলতে পারেনি। ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের আসনসংখ্যা আরও কমেছে।
একদা শক্তিশালী ঘাঁটি বলে পরিচিত অনেক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটেছে। রাহুল-ম্যাজিক কোনো কাজে লাগেনি।
দুর্নীতির ভয়াবহ থাবা যখন কংগ্রেস রোধ করতে পারেনি, তখন তার হাতে যে মোক্ষম অস্ত্রটি আছে, তা হলো প্রগতির পতাকা এগিয়ে নেওয়া, অসাম্প্রদায়িক ভারত প্রতিষ্ঠার স্লোগান। মোদি রোববার হরিয়ানায় দলের এক জনসভায় ইউপিএ সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, ‘আমরা তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ পেয়েছি মুজাফফরনগরের দাঙ্গায়। ’ তিনি পুরো নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন।
ওই জনসভায় একজন সাবেক সেনাপ্রধানসহ অবসরপ্রাপ্ত বেশ কিছু সামরিক ও বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। এবারে বিজেপির নির্বাচনী স্লোগান হলো ‘এক নম্বরে ভারত’। আগের স্লোগান ছিল ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’। মোদি ভারতে বাংলাদেশিদের অবৈধ অনুপ্রবেশের জন্য ইউপিএ সরকারকে অভিযুক্ত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি মুজাফফরনগরের ঘটনা ও দিল্লির আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য সমালোচনা করেছেন উত্তর প্রদেশ সরকার ও দিল্লি সরকারের।
মোদি যদিও সংখ্যালঘুদের ভোটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য ইউপিএকে অভিযুক্ত করেছেন, তাঁর দলও তাদের সেই একইভাবে ব্যবহার করতে চাইছে। গুজরাটের দাঙ্গায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামির পক্ষে এত দিন আইনি লড়াই চালিয়ে গেলেও, এখন সরাসরি এই বিচারের বিরোধিতা করছে গুজরাট সরকার।
তবে বিজেপি বা মোদির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে জোটগত শক্তির ওপর। দিল্লির রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আগামী নির্বাচনে কোনো দলই এককভাবে সরকার গঠনের মতো আসন পাবে না। বিজেপির আসন বাড়লেও ১৭০ থেকে ১৮০-এর ওপরে উঠবে না।
৫৪২ আসনের লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে আরও প্রায় ১০০ আসনের প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলগুলোর ওপরই দুই প্রধান দলকে নির্ভর করতে হবে। আগামী নির্বাচনের আগে দুই জোটেই অনেক ভাঙাগড়া হবে।
সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, বলা মুশকিল। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার ইতিমধ্যে এনপিএ জোট ছাড়লেও ইউপিএ জোটে যোগ দেননি।
সেখানকার প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রীয় জনতা দলের লালু প্রসাদ। একইভাবে উত্তর প্রদেশে মুলায়ম সিং যাদবের প্রতিদ্বন্দ্বী মায়াবতী। যাদব ইউপিএ জোটে গেলে মায়াবতী এনডিএ জোটেই নিজেকে দেখতে চাইবেন। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে ও আন্না ডিএমকের পরস্পরবিরোধী জোটে যাওয়ার নজির দুই দশক ধরে। এখানে নীতি ও আদর্শের চেয়ে ক্ষমতা ও আঞ্চলিকতাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিজেপির সঙ্গেই জোট বাঁধার সম্ভাবনা বেশি।
সে ক্ষেত্রে ভারতে আগামী নির্বাচনে যে জোটই সরকার গঠন করুক না কেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ঝুলে থাকা সমস্যাগুলো শিগগির সমাধানের সম্ভাবনা কম।
নয়াদিল্লি থেকে
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।