আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মরুভূমিতে কাশফুলের রাত্রিযাপন



মধ্যহ্ন বিরতির কিছুক্ষন পর (গত বৃহস্পতিবার) হঠাৎ ফোন বেজে উঠল । রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শফিক ভাই জিজ্ঞেস করল, মঈন ভাই (কাশফুলের ছদ্্বনাম) অনেকদিন হয়ে গেল মরুভূমিতে রাত কাটানো হয়না তো আজকে গেলে কেমন হয় ? আমিতো শুনেই মনে মনে দিলাম লাফ । এরপর তাকে বললাম, গেলেতো দারুন হয় কিন্তু এতো বড় আয়োজন এ অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে করবেন ? তিনি বললেন, আপনি ওগুলো নিয়ে একটুও ভাবনেনা আমি সব ম্যানেজ করে ফেলব । আর সুপার মার্কেটে গেলেই সব পাওয়া যাবে । আপনি শুধু ফোন করে জেনে নিন কে কে যেতে পারবে ।

এরপর শুরু হলো ফোন করা । প্রথমেই মামাকে ফোন করলাম, ভাবলাম তিনি নতুন আসছে আর এরকম সুযোগতো বারবার আসবেনা । মামা বলল, আসলেই দারুন প্রস্তাব, এরকম একটি সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবেনা কিন্তু তোমরা যে মরুভূমিতে থাকবে সেখানে টয়লেট আছেতো ? মামার এ প্রশ্নে আমি মোটেও অবাক হয়নি কারণ তাঁর কোন সমস্যা না থাকলেও এ ব্যাপারটি না জেনে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেননা । মামাকে বাদ দিয়েই আমরা পাঁচ জন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । 4টায় অফিস ছুটির পর পরই শফিক ভাই আর আমি ছুটে গেলাম সুপারমার্কেটে।

সেখানে গিয়ে সুপার মার্কেটের কর্মরত একজন বাংলাদেশীকে শফিক ভাই জিজ্ঞেস করল, কয়লা কোথায় পাওয়া যাবে ? উত্তরে তিনি বললেন, খুঁজে দেখেন গিয়া, যদি না পান তাইলে নাই। আমিও ব্যাপারটি শুনে কিছুটা ব্যথিত হলাম । কিছুদূর এগোতেই অন্য আর এক বাংলাদেশী মুখে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কি লাগবে ? আমি বলার একটু পরই তিনি আমাকে আমার কাঙ্খিত জিনিসটি সামনে এনে হাজির করলেন এবং আমার সাথে কুশল বিনিময়ও করলেন । আসলেই ভাল মন্দ সব জায়গাতেই এভাবে বিদ্যমান। কেনাকাটার পর্ব চুকাতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।

রুম থেকে ফ্লাঙ্ ভর্তি গরম চা এবং আনুষাঙ্গিক সব জিনিপত্রাদি গাড়িতে বোঝাই করে রওয়ানা দিলাম মরুভূমির পথে। পথে বসেই সবাইকে প্রতিজ্ঞা করানো হলো যে, কেউ ঘুমাতে পারবেনা। কারণ সবাই যদি ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে মরুভূমির হিংস্রপ্রানি আমাদেরকে আক্রমন করতে পারে। আর আমাদের কাছে তেমন কোন অস্ত্রও নেই যা দিয়ে আমরা প্রতিরোধ করবো। সন্ধ্যা সাতটায় পেঁৗছে গেলাম আমাদের চিরচেনা আবার অচেনা সেই মরুভূমির উচু পাহারের কাছে।

অচেনা বলছি কারণ এতোদিনে নতুন করে বালি পড়ে পথঘাট সব ভরে গেছে। গাড়ি নিয়ে পাহারের খুব কাছে যাবার পথ খুঁজে পাচ্ছিলামনা। গাড়ি থেকে নেমে অনেক খোঁজাখুঁজি পর পেয়ে গেলাম সেই চিরচেনা পথ। দূর থেকে দেখে মনে হয়েছে যদি পাহারটিকে বুকে আগলে ধরে আমার কষ্টগুলো ওর সাথে শেয়ার করা যেত তাহলে হয়ত অনেক হালকা হতে পারতাম। যদিও আমার সে রকম কোন কষ্ট নাই তারপরও আপনজনকে না দেখার কষ্টই আমাকে অনেক ব্যথিত কওে ।

কিছুক্ষন পর পরই গাড়ি আটকে যাচ্ছিল মরুভূমির বালুপথে। আস্তে আস্তে করে পেঁৗছে গেলাম আমাদের কাঙ্খিত জায়গায়। যদিও উপরে উঠতে খুব কষ্ট হয়েছে তারপরও এ কষ্টের মাঝেও একরকম আনন্দ আছে। তাড়াতাড়ি করে সবকিছু নামিয়ে বসার জায়গা করে প্রথমেই সালাত আদায় করে নিলাম। এরপর লাইট ফুড (ব্রেড, হালুয়া, হানি ক্রিম, সৌদি শ্যাম্পেন) দিয়ে প্রাথমিক ক্ষুদা মিটালাম।

খাওয়া-দাওয়ার পরেই ল্যাপটপ থেকে একের পর এক ভেসে আসতে লাগল সেই পরিচিত গান ঃ সে যেন আমার পাশে আজো বসে আছে, আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো, আমি জামিনী তুমি শশী হে, বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও, ঐ আকাশের তারায় তারায় চাঁদের জোছনায় ঝিরি ঝিরি কাঁপনতোলা উদাসী হাওয়ায়- এরকম আরও অনেক গান। গান শুনতে শুনতেই মোবারক ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করল, মঈন ভাই আপনিতো বললেন আজ চাঁদনী রাত কিন্তু এখন পর্যন্ত চাঁদের দেখা পাচ্ছিনা শুধু আকাশ ভর্তি তারাই দেখছি। আরো বললেন, অবশ্য আমি আগে শুনেছি রাতের আকাশে নাকি তারা খেলা করে তখন ভাবতাম এ আবার কেমন কথা? কিন্তু আজ সত্যিই আমি অবাক আসলেই তো এতো স্পষ্ট তারার সমরহ আমি জীবনে এই প্রথম দেখলাম"। আমার তখন ওই গানটা খুব মনে পড়ছিল, আকাশের ওই মিটিমিটি তারার সাথে কইবো কথা নাইবা তুমি এলে। হঠাৎ করেই ঘন মেঘের আড়াল থেকে অপরূপ রূপে সজ্জিত হয়ে চাঁদ আমাদের মাঝে উকি দিল।

চাঁদের আলোটা যখন আমার গায়ে এসে পড়ল অনাবিল আনন্দে মনটা ভরে গেল। অন্যরকম একটা পরশে আমার চোখ ছলছল করে উঠল। সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে আমার মাথা নুইয়ে আসছিল। বারবার শুধু তাঁকেই স্মরণ করছিলাম। এভাবেই চাঁদ তারার সাথে কেটে গেল অনেকটা মুহুর্ত।

এরপর শুরু হল দিত্বীয় পর্বে রাতের খাবারের আয়োজন। বারবিকিউ বানাতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মোবারক ভাই (দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক) আবার বারবিকিউ বানাতে খুব পারদর্শী। তাই তিনিই পুরো কাজটা তদারকি করলেন। তার সাথে ছিল শফিক ভাই (ক্যাপ পড়া)।

আর আমি ব্যস্ত রইলাম শুধু ছবি তুলতে। তাই আমার কোন ছবিও এ পোষ্টে এটাচ্ করতে পারিনি। চাঁদের আলোয় আমাদের খাবার খেতে কোন অসুবিধা হয়নি। সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। রাতের খাবারের পর্ব চুকিয়েই আবার শুরু হলো চাঁদেও জোছনায় স্নান করা আর তারার সাথে কথোপকথন।

ছোট বড় সব তারাগুলো প্রাপ্তির হাসির মতন একটু পর পরই হাসতে হাসতে চারিদিকে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে আর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটোছুটি করছে। অবশ্য আমার ব্লগ বন্ধুরা আমার চেয়ে অনেক ভাল করেই তার বর্ণনা দিতে পারবে। একটা সময় নিজেকে খুব দূর্ভাগা মনে করতাম কিন্তু সেদিন এই মনমুগ্ধকর মুহুর্তগুলো দেখে আমার মনে হয়েছে আমিও ভাগ্যবানদের মধ্যে একজন। স্মৃতিভান্ডারে জমে থাকা কিছু গান কোন প্লেয়ার ছাড়াই তখন বাজতে শুরু করল ঃ সে তারা ভরা রাতে আমি পারিনি বোঝাতে, এই রাত তোমার আমার- এরকম আরও অনেক গান একের পর বাজতেছিল। এবার পাহাড়ের চারিদিকে তেমন হাটাহাটি করিনি কারন সাথে বড় লাইট নিয়ে যাইনি।

আর পাহাড়ের চারিদিকে শুধু সাঁপের গর্ত। এক একটা পাহাড়ে অনেক সাঁপের বসবাস। কিছু সাঁপ আছে বালু রংয়ের এবং খুবই বিষাক্ত। এদের দংশনে ঘন্টাখানেকের মধ্যে কোন ব্যবস্থা নিতে না পারলে মৃতু্য নিশ্চিত। পাহারের চারিদিকে ইদুরগুলি ছুটোছুটি করে আর সাঁপগুলো বালুর মাঝে মুখ বের করে ওঁৎ পেতে থাকে ইদুর শিকারের আশায়।

আমরা বসেছিলাম যেখানে গর্ত নেই সেখানটায়। গান শুনতে শুনতে হঠাৎ আবিস্কার করলাম চারিদিক থেকে নাক ডাকার শব্দ পাচ্ছি। আমি ভেবেছিলাম হয়ত 2/1 জন ঘুমিয়েছে। কিন্তু তাকিয়ে দেখি আমি বাদে সবাই গভীর ঘুমে অচেতন। একেবারে খারাপ লাগছিলনা সে মুহুর্তটা।

মনে হয়েছিল আমি একাই এসেছি মরুভূমিতে চাঁদ তারার সাথে রাত কাটাতে। আবার ভয়ও হচ্ছিল এই ভেবে যদি আবার হিংস্রপ্রানী আক্রমন করে। তখন রাত আড়াইটা বাজে। আমার পকেট পিসি থেকে ফুল ভলিউম দিয়ে আবার গান চালু করে কিন্তু তাতে তাদের ঘুম মনে হয় আরও গাড় হলো। আবার কিছু ছবি তুললাম।

এরপর চাঁদ তারায় সাথেই কাটিয়ে দিলাম বাকি রাতটুকু। তারাগুলো যখন আলো ছড়িয়ে স্থান পরিবর্তন করছিল তখন বার বার প্রাপ্তির কথা মনে পড়ছিল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।