মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ১৯৮১ সালের ৩০শে মে, একটি নক্ষত্রের ঝরে পরা, শোকে মূহ্যমান জাতি - পর্ব ১
------------------------------------------------ ডঃ রমিত আজাদ
তখন আমি নিতান্তই বালক। সকালের দিকে, ঘরের বাইরের মাঠটিতে বন্ধুদের সাথে খেলছিলাম। এসময় আমার চাইতে কিছুটা বড় একজন এসে বললেন, "জিয়া মারা গেছেন"। বাংলাদেশের জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই উনাকে দেখে আসছি। নিজের চোখেও দেখেছি কয়েকবার।
এই তো গত বছরই উনাকে দেখলাম ঢাকার স্টেডিয়ামে শিশু-কিশোরদের সমাবেশে। সেই তিনি আর নেই! সকাল সকাল খেলার মাঠে এসে একজন সেই ভয়াবহ সংবাদ দিলো! নাহ্! বিশ্বাস করতে পারছি না। সন্দেহের চোখে একে অপরের দিকে তাকালাম। একজন উনাকে জিজ্ঞেস করলো, "কি বলিস ব্যাটা?"। উনি আরো জোর দিয়ে বললেন, "বললাম জিয়া মারা গেছেন।
" ইতিমধ্যে অরো কয়েকজন জড়ো হয়ে গেছে। অনেকটাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় সবাই। এটা একটা সিরিয়াস নিউজ, কিন্তু কেউই এই নিউজটা একসেপ্ট করতে পারছে না। "কোথায় শুনলি?" আবারও একজন প্রশ্ন করলো। "রেডিওতে", উত্তর দিলেন তিনি।
পাশেই উনার বাসা ছিলো, সবাই মিলে গেলাম উনার বাসায়। বারান্দায় উনার মা দাঁড়িয়ে ছিলেন। "খালাম্মা কি বলে আপনার ছেলে, জিয়াউর রহমান নাকি মারা গেছেন?" অনেকটা অভিযোগ, অনেকটা অবিশ্বাস আর অনেকটা আশংকা নিয়ে প্রশ্ন করলাম আমরা। "হ্যাঁ বাবারা আমিও রেডিওতে তাই শুনেছি, চিটাগাং-এ উনি মারা গেছেন", ধ্বক করে উঠলো আমাদের হৃদয়। উনার মৃত্যু সংবাদ কখনোই আশা করিনি।
আর সেটাই শুনতে হলো। তার উপরে চিটাগাং, এই তো দুদিন আগেই শুনলাম, বঙ্গপোসাগরে তালপট্টি দ্বীপকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক উত্তপ্ত হতে শুরু হয়েছে। বেশ কিছু ভারতীয় রণতরী বঙ্গপোসাগরে অবস্থান নিয়েছে। ইতিমধ্যে আমাদের একজন বন্ধু ছুটে এলো, "হায় হায় হায়, জিয়া মারা গেছেন, জিয়া মারা গেছেন, চিটাগাং দখল হয়ে গেছে। "
সাথে সাথে সবাই ছুটলাম যার যার বাড়িতে।
রেডিও শুনতে হবে। সত্য মিথ্যা জানতে হবে। কি হয়েছে? এখন দেশের কি হবে? বাড়ি গিয়ে সবাইকে বললাম, কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। দেশ চলছে চমৎকার, কোন সংকট নেই, কোন সমস্যা নেই, কর্মচঞ্চল-উদ্যমী জিয়াউর রহমানকে তো গতকালও সুস্হ দেখলাম, হঠাৎ কি হলো? কেন তিনি মারা যাবেন। রেডিও খোলা হলো (তখন দিনের বেলায় টিভি চলতো না) আর যা শুনলাম তাতে সবাই হতবাক, কোন এক ঘোষক বলছেন "দেশবাসী, আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আজ ভোরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারীর হাতে নিহত হয়েছেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজিউন"।
এর পরপরই শুরু হলো হামদ, 'আল্লাহু, আল্লাহু, আল্লাহু, আল্লাহ্, 'আল্লাহু, আল্লাহু, আল্লাহু, আল্লাহ্'।
শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়লো ঘরের সবাই। পাশাপাশি সবার মনে প্রশ্ন, কি হলো? কে উনাকে মারলো? কেন মারলো? আমি ছুটে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে, জানতে চাই কি হলো, সবাই কি বলে। সবাই ততক্ষণে রাস্তায় নেমে এসেছে। সবার মুখেই একই ভাব একই কথা, শংকিত মুখে সবার মনেই প্রশ্ন, হায় হায়! কি হলো কি হলো? মুরুব্বীদের সবাইকে দেখলাম অফিস থেকে ফিরে আসছেন, অফিস-আদালত সব ছুটি হয়ে গেছে।
একজন মুরুব্বীকে আসতে দেখে তার ছোট্ট মেয়ে ছুটে গেলো, "আব্বা, আব্বা, জিয়াউর রহমান মারা গেছেন"। ওর আব্বা উত্তরে বললো, "মারা যায়নি রে মা, মারা যায়নাই, মারছে মারছে, উনারে মারছে । "
একটু এগিয়ে গেলে একটা রেশন দোকান ছিলো। ওখানে দেখলাম আমার গৃহশিক্ষক লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি স্যারকে সালাম দিয়ে বললাম, "স্যার, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তো মারা গেছেন।
" উনি অনেকটা হতাশ কন্ঠে বললেন, "হ্যাঁ, তাইতো শুনলাম। " পাশ থেকে একজন বললো, "গেলো গেলো, এহন সবই গেলো, ভাতও গেলো, কাপড়ও গেলো। "
ইতিমধ্যে জানতে পারলাম যে, চিটাগাং-এ উনার সফরসঙ্গী ছিলেন ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী। সনামধন্য ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী বাংলাদেশের চিকিৎসাশাস্ত্রের একজন দিকপাল, উনার পিতা একজন মন্ত্রী ছিলেন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও একটি স্বাবলম্বি দেশ গড়ার লক্ষ্যে ট্যালেন্ট হান্টিং করতে শুরু করেন।
ধীরে তার চারদিকে জমা হন অনেক মেধাবী ব্যাক্তিবর্গ। এভাবে ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী স্থান পান তাঁর মন্ত্রীসভায়। জিয়ার মৃত্যুসংবাদে সবাই শোকাহত ছিলাম। এবার খুব শংকিত হয়ে পড়লাম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে নিয়ে। আমাদের বাড়ীর কাছেই ছিলো উনার মগবাজারের বাড়ীটি।
আমার বড় ভাই আমাকে সাথে নিয়ে ওখানে গেলেন। ইতিমধ্যে সেখানে অনেকেই জড়ো হয়েছে। আমরা তাদের কাছে জানতে চাইলাম ডাঃ বদরুদ্দোজা সম্পর্কে। তারা বললেন, তিনি জীবিত আছেন, তবে এখনো চিটাগাং-এই আছেন।
চিটাগাং-এর অবস্থা কি? কি হচ্ছে ওখানে? জানার জন্য মন আকুল হয়ে উঠলো।
বাংলা মটর থেকে কমলাপুর চলে যাওয়া আউটার সার্কুলার রোডে তখন হাজারো মানুষের ঢল, সবার মুখে তখন একই কথা, জিয়া শাহাদাত বরণ করেছেন, জিয়া শাহাদাত বরণ করেছেন। কারা মারলো? কেন মারলো? চিটাগাং এখন কাদের দখলে? হঠাৎ করে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে আর্মির দুটো বড় বড় লড়ি চলে গেলো। লড়ি ভর্তি সৈন্যরা সব যুদ্ধের পোষাকে, দুটো লড়ির সামনেই ভয়াল দর্শন মেশিন গান তাক করা আছে। সৈন্যদের মুখভঙ্গী দেখে বোঝা যাচ্ছিলো দেশরক্ষার নিমিত্তে যে কোন যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত। লড়ি দুটি মৌচাক মোড়ে গিয়ে বাঁ দিকে টার্ন নিতে দেখে বুঝলাম, তারা রামপুরার বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন রক্ষার জন্য যাচ্ছে।
দুজন তরুন একজন রিকশাওয়ালাকে বললো, "যাবেন?"
ঃ "কোথায়?"
ঃ রামপুরা, টেলিভিশন ভবনে।
রিকশাওয়ালা আতংকিত হয়ে বললো
ঃ না না ঐদিকে যামুনা।
ঃ কেন? কি হলো>
ঃ না, ঐদিকে যামুইনা।
ঃ কি আশ্চর্য্য!
তারপর তারা আরও কয়েকজন রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু কেউই রাজী হয়না।
তরুণ দুজনকে দেখে মনে হচ্ছিলো তাদেরও যাওয়া খুব প্রয়োজন। এক পর্যায়ে একজন বললো
ঃ ভাই, ভয়ের কিছু নাই। আমরা বাংলাদেশ টেলিভিশনে চাকরী করি।
অনেকটা শংকিত, দ্বিধান্বিত ভঙ্গীতে একজন রিকশাওয়ালা বললো, "চলেন"। বাকী রিকশাওয়ালারা এই সাহসী লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলো।
আমাদের একজন বললো, "আহারে গুলি কইরা মারছে!" পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক সহজ-সরল হুজুর, তিনি আহাজারি করে বললেন," ঝাঁঝরা কইরা ফালাইছে, মাথা নাইরে ভাই মাথা নাই। " শুনে আমাদের মনও কেঁদে উঠলো, 'এ কেমন বর্বর হত্যাকান্ড'।
কিছুক্ষণ রাস্তায় হাটাহাটি করার পর আমরা বাড়ির দিকে ফিরাম। পথে পরিচিত অনেকের সাথে দেখা হলো সবার মুখে একই কথা। জিয়া আর নাই, জিয়া আর নাই।
ছোট ছোট শিশু আমরা হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে মগবাজার ওয়ারলেস কলোনীর একটি বাড়ীর সামনে বসে পড়লাম। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি। রাজনীতির খুটিনাটিতো দূরের কথা, কোন কিছুই বুঝি না। বুঝি শুধু একটাই আমাদের প্রিয় জিয়া আর নাই। এখন দেশের কি হবে? চিটাগাং কাদের দখলে? যুদ্ধ শুরু হবে নাকি? একজন বললো, “চীন বোধহয় এতক্ষণে আমাদের সাহায্যে চলে এসেছে।
চীন জিয়াকে খুব ভালোবাসে”। মনেমনে ভাবলাম, তাই হোক, কেউ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসুক। আরো কত আলাপ করলাম। আমাদের কথাবার্তা একটু জোরে হয়ে যাচ্ছিলো। এসময় বাড়ীর দরজা খুলে একজন আন্টি বেরিয়ে এলেন।
তার লাল লাল ফুলে ওঠা চোখ দুটো দেখে বোঝা যায়, অনেকক্ষণ কেঁদেছেন। উনি ভারী গলায় বললেন, "বাচ্চারা আমাদের দেশের এতবড় একটা ক্ষতি হয়ে গেলো, কত দুঃখ, তোমরা হৈচৈ করছো কেন?"
আমাদের নীচের তলায় থাকতেন টি, এ্যান্ড টি,-র একজন ইন্জিনীয়ার। তিনি অফিস থেকে চলে এসেছেন। উনি বললেন সকালে যাথারীতি অফিস করছিলেন কিছুই জানতেন না। হঠাৎ আর্মি এসে পজিশন নিতে শুরু করলে উনারা ঘাবড়ে যান।
তারপর দুঃসংবাদ জানতে পেরে অফিসে শোকের ছায়া নেমে আসে।
আমাদের বাড়ীতে ভাড়া থাকতেন একজন সাংবাদিক। একসময় আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তারপর জিয়াকে খুব কাছ থেকে দেখার পর তিনি মত পাল্টান, এবং বি, এন, পি,-তে যোগ দেন। সারাদিন উনাকে দেখিনি।
দুপুর বেলা হঠাৎ তিনি আসলে সবাই তাকে ঘিরে ধরে। 'সাংবাদিক সাহেব, কি ঘটনা? কি হয়েছে? কিভাবে মারা গেলেন? কে মারলো? চিটাগাং-এর অবস্থা কি?" তিনি বললেন। "আমিও ডিটেইলস কিছু জানতে পারিনি, শুনেছি, আর্মিদের একাংশের হাতে তিনি নিহত হয়েছেন। আমি এখন যাই, হাতে সময় নেই পত্রিকা অফিসে অনেক কাজ করতে হবে। "
সবার মাথায় তখন আরেকটা চিন্তা।
রাষ্ট্রপতি নেই, এখন কে দেশ চালাবে? জিয়ার পরের ব্যাক্তি কে? দেশে তখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার চলছে। রাষ্ট্রপতির পর উপরাষ্ট্রপতি আছেন। কে উপরাষ্ট্রপতি? আমার তখন মনে পড়লো একবার কোথায় যেন দেখেছিলাম বড় সাইনবোর্ডে তীর চিহ্ন দিয়ে লেখা, 'উপরাষ্ট্রপতির বাসভবন'। কিন্তু উপরাষ্ট্রপতি যে কে মনে করতে পারছিলাম না। আসলে জিয়া এতোই জনপ্রিয় ছিলেন যে, দ্বিতীয় কারো কথা কখনো ভাবিইনি।
কিছুক্ষণ পরে জানতে পারলাম উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহন করেছেন। চিটাগাং-এর জিওসি জেনারেল মন্জুর এই নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। বর্তমানে চিটাগাং মন্জুর-এর নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। বঙ্গপোসাগরে অবস্থান নেয়া ভারতীয় রণতরীগুলো সরে গিয়েছে। আমরা শংকিত চিটাগাং মন্জুর-এর দখলে দেশের বাকী অংশের কি অবস্থা? একজন বললেন, "ভয় নাই, বিচারপতি আবদুস সাত্তার দেশের বাকী অংশ উনাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নিয়েছেন।
"
সন্ধ্যার দিকে বিটিভি-র অধিবেশন শুরু হলে সবাই টেলিভিশন ঘিরে ধরলাম। সেখানে শোক সংবাদ জানানো হলো, এবং বলা হলো অল্প সময়ের মধ্যেই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেবেন। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর পর্দায় আবির্ভূত হলেন তিনি। বয়সের ভারে নূয়ে পড়া বৃদ্ধ বিচারপতি আবদুস সাত্তার থেমে থেমে পড়লেন, " ---- আজ ভোরে কিছুসংখ্যক উচ্চাভিলাষী দুষ্কৃতিকারীর হাতে নিহত হয়েছেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজিউন।
....... তাদের বিরূদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে......”। আমরা একদিকে শংকিত আরেকদিকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। টেলিভিশনের পর্দায় একজন অপেক্ষাকৃত তরুণ, কর্মঠ, শক্ত-সমর্থ, উদ্যমী রাষ্ট্রপতিকে দেখে অভ্যস্ত। তাঁর স্থলাভিষিক্ত বৃদ্ধ, দুর্বল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পারবেন কি এই ভয়াবহতা মোকাবেলা করতে?
(চলবে)
(উপরের প্রায় সবই আমার স্মৃতি থেকে লেখা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।