আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১৯৮১ সালের ৩০শে মে, একটি নক্ষত্রের ঝরে পরা, শোকে মূহ্যমান জাতি - পর্ব ২

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ১৯৮১ সালের ৩০শে মে, একটি নক্ষত্রের ঝরে পরা, শোকে মূহ্যমান জাতি - পর্ব ২ ------------------------------------------------ ডঃ রমিত আজাদ (পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে) টেলিভিশনে মুহুর্মুহু দোষীদের নাম ঘোষণা করা হচ্ছিলো, ও তাদের ধরিয়ে দেয়ার কথা বলা হচ্ছিলো। ল্যাফটেন্যান্ট থেকে কর্ণেল র্যঙ্ক পর্যন্ত বেশ কিছু অফিসারের নাম রয়েছে। তাদের নাম শুনে আমাদের প্রচন্ড ঘৃণা বোধ হচ্ছিলো, 'এরা জিয়াকে হত্যা করেছে!' রাতের দিকে রেডিওতে বিবিসি চালু করলাম। সেই সময় বিবিসিকে আমরা একটি ট্রাস্টওয়ার্দি সংবাদ মাধ্যম মনে করতাম। (এই বৃটিশরাই আমাদের দু'শো বছর নির্যাতন করে গিয়েছিলো।

প্রতারণায় বৃটিশদের তুলনা নেই। তারপরেও কেন যে তাদের সংবাদ মাধ্যমকে আমরা ট্রাস্টওয়ার্দি মনে করতাম, আমি বুঝি না। ) যাহোক রেডিওর চারদিকে বাড়ীর সবাই গোল হয়ে বসলাম, বিবিসির বাংলা প্রোগ্রাম শোনার জন্য। সেখানে যা বলা বলা হয়েছিলো তার শুরুটা আমার এখনো মনে আছে - 'বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা কি আর কোনদিনও পোহাবে না? আজ ভোরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন। ' এরপর যা বলা হয় তার অল্প অল্প মনে আছে - ঢাকা থেকে আমাদের রিপোর্ট পাঠিয়েছেন মার্ক ট্যালি।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছেন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার........। বাংলাদেশে কোন সামরিক শাসন নেই মার্ক ট্যালি একথা জোর দিয়ে বলেছেন। চট্টগ্রামে অবস্থিত জেনারেল মন্জুর এবং তার সহযোগীদেরকে আত্মসমর্পনের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। ' বিবিসিতে এইসব শুনে আমরা পরিস্থিতি সম্পর্কে মোটামুটি ধারনা পেলাম। ঘুমের আয়োজন করলাম।

কিন্তু ঘুম ঠিকমতো হবে কিনা জানিনা। মুরুব্বীরা খুব শংকিত ছিলেন। ১৯৭১ সালতো খুব বেশিদিন আগের কথা না। তখন একটি রাতও কেউ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেনি। তদুপরী আমাদের বাড়িতে রাজাকার ও হানাদাররা হানা দিয়েছিলো কয়েকবার।

একবার তো এক লাইনে দাঁড় করিয়ে বন্দুক তাক করেছিলো সবার দিকে। উপরওয়ালার রহমতে সেবার সবাই কোনমতে বেঁচে গিয়েছিলো। ভয়াল সেই রাত্রিগুলো এখনো বিভিষীকা। এরপর পচাত্তরের আগস্ট। তারপর ৭ ই নভেম্বর, কর্নেল তাহেরের ক্ষ্যপাটে বিদ্রোহী ও উশৃঙ্খল সৈনিকরা সেনানিবাসের ভিতরে নারীসহ চল্লিশজন নিরাপরাধ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছিলো।

এই রাতটি সেইসব ভয়াবহতার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। দুরু দুরু বুকে বিছানায় গেলাম। পরদিন ঘুম থেকেও উঠলাম অনেক ভীতি নিয়ে। রাতের মধ্যে কি ঘটেছে কে জানে! উঠেই রেডিও খুললাম। না, অভ্যুথ্থান বা এই জাতীয় কিছু ঘটেনি।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ও সেনাপ্রধান লেঃ জেনারেল এরশাদ সমগ্র দেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। কেবলমাত্র চট্টগ্রামই মেজর জেনারেল মন্জুরের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। সরকার বারবার তাদের আত্মসমর্পনের আহ্বান জানাচ্ছেন, অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। আমরা এই প্রথম সেনাপ্রধানের নাম জানলাম। আবারও বলছি, জিয়া তখন এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, কে উপরাষ্ট্রপতি কে সেনাপ্রধান এইগুলো দিকে আমাদের নজরই ছিলো না।

এবার দেশ সেনাপ্রধান এরশাদের দিকে তাকালো, কারণ মিলিটারি এ্যকশন তো তাকেই নিতে হবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, জিয়া বা মন্জুরের মত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তো নেইই কোন খেতাব থাকার প্রশ্নই উঠে না। পক্ষান্তরে জিয়া দুই দুইটি যুদ্ধে সর্বচ্চো খেতাব প্রাপ্ত, ১৯৬৫ সালে ভারতের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করে পেয়েছিলেন হেলাল-ই-জুরাত, এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের হাত থেকে মাতৃভূমি রক্ষা করে পেয়েছিলেন বীর উত্তম উপাধী। জেনারেল মন্জুর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছিলেন বীর উত্তম উপাধী। কি এমন ঘটলো যে একজন বীর উত্তম হত্যা করলো আরেকজন বীর উত্তম-কে।

হিংসা-প্রতিহিংসা? ক্ষমতার লড়াই? রাষ্ট্রপতি হওয়ার স্বপ্ন? সকালের নাস্তার পর বাইরে বেরিয়ে এলাম। সকলেই শংকিত। সবার মুখেই একই কথা। তারপর প্রশ্ন দেখা গেলো, জিয়া নিহত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর মৃতদেহ কোথায়? জানা গেল মৃতদেহের হদিশ পাওয়া যাচ্ছেনা। সার্কিট হাউস থেকে সকালে আর্মিরা তার মৃতদেহ নিয়ে যায়, এরপর কোথায় আছে কেউ জানেনা।

রেডিও মারফত জানানো হলো অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার সারাদেশে গায়েবানা জানাজার ডাক দিয়েছেন। বাদ জোহর সারা দেশে জানাজা হলো। শোনা যায় অজপাড়াগাঁয়েও জানাজার আয়োজন হয়। মূল জানাজাটি হয় ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদে। সেখানে জানাজার আগে বিচারপতি আবদুস সাত্তার একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তার অংশবিশেষ আমার মনে আছে, ".... এই পৃথিবীতে কোন মানুষই দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে নয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়াও দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে ছিলেন না। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। মৃত্যুর পর, আর তাকে নিয়ে সমালোচনা না করে, আসুন আমরা তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। ....................। " ঢাকা সহ সারা দেশে অজস্র মানুষের ঢল নেমেছিলো এই গায়েবানা জানাজায়।

এটিই ছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসের বৃহত্তম গায়েবানা জানাজা। সারাদিন আমাদের মনে ঐ ভাবনাগুলোই ঘুরছিলো। চিটাগাং-এ কি হচ্ছে? সাত্তার বাহিনীর সাথে মন্জুর বাহনীর যুদ্ধ হবে কি? জিয়ার মৃতদেহ কোথায় আছে? আমরা কি উনাকে আর দেখতে পাবোনা? মৃত্যুর পর একবার হলেও তো মানুষ শেষ দেখা দেখে! কিছুক্ষণ পর শুনলাম, সরকার জেনারেল মন্জুরকে সময়সীমা বেধে দিয়েছে, এর মধ্যে আত্মসমর্পন না করলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। অনেকে বললো, মন্জুর খুব তুখোড় জেনারেল পাকিস্তানীরা তার সামনে দাঁড়াতে পারেনি, লড়াই শুরু হলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। অনেকে বলছে, না, আমাদের সম্মিলিত শক্তির সাথে সে পারবে না।

তার আত্মসমর্পনই করা উচিৎ। অনকে ভাবছে চট্টগ্রামের সেনাবাহিনী ঢাকার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করবেই বা কেন? একই দেশে দুই পক্ষ যুদ্ধ করবে এ কেমন কথা! রাতে আবার সবাই জড়ো হলাম টেলিভিশনের সামনে। আবারও হত্যাকান্ডে জড়িতদের নাম বলা হচ্ছে এবং তাদের ধরিয়ে দিতে বলা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর নৌ বাহিনীর প্রধান এম এ খান-কে টিভি পর্দায় দেখলাম। ৩০শে মে রাতে তিনি চিটাগাং-এই ছিলেন।

তিনি ঢাকায় চলে এসেছেন। তার মুখে শুনলাম, "আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, দেশব্যাপী এই অভ্যুথ্থান হয়েছে। পরে জানতে পারি যে স্থানীয় বিদ্রোহীদের কাজ। আমি জাহাজ যোগে ঢাকায় চলে এসেছি। আমি বিচারপতি সাত্তার-এর সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করছি।

" উনার বক্তব্যে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। অনেক রাজনীতিবিদও বঙ্গভবনে গিয়ে সাত্তার সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যাক্ত করলেন। এদের মধ্যে মিজান চৌধুরীর কথা আমার মনে আছে। এদিকে জেনারেল মন্জুরের সমালোচনা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কি করে তিনি এমন ব্রুটাল কাজ করতে পারলেন! তাঁর কি এমন ক্ষতি করেছিলো জিয়া? নাকি জিয়ার সাফল্যে তিনি প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে উঠেন? লোকমুখে জানতে পারলাম মন্জুরের গ্রামের বাড়ী পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

কে পোড়ালো? গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। হ্যাঁ এই গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, জিয়ার নিজ হাতে গড়া। বিদেশী রাষ্ট্রের আগ্রাসী তৎপরতার মোকাবেলা করতে, সিটিজেন্স আর্মি গড়ে তোলার লক্ষ্যে জিয়া গড়েছিলেন এই গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। গ্রামে গ্রামে মানুষ সচেতন দেশপ্রেমিক হয়ে উঠবে। তরুণরা সামরিক শিক্ষা পেয়ে দেশ রক্ষার জন্য সদা প্রস্তুত থাকবে এটাই ছিলো তাঁর উদ্দেশ্য।

জিয়ার অনুগত এই বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়েই বোধহয় মন্জুরের গ্রামের বাড়ী পুড়িয়ে দেয়। অনেক কাল পরে এক পত্রিকায় পড়েছিলাম, কেউ একজন জিয়াউর রহমানকে বলছেন, "স্যার কয়েকদিন আগে দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে ঢাকার বিজয়নগরে সাংবাদিকসহ দু'জন মারা যায়। এটা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। আপনার প্রতি দেশের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অন্যতম কারণ আপনি দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি করেছেন। হঠাৎ এরকম একটা ঘটনায় জনগণ শংকিত হয়ে পড়েছে।

" জিয়াউর রহমান বললেন, "হু, স্বরাস্ট্র মন্ত্রণালয়টাকে ভালো কারো হাতে দিতে হবে। " তিনি বললেন, "জেনারেল মন্জুরকে দেন, এফিসিয়েন্ট লোক। " জিয়া বললেন, "না, মন্জুর থাক, মন্জুরকে নিয়ে আমার অন্য প্ল্যান আছে। " হায় ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! ৩১শে মে রাতে হঠাৎ টেলিভিশনের পর্দায় আবির্ভুতন হন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার। এত বৃদ্ধ, শারীরিকভাবে দুর্বল একজন মানুষকে দেখে প্রথমটায় আমরা যেমন হতাশ হয়েছিলাম, এখন আবার তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বাড়তে শুরু করেছে।

মুরুব্বীরা বলছেন, 'এই দুঃসময়ে তিনি হাল ধরেছেন, এত সাহস ক'জন করে!' আমরা পরবর্তিতে জেনেছিলাম বিচারপতি সাত্তার ছিলেন শের-ই-বাংলা-র সরাসরি শিষ্য। বাঘের শিষ্য বাঘের কাছাকাছি কিছু একটা তো হবেনই। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি টিভি পর্দায় ঘোষণা দিলেন, 'জেনারেল মন্জুর ও তার সহযোগীদের সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হলো। ' আমরা হৈচৈ করে উঠলাম এতক্ষণে খেয়াল হলো! প্রথম দিনই তো বরখাস্ত করা যেত। ধীরে ধীরে জানতে পারলাম, মন্জুরের সাথে রয়েছে, লে. কর্নেল মতিয়ার (মতিউর রহমান), লে. কর্নেল মাহবুব (মন্জুরের আপন ভাগ্নে), লে. কর্নেল ফজলে হোসাইন, মেজর খালেদ, প্রমুখ।

আমাদের মনে প্রশ্ন জাগছিলো জিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান লে. কর্নেল মাহফুজ কোথায় আছেন? (যতদূর মনে পরে তিনি আমাদের পরিচিত কারো আত্মীয় ছিলেন)। নানা আলোচনা, সমালোচনা, শংকা, ভীতির মধ্যে ৩১শে মে রাতে আমরা আরেকটি উদ্বিগ্ন রাত্রি কাটানোর জন্য বিছানায় গেলাম। পরের দিনের ভোরটি কেমন হবে জানিনা। আমিতো তাও পরিপাটি বিছানায় শুয়ে আছি। আমাদের প্রিয় নেতা জিয়াউর রহমানের প্রানহীন দেহ কোথায় পড়ে আছে, কে জানে? (চলবে) (প্রায় সবটাই আমার স্মৃতি থেকে লেখা) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২৭ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.