আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১৯৮১ সালের ৩০শে মে, একটি নক্ষত্রের ঝরে পরা, শোকে মূহ্যমান জাতি - পর্ব ৩

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ১৯৮১ সালের ৩০শে মে, একটি নক্ষত্রের ঝরে পরা, শোকে মূহ্যমান জাতি - পর্ব ৩ ------------------------------------------------ ডঃ রমিত আজাদ (পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে) আবারও দুরুদুরু বুকে ঘুম থেকে উঠলাম ১লা জুন সকালে। নাস্তা খাওয়া, এমনকি হাতমুখ ধোয়ার আগেই রেডিও অন করতে ছুটে গেলাম। না, আমাকে অন করতে হলোনা, রেডিও আগে থেকেই অন হয়ে আছে, মুরুব্বীরা আমারও আগে আরো ভোরে ঘুম থেকে উঠে রেডিও অন করেছেন। আসলে সেই সময় দেশবাসী এতই উৎকন্ঠিত ছিলো যে, প্রতি মুহূর্তের সংবাদই সবার কাছে জরুরী ছিলো। আমি জানতাম যে, বিচারপতি সাত্তার বিদ্রোহীদের একটি সময়সীমা বেধে দিয়েছিলেন, এর মধ্যে তারা আত্মসমর্পন না করলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।

আমরা খুব ভীত ছিলাম সময় পার হয়ে গেলে সত্যিই কি যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে? কার সাথে কার যুদ্ধ? নিজেদের সাথেই নিজেদের? কেন? সময়সীমা যতই এগিয়ে আসছিলো আমাদের বুক তত দুরু দুরু করছিলো। ঘটনা হয়তো ঘটবে চিটাগাং-এর কাছাকাছি কোথাও। ঢাকা থেকে অনেক দূরে। কিন্তু তারপরেও ভয় পাচ্ছিলাম। আবার আমাদের এক ঘনিষ্ট আত্মীয় চিটাগাং-এই থাকতেন।

ওদের কথা ভেবেও ভয় লাগলো। ইতিমধ্যে একবার সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছিলো। আমার এখন ঠিক মনে নাই এটা কখন করা হয়েছিলো। তবে সেই সময় আমাদের মনে হয়েছিলো সাত্তার ও মন্জুর দু'জনই অনড়। এরকম হলে তো ঘটনা সংঘাতের দিকেই এগুবে! সবাই গভীর উদ্বেগের মধ্যে ছিলাম।

তাই যখন সময়সীমা বৃদ্ধি করা হলো তখন আমরা সামান্য কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ঐদিন আমাদের বাড়ীতে আমার ফুপাতো বড় বোন এলেন। জানালেন, ৩০শে মে তিনি এইচ, এস, সি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। পরীক্ষা চলাকালীন সময়েই তারা সংবাদ পান যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছেন। সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়ে অনেক মেয়ে।

এই ঘটনাটি খুবই কমোন। ঐদিন ঘরে ঘরে ছিলো কান্নার রোল, পথে পথে মানুষের চোখের কোনে অশ্রু চিকচিক করছিলো। আমি পথে কিছু সহজ-সরল হুজুরদেরকে দেখেছি, হয়তো কোন মসজিদের মোল্লা হবেন, কিংবা কোন মাদ্রাসার শিক্ষক। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন, "লোকটা স্বনির্ভর আন্দোলন করছে, কত কাম করছে! আহারে, সেই লোকটারে মাইরা ফালাইলো!" দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে জিয়া যে কতটা জনপ্রিয় ছিলো তা বলে শেষ করা যাবেনা। সকলেই চাইছিলো মন্জুর বাহিনীর পতন হোক, সেটা যত দ্রুত হয়, ততোই ভালো।

দেশ এই ভয়াবহতার হাত থেকে রক্ষা পাক। সবাই চাইছিলো প্রিয় নেতার মরদেহ কোথায় তা জানতে। সবাই চাইছিলো তাঁকে শেষ নজর একবার দেখতে। পরম শ্রদ্ধায় তাঁকে দাফন করতে। হঠাৎ করে জানতে পারলাম মন্জুর বাহিনীর পতন ঘটেছে।

সেটা খুব সম্ভবত ১লা জুন দুপুর বা বিকালের দিকে হবে। দুই-একদিন পরে জেনেছিলাম। ঢাকা ও কুমিল্লা থেকে সাত্তারের অনুগত বাহিনী চট্টগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হয়। আর মন্জুর বাহিনী অগ্রসর হয় কুমিল্লা অভিমুখে। এক পর্যায়ে তারা মুখোমুখি হয় শুভপুর ব্রীজের কাছে।

এই দুই বাহিনী পরস্পরের দিকে অস্ত্র তাক করে এ্যকশনে নামলেই ব্যপক সংঘাত শুরু হয়ে যাবে। জেনারেল মন্জুর হয়তো এটাই চাইছিলেন। পরাজয় তো সহজে মেনে নিতে চায়না কোন ক্ষত্রিয়। যাহোক, শুভপুর ব্রীজের কাছে এসেই মন্জুর বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী অফিসাররা, বেতার যোগে জেনারেল মন্জুরকে জানিয়ে দেন, "আমরা দুঃখিত! আপনার আদেশ মানা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। " তারপর তারা কুমিল্লা বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে বিচারপতি সাত্তারের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

শুভপুর ব্রীজের পতন হলে জেনারেল মন্জুর মনোবল হারিয়ে ফেলেন। তিনি একজন ট্যালেন্টেড সমরবিদ ছিলেন, মুহূর্তের মধ্যেই ভবিষ্যত দেখে ফেলেন, 'উনার পরাজয় নিশ্চিত। " আমরা ঢাকায় বসে দেখতে পাচ্ছিলাম, যে পরিমান জনসমর্থন ও প্রীতি জীবিত ও মৃত জিয়ার রয়েছে, তার সামনে কেউই টিকতে পারবে না। মন্জুর হয়তো এটা দেরীতে হলেও বুঝলেন। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র, যেখান থেকে মেজর জিয়া অসীম সাহসিকতা দেখিয়ে একদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, সেই বেতারকেন্দ্র এই দুই দিন ছিলো বিদ্রোহীদের দখলে।

আমার যতদূর মনে পরে এটা ক্যাপ্টেন অনন্ত (নামটা ভুলও হতে পারে) নিয়ন্ত্রন করছিলো। ১লা জুন সেখানকার বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পন করে। ক্যাপ্টেন অনন্ত সম্ভবত পালিয়ে যায়। এদিকে চট্টগ্রামের ভিতরে যেসব অফিসার ও সৈনিকরা অবস্থান করছিলেন তারা যে সকলেই মন্জুরকে সমর্থন করছিলো তা নয়। বরং তাদের বেশীর ভাগই এই ঘৃণ্য ঘটনার বিরোধী ছিলেন।

কিন্তু সামরিক রীতিতে উর্ধ্বতনের কমান্ড মানতে বাধ্য বলে তারা মুখ বুজে ছিলো। এদিকে শুভপুর ব্রীজের পতন ও সাত্তার বাহিনীর জয়ের সংবাদে তারা উল্লসিত হয়ে ওঠে এবং জেনারেল মন্জুরের নির্দেশ আর পালন না করলেও চলবে বলে বুঝতে পারেন। চাঙা হয়ে উঠে তারাও দ্রুত সাত্তার সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে নিজেদের দায়িত্ব বুঝে নেন। আমরা ঢাকায় বসে জানতে চাইলাম মন্জুর এখন কোথায়? রেডিওর সংবাদে বুঝতে পারলাম, পরিস্থিতি বেকায়দা বুঝে জেনারেল মন্জুর ও তার ঘনিষ্ট সহযোগীরা (এদের মধ্যে লে, কর্ণেল মতিয়ার ও লে, কর্ণেল মাহবুবের নাম উল্লেখযোগ্য ) সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়েছে। তবে সরকারী বাহিনী তাদের হান্টিং শুরু করেছে।

চট্টগ্রামের সৈনিক অফিসাররাও এই হান্টিং-এ যোগ দিয়েছে। বিচারপতি সাত্তার, ঘাতক মন্জুর ও তার সহযোগীদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য বড় অংকের টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করেছেন। শ্বাসরুদ্ধকর এই কয়েকটি দিনের পর দেশবাসী অবশেষে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। তবে এখানেই শেষ ছিলো না। এখন আমাদের সবার মনেই দুটা প্রশ্নঃ মন্জুর ও তার সহযোগীরা কখন ধরা পড়বে? আর, আমাদের প্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়ার মরদেহ কোথায় আছে? বিকালের দিকে আমার বড় ভাই জানালেন, রাষ্ট্রপতি জিয়ার মরদেহ পাওয়া গেছে।

"পাওয়া গেছে, খুশী হয়ে উঠলো আমার মন!", "কোথায়?" প্রশ্ন করলাম আমি। "চিটাগাং থেকে দূরে কোথায় যেন। রাষ্ট্রপতি জিয়ার সাথে আরো দুজনকে দাফন করেছে। " বললেন বড় ভাই। আমি বললাম, "কোনরকমে মাটি চাপা দিয়েছে বোধহয় না?", বড় ভাই বললেন, "না, শুনেছি জানাজা দাফন সবই হয়েছে।

দাফনের সময় অফিসাররা স্যালুটও করেছে। " সবাই মিলে ভাবলাম কিছু সময়, যারা হত্যা করেছে, তারাই আবার স্যালুট করলো! বুঝলাম না। তাহলে কি তারা ভুল বুঝে অনুতপ্ত হয়েছে? শত হলেও তো তারা জানে জিয়াউর রহমান কত বড় সমরপ্রতিভা ও দেশপ্রেমিক। আবার এমনও হতে পারে, যারা দাফন করেছে তারা হত্যাকারীদের কেউ নয়, অন্য কোন অফিসার, যারা শুধু উর্ধ্বতনের নির্দেশ মেনেছে। তারপর অফিসিয়ালি জানতে পারলাম ১ জুন বেলা ১১টায় জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ তোলা হয়।

ওইদিন বিকাল পৌনে ৪টায় বিমান বাহিনীর একটি বিমানযোগে চট্টগ্রাম থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ ঢাকায় আনা হয়। এ সময় এক বেদনাঘন শোকার্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয় শহরজুড়ে। টেলিভিশনে ঘটনাটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। একদিকে হাজার হাজার তরুণ ও পুরুষরা ছুটে যায় এয়ারপোর্টের দিকে, আর আমরা শিশুরা এবং বৃদ্ধরা ও মহিলারা বসেন টেলিভিশনের সামনে। বিমান থেকে কফিন বের করার সাথে সাথে সারা দেশ কান্নায় ভেঙে পড়ে।

কফিনের সাথে এসেছিলেন ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি কাঁদতে বলেছিলেন, "সে এক নৃশংস হত্যাকান্ড, যে লোকটা গণতন্ত্র এনে দিয়েছিলো সেই চলে গেল, এখন গণতন্ত্র কে রক্ষা করবে?" আজ আমার মনে হয় তিনি ঠিকই আশংকা করেছিলেন। এর পর দশ বছর আমাদের থাকতে হয়েছিলো এরশাদের সামরিক শাসন আর স্বৈরাচারের যাতাকলে। টেলিভিশনে ধারা বিবরণি দিচ্ছিলেন (যতদূর মনে পড়ে) সরকার কবিরউদ্দিন। তিনি বললেন, "শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরদেহ বিমান থেকে নামানো হচ্ছে, কফিন কাঁধে নেয়ার জন্য এগিয়ে গিয়েছেন তিন বাহিনী প্রধানগণ।

যে মানুষটি একসময় পায়ে হেটে এই দেশটির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেরিয়েছেন, তিনি আজ কাঁধে চড়ে আসছেন....। " এইটুকু বলতে বলতে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। এই কান্না সংক্রমিত হয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষের চোখ থেকে। বিমানবন্দর থেকে জিয়াউর রহমানের কফিনটি একটি সামরিক যানে সেনানিবাসের প্রেসিডেন্ট ভবনে আনা হয়। সেনানিবাসের ১ নং গেট থেকে প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত রাস্তার দু্ই পাশে বিমান বাহিনীর সদস্যরা শ্রদ্ধাবনতভাবে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখান।

আর গেটের বাইরে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ। কফিনটি প্রেসিডেন্ট ভবনে আনার পর এখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। বেগম খালেদা জিয়া, তাঁদের দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান, আত্মীয়-পরিজন এবং অপেক্ষমাণ লোকজন সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিকাল ৫টায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কফিন সংসদ ভবনে নেওয়া হলে সেখানেও তাঁর মৃতদেহ একনজর দেখার জন্য শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। এ পরিপ্রেক্ষিতে জনসাধারণের দেখার সুবিধার জন্য এদিন (১ জুন) রাতে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়।

ফলে রাত ৯টা পর্যন্ত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ দেখার জন্য জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ। মানুষের ঢলে এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, মহাখালী রেলগেট, বাংলামোটর এলাকা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এসব এলাকা ও আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। রাতে মহিলা, গৃহিণী এমনকি শিশুরা পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের লাশ একনজর দেখার জন্য ভিড় জমায়। জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মান কাজ পাকিস্তান শাসনামলে শুরু হলেও তার গতি ছিলো মন্থর।

স্বাধীনতার পর তা প্রায় থেমেই যায়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর নির্দেশ দিলেন দ্রুত সংসদ ভবনের কাজ শেষ করতে। উনার তালিকায় ১লা জুনের কর্মসূচীর মধ্যে ছিলো, শের-ই-বাংলা নগরের নির্মানাধীন জাতীয় সংসদ ভবন পরিদর্শন। তিনি কাজের অগ্রগতি দেখতে চেয়েছিলেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ঐদিন তিনি সেখানে গেলেন বটে, কিন্তু জীবিত তিনি নন, গেল তার প্রানহীন দেহ।

আমাদের পাড়া থেকে কয়েকজন মুরুব্বী গেলেন সংসদ ভবনে শেষবারের মত প্রিয় জিয়াউর রহমানকে দেখতে। চোখের জল ফেলতে ফেলতে ফিরে এলেন। আমরা সবাই তাদের ঘিরে ধরলাম, "কি দেখলেন বলেন। " তারা বললেন, "কিছুই দেখতে পারলাম না রে বাবা, শুধু কফিনটা দেখেছি। গুলিতে ঝাঁঝরা দুইদিন পরের দেহ কি আর দেখার মত অবস্থায় থাকে?" বলেই তারা আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন।

(চলবে) (প্রায় সবটুকুই আমার স্মৃতি থেকে লেখা) আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার , বুকের ব্যথা বুকে চাপায়ে নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.