কিশোর বয়স থেকে যাঁর মাদকতাময় কণ্ঠের গান আমাকে মোহিত করে রেখেছে তাঁর নাম শাহনাজ রহমতুল্লাহ। ছোট বেলায় পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে রেডিওতে নাম বলা হতো শাহনাজ বেগম। ছাত্রজীবনে একবার তাঁকে কোন একটা শপিং মলে দেখেছি এক পলকের জন্য। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রেডিসন হোটেলে সরাসরি তাঁর গান শুনবার সৌভাগ্য হলো।
সিটি ব্যাংক এনএ তাঁকে সম্মাননা দিলো।
সিটি ব্যাংকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ তাঁকে সম্মাননা দেবার জন্য এবং তাঁর গান সামনে থেকে শুনবার সুযোগ করে দেবার জন্য।
কিছুদিন আগে প্রথম আলোর সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন আর গান করবেন না। শুনে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। শুক্রবারও বললেন, আর নতুন গান করবেন না। অসম্ভব অভিমানী আর মুডি এ শিল্পীকে গান গাইতে রাজী করাবার জন্য সিটি ব্যাংককে অবশ্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
বহুবার ধর্ণা দিতে হয়েছে তাঁর কাছে।
অবাক হলাম তাঁকে দেখে ৬০ বছর বয়সে (জন্ম ১৯৫৩ সালে) এখনো বেশ সুন্দর রয়েছেন। কণ্ঠ শুনে চমকে গেলাম। এত স্পষ্ট আর জোরালো ! ভাবাই যায় না !
প্রথমে আমার আরেক প্রিয় শিল্পী মাহমুদুন্নবীর মেয়ে সামিনা চৌধুরী উঠলেন শাহনাজের গান গাইতে। সামিনা শুরুতেই বললেন, শাহনাজ চাচীর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর গাইতে ভয় পাচ্ছেন।
সামিনাও অনেক বড়ো শিল্পী। তাঁর ক্লাসিক্যাল বেজ বেশ শক্ত। সামিনা ফাহমিদা বাপের যোগ্য কন্যা। সামিনা প্রথমে গাইলেন, 'তোমার আগুনে পোড়ানো এ দুটি চোখে একি তৃষ্ণা, একি ক্লান্তি, শুধু তুমি নাই বলে', । গান শুনে বোঝা গেলো সামিনা নার্ভাস ছিলেন।
এরপর অবশ্য সেটা কমে গেছে। খুব সুন্দর করে একে একে গাইলেন- 'সাগরের সৈকতে কে যেন দূর হতে আমারে ডেকে নিয়ে যায় আয়! আয়!! আয়!!!',/ 'খোলা জানালায় চেয়ে দেখি তুমি আসছো, জানাতে সুপ্রভাত',/ 'মানি সে তো মানিক নয়', /'কিছু কিছু মন আছে প্রতিদান চায় না', /'আরো কিছু দাও না দুঃখ আমায়',/ 'পারি না ভুলে যেতে, স্মৃতিরা মালা গেঁথে হারানো সেই পৃথিবীতে ডেকে নিয়ে যায়'/ সাগরের তীর থেকে মিস্টি কিছু হাওয়া এনে তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো ভাবি মনে মনে ইত্যাদি।
জনপ্রিয় বহু গানের গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার স্মুতি চারন করলেন চঞ্চলা কিশোরী শাহনাজ বেগমের। শানাজের বড়ো ভাই সুরকার মাসুদ পারভেজ ছিলেন গাজীর বন্ধু। (শাহনাজের আরেক ভাই জাফর ইকবাল ছিলেন জনপ্রিয় নায়ক ও গায়ক) সে সুবাদে শাহনাজদের বাসায় যেতেন।
ফলে শাহনাজের অনেক গান গাজীর লেখা আর মাসুদ পারভেজের সুরে।
মাত্র ১১ বছর বয়সে রেডিও এবং চলচ্চিত্রের গানে তাঁর যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৪ সালে টিভিতে প্রথম গান করেন। সে হিসাবে সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে তাঁর পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হলো এবছর।
প্রতিটি গান গাইবার আগে গীতিকার সুরকারের নাম বলছিলেন তাঁরা।
মাসুদ পারভেজ ছাড়াও আলাউদ্দিন আলী, খান আতা প্রমুখের সুরে গান গেয়েছেন শাহনাজ। পাকিস্তানে থাকার সুবাদে করাচী টিভিসহ উর্দু ছবিতেও গান করেছেন। গান শিখেছেন গজল সম্রাট মেহেদী হাসানের কাছে। তাঁর একটি গানের সুরকারের নাম শুনে চমকে গেছি। সাগরের তীর থেকে গানটি জেবুন্নেসা জামালের লেখা (শিল্পী আঞ্জুমান আরা বেগেমের বড়ো বোন, শিল্পী জিনাত রেহানার মা)।
এর সুরকার যে করীম শাহাবুদ্দিন এটা জানতাম না। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতগুনী ওস্তাদ করীম শাহাবুদ্দিন যে সুর করতেন এটা্ জানতাম না ! কি অসাধারন সে সুর !
সামিনার পর গাইতে উঠলেন শাহনাজ। পুরো হল তুমুল হাততালিতে মুখরিত। প্রথমে গাইলেন- একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়। বিবিসি জরীপে সেরা বিশটি গানের তিনটির একক শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ (http://www.sachalayatan.com/shohailmc/7066)।
এটি তার একটি। এছাড়া আরেকটি গানের অন্যতম শিল্পীও তিনি। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা মাসুদ পাভেজের সুরে জয় বাংলা বাংলার জয়।
এরপর গাইলেন যে ছিলো দৃষ্টির সীমানায় যে ছিলো হৃদয়ের আঙ্গিনায়। গাইবার আগে বললেন, গানটি তিনি গাইতে চান না।
শুনে অনেকে কান্নাকাটি করেন।
সব শেষে গাইলেন, এক তারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল। আমাকে তুই বাউল করে সঙ্গে নিয়ে চল।
শুনে অবাক হলাম ষাট বছর বয়সেও সে মাদকতাময় কণ্ঠ এখনো অমলিন। সেই অসাধারণ শক্তি।
যে রকম জোর তাঁর মেয়ের বয়সী সামিনার গলায়ও পেলাম না !
শাহনাজরা বাংলা গানের সেই অনন্য সাধারন শিল্পীদের একজন যাদের গায়কীর স্বাতন্ত্র্য আর গানের আবেগের সাথে মিশে যাওয়া, শব্দ বুঝে উচ্চারণ কিংবদন্তীতে পরিণত। সামিনা বলছিলেন, সাগরের তীর থেকে গানে ‘’তীর’’ শব্দটি তিনি শাহনাজের মতো করে উচ্চারন করতে পারেন না বহু চেষ্টা পরও।
এ অনন্যা দীর্ঘজীবী হবেন এ কামনা করছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।