এ জগতে মানুষ কারা
ভারতীয় মুসলমানদের বোরকা-টুপি পরাতে চায় বিজেপি!
২০১১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আহমেদাবাদে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ‘সদ্ভাবনা’ নামের একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। ওই অনুষ্ঠানমঞ্চে ‘পীরানা বাবা’ হিসেবে পরিচিত সৈয়দ মেহেদী হুসাইন নামের একজন সুফিবাদী মুসলিম নেতা বিজেপি নেতা ও গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উপহার হিসেবে একটি টুপি দিয়েছিলেন। এই উপহার তখন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন মোদি। এ ঘটনা নিয়ে তখন ভারতের গণমাধ্যমে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল।
নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, সেই নরেন্দ্র মোদি ভুপালে ২৫ সেপ্টেম্বর এক সমাবেশে হাজির হওয়া মুসলমান পুরুষদের জন্য টুপি এবং নারীদের মধ্যে বোরকা বিলি করেছেন।
টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে টুপি ও বোরকা পরা অসংখ্য নারী-পুরুষকে ওই সমাবেশে দেখা গেছে। ভুপালের অনুষ্ঠান ছাড়াও বিজেপির আরও কয়েকটি সমাবেশে টুপি ও বোরকা পরা মুসলমান নেতা-কর্মীদের দেখা গেছে।
কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক দিগ্বিজয় সিংয়ের দাবি, সমাবেশে যোগ দেওয়া মুসলমান নারীদের পরানোর জন্য বিজেপি ১০ হাজার বোরকা কিনেছে।
যে বিজেপি মুসলমানদের সরাসরি ‘সামাজিক প্রতিবন্ধকতা’ আখ্যা দিয়ে আসছে, ইউনিফর্ম সিভিল কোড বলবত্ করার মাধ্যমে ভারতে ইসলামি ভাবধারার পোশাক নিষিদ্ধ করার দাবি করেছে এবং সংখ্যালঘুর ধারণার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে; তারা হঠাত্ করে এতটা মুসলিমবান্ধব হয়ে উঠল কেন? এই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে সামনে এসেছে।
গত শনিবার পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত ‘ডন’ পত্রিকায় ভারতের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও লেখক এ জি নূরানির লেখা ‘দ্য বিজেপি উজ মুসলিমস’ শিরোনামের একটি কলাম ছাপা হয়েছে।
তাঁর লেখায় এ প্রশ্নের জবাব বেরিয়ে এসেছে।
নূরানি লিখেছেন, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে, মুসলমান ভোটারদের টার্গেট করে প্রচারণায় নেমেছে বিজেপি। বাবরি মসজিদ ভাঙা এবং গুজরাট দাঙ্গায় মুসলিম নিধনের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির নাম যেভাবে জড়িয়ে আছে, তা মুছে দিতে না পারলেও নিদেনপক্ষে ম্লান করতে চাইছে বিজেপি। এ লক্ষ্যে টুপি-বোরকার রাজনীতির পথে হাঁটা শুরু করেছেন মোদি।
আগামী নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন মোদি।
রাজনীতির মাঠে এগিয়ে থাকতে তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজনকে দলে ভেড়াতে চাইছেন।
এ জি নূরানি তাঁর কলামে লিখেছেন, ‘এশিয়ান এজ’ পত্রিকার সাংবাদিক সঞ্জয় বসাককে বিজেপির একজন নীতিনির্ধারক বলেছেন, কংগ্রেস মুসলমানদের একচেটিয়া ভোট পাক, এটা বিজেপি চায় না। বিজেপি চায়, মুসলমান ভোট ব্যাংক সেক্যুলার পার্টিগুলোর মধ্যে ভাগ হয়ে যাক। এতে লোকসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে।
নূরানি মনে করেন, যেসব রাজ্যে ব্যাপকসংখ্যক মুসলিম ভোট রয়েছে সেখানে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ ও বিহারের ক্ষেত্রে বিজেপির এই নীতি দারুণ গুরুত্ব বহন করে।
গত নির্বাচনে বিজেপি উত্তর প্রদেশে ৮০ আসনের মধ্যে মাত্র ১০টি এবং বিহারে ৪০ আসনের মধ্যে মাত্র ১২টি আসন পায়। এবার তারা উত্তর প্রদেশে কমপক্ষে ৪০ এবং বিহারে কমপক্ষে ২৫টি আসনে জেতার লক্ষ্য নিয়েছে। আর এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজবাদী পার্টি এবং বিহারে ক্ষমতাসীন জনতা দল (সংযুক্ত), কংগ্রেস ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের আরজেডির মধ্যে মুসলিম ভোট ভাগ করে ফেলতে হবে। অর্থাত্ কংগ্রেস যাতে একচেটিয়াভাবে মুসলমানদের ভোট না পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
এ জি নূরানি লিখেছেন, মোদি হিসাব করে দেখেছেন, তিনি যদি গুজরাটের মতো রাজ্যে মুসলমানদের ২৫ শতাংশ ভোট পেতে পারেন, তাহলে জাতীয় পর্যায়ে বিজেপির পক্ষে সেটা অর্জন করা সম্ভব হবে না কেন? আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে প্রথমেই মুসলমানদের মধ্যে বড় ধরনের বিভক্তি সৃষ্টি করতে হবে।
গত মাসে মোদি তাঁর দল বিজেপিকে ‘প্রান্তিক ও অনগ্রসর মুসলমানদের’ দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর দাবি, গুজরাটে বিজেপির স্থানীয় কমিটিতে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত যথার্থ ছিল। ১০ সেপ্টেম্বর জয়পুরেও মোদির জনসভায় টুপি পরা বহু মুসলমানকে যোগ দিতে দেখা গেছে। এদিক থেকে মধ্য প্রদেশও পিছিয়ে নেই। মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা শিবরাজ সিং চৌহান দলটির চেহারায় ‘উদার’ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
২৫ সেপ্টেম্বর ভুপালে আয়োজিত সভায় মুসলমান পুরুষদের টুপি ও নারীদের বোরকা পরে উপস্থিত হওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন বিজেপির সংখ্যালঘু সেলের প্রধান হেদায়েতুল্লাহ শেখ। তিনি বলেন, তাঁদের দেখে যাতে বোঝা যায় যে তাঁরা মুসলমান; সেটা নিশ্চিত করতেই তাঁরা এই উদ্যোগ নিয়েছেন।
এ জি নূরানি লিখেছেন, জয়পুরের জনসভায় যোগ দেওয়া মুসলমান নারী-পুরুষের মধ্যে বিজেপি পাঁচ হাজার টুপি ও বোরকা বিতরণ করেছে। এমনকি মুসলমান যে নারীরা এমনিতে বোরকা পরেন না, ওই সমাবেশে যোগ দিয়ে তাঁরাও বোরকা পরেছেন।
বিজেপি জন্মলগ্ন থেকেই মুসলমানদের ‘অনগ্রসর’ আখ্যা দিয়ে এসেছে।
ইউনিফর্ম সিভিল কোড বলবত্ করার মাধ্যমে ভারতে ইসলামি ভাবধারার পোশাক পরাসহ ইসলামি সংস্কৃতিভিত্তিক ব্যক্তিগত জীবনাচার নিষিদ্ধ করার দাবি এসেছে। এমনকি সংখ্যালঘুর ধারণার বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। কংগ্রেস যখন সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করে, তখন বিজেপি এর ঘোর বিরোধিতা করেছিল। সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের পরিবর্তে বিজেপি মানবাধিকার কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে।
ভারতের প্রতি সে দেশের মুসলমানদের আনুগত্য থাকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিজেপির।
পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে বিজেপির স্পষ্ট অনীহা থাকলেও মুসলিম ভোটারদের সামনে এলে দলটির নেতারা পাকিস্তানের স্তুতি করতেও দ্বিধা করেন না।
১৯৯৮ সালের ৪ অক্টোবর বিজেপির নেতা ও তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী নিখিল ভারত মুসলিম নারী সম্মেলনে ভাষণ দেন। ওই সম্মেলনের আয়োজন করে বিজেপির নারী শাখা। ওই ভাষণের পুরোটাই ছিল পাকিস্তানের প্রতি বাজপেয়ীর শুভেচ্ছাবাণী।
বিজেপির মধ্যে এই প্রবণতা শুরু হয়েছিল ১৯৯৫ সালে, অর্থাত্ ১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক এক বছর আগে থেকে।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার পর এটিই ছিল প্রথম সাধারণ নির্বাচন। ওই নির্বাচনের আগে বিজেপি তাদের সব অপরাধ ঢেকে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
তবে গত ১৮ বছরে মুসলমানদের কোনো দাবির পক্ষে বিজেপি কথা বলেনি। তাদের শোকের ক্ষতে একবারের জন্যও সমবেদনার মলম দেয়নি বা নিজেদের ক্ষিপ্তবত্ নীতি থেকে একচুলও সরে আসেনি। ‘সংঘ পরিবার’ বলে পরিচিত বিজেপি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) নেতৃত্বাধীন কট্টরপন্থী জোটের একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে, যার ব্যাপারে জোটটি কখনোই আপস করে না।
এই সংঘ পরিবার মনে করে, হিন্দু থেকে যারা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান বা খ্রিষ্টান হয়েছে, তাদের অবশ্যই ‘শুদ্ধি’র মাধ্যমে পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফিরে আসতে হবে। মুসলমান বা খ্রিষ্টানরা হিন্দুদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করতে পারবে না। তারা নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে, তবে অবশ্যই তাদের হিন্দু সংস্কৃতিকে ব্যক্তি জীবনে ধারণ করতে হবে।
নূরানি লিখেছেন, প্রতিবার নির্বাচনের ঠিক আগে এসে বিজেপির এমন মুসলিমপ্রীতিকে ‘পাপিষ্ঠের পরিতাপের প্রমাণ’ বলে ধরে নেওয়া যায়। তবে বিজেপির এই মুসলিমপ্রীতির ফাঁদে পা দিলে আবারও ভারতের মুসলমানদের প্রতারিত হতে হবে বলে মনে করেন এ জি নূরানি।
View this link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।