চেয়ারটাতে সে খাড়া হয়ে বসেছিল, দেয়ালে ঝুলানো দুটো মৃত রাজহাঁস আর আইরিশ সেটার কুকুরের সেই অদ্ভুত ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে । ক'টা বাজে এখন? হাত ঘড়ি দেখল সে, তিনটা বেজে পঁচিশ । সময় কাটাতে হবে, কোন ভাবে সময় কাটাতে হবে । টেলিভিশন দেখতে ভালো লাগে না, তাত্ত্বিক বইয়ে মন ঢুকবে না এখন- হয়ত রক্তপাত আবার শুরু হয়ে যাবে তাতে । আধ ঘন্টার ভেতর তারা চলে আসবে, তাকে নিতে ।
তারপর চোখে চোখ, স্বস্তির স্পর্শ, সংযত মাপা হাসি । তারপর শুরু হবে জিজ্ঞাসা । ধীরে ধীরে ।
-এখানে কেটেছে?
-এখানে ব্যথা এখনও?
সে কিছু বলতে চায়নি, শুধু মন ভালো করে দেয়া কিছু কবিতা পড়তে চাইছিল । কেউ তাকে বিরক্ত করুক তা চাইছিল না; অবশ্য সেইভাবে কেউ বিরক্ত করছিলও না ।
ক্ষুধার্ত দু'একজন ছাড়া, তারা সেই গোপন কথাটি জানতে চাইছিল । ক্ষুধার্ত তারা দু'একজন হয়ত ভাবছিল একটা গোপন কথা তো অবশ্যই আছে । তারা পরে আরও প্যাঁচাবে, সে জানত । ফিসফিসিয়ে কথা বলবে, বইয়ের পাতার পর পাতা উলটে যাবে । বইয়ের পাতাগুলো যেন রক্ত-মাংসের শরীর ।
সে শুধু বলতে চাইছিল, এরকম কোরো না । যদি আমি ভুল করে থাকি, সে দায় আমার । কিন্তু তোমরাও কেন ভুল করবে?
কিন্তু তার ভুল কি ছিল তাও সে বুঝতে পারছিল না । কিছু অক্ষরের কি প্রচণ্ড শক্তি, কি প্রচণ্ড মাদকতা! শুধুমাত্র কিছু শব্দ! একি বিশ্বাসযোগ্য কিছু? শব্দগুলো যেন তার চুলগুলো বাতাসে ভাসিয়ে নিচ্ছে, তাকেও কি অদ্ভুত আকর্ষণে মাটি থেকে উঠিয়ে নিচ্ছে! শূন্যতায় ভাসছ তুমি এখন! তোমার নবজন্ম হয়েছে! অসীম ছুঁয়েছ তুমি-যে মুহূর্তে এই শব্দগুলোকে তুমি অবিশ্বাস করবে, তখুনি তুমি শূন্যে ভাসার ক্ষমতা হারাবে, আর উড়তে পারবে না কিছুতেই!
সেজন্যই সে চেয়ারটাতে বসেছিল, উড়তে পারছিল না । বিশ্বাসের উপর ঠিকভাবে বিশ্বাস রাখতে পারছিল না, তাই নতুন করে জন্মও নিতে পারছিল না ।
উপরে ভাসতে গিয়েও সে ক্রমশঃ মাটিতে নেমে আসছিল । এক দুই তিন চার গুনতে গুনতে সে নেমে আসছিল, চারপাশের ছায়াদের কথা শুনে, তীক্ষ্ণতাকে স্পর্শ করে, দুঃখগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে নেমে আসছিল ।
তারা চলে আসবে খুব শিগগীরই । সময় হয়ে এসেছে । তুষারঢাকা পথে করে তাকে নিয়ে যেতে আসবে তারা ।
গাড়ীতে সেই দুজন সামনের সিটে বসে হয়ত গাড়ীটার কোন বৈশিষ্ট্য নিয়ে অযথাই কথা বলবে । শুধু তারই কোন কথা বলার মত ক্ষমতা আর হয়ত থাকবে না তখন । গাড়ির কাঁচের ধুসরতায় বরফকুঁচি কিভাবে আটকে যায় নিনিরমেষ তাই হয়ত দেখবে, হয়ত ওয়াইপারে বরফকুঁচি মুছে ফেলা দেখবে শুধু, অথবা, দেখবে সাদা বরফকুঁচি কিভাবে তার রক্তে লাল হয়ে উঠে ।
শত শত অক্ষর, এক অদম্য শক্তি আর লাল বরফকুঁচির সাথে এক অচেনা সুর দীর্ঘায়িত হতে থাকে, নিউরণে বসন্তের মৌমাছির সুরে গুনগুণ করতে থাকে । কোন নিজস্বতা নেই, মিষ্টি কোন রাগিণীর মাঝে নিজেকে অন্বেষণ নেই, নিজস্ব কোন পরিচয় নেই ।
জনারণ্যে সারি সারি ভদ্র মুখগুলো তার কথার অপেক্ষায়, হয়ত অসংখ্য হাততালি পড়বে, হয়ত ছাঁচে ফেলা গদবাঁধা শব্দের তালিকা একসময় ওষুধ গেলার মতই, তাকে গিলে ফেলবে । সে হাতদুটো মুঠিবদ্ধ করে ফেলে । মঞ্চের দিকে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যায় সে ।
কবিতায় আজ শুধু আমি আমার কথাই বলতে চাই । ভালো আর মন্দের সংজ্ঞা তোমরা দিও ।
আমি আজ শুধু আমার কথাই বলি । ভালো-মন্দে মেশানো এই আমি'র কথা । আমার অস্তিত্ব আর অভিজ্ঞতার কথা । আমার অস্তিত্ব আর অভিজ্ঞতার বাইরের কিছু স্বপ্নের কথা । এক ঘাসফুলকে ভালবেসে আমার ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়ার কথা ।
নিজেকে মেলে দেয়ার সাথে নিজেকে গুঁটিয়ে নেয়ার কথাও বলব আজ আমি । আমার সশব্দ হয়ে নীরব হওয়ার কথা । আজ জেনে নাও সত্যিকারের এই আমিকে । অনবদ্য কিছু দেয়ার সামর্থ্য কখনো নেই; আমার আর্তনাদ, লাল-নীল কষ্টের অক্ষরগুলো, জেনে নিও শুধু, আমারই আরেক নাম ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।