রূপকথার গল্প কি এর চেয়ে রোমাঞ্চকর হতে পারে! আফগান ক্রিকেটের উত্থানের গল্প সত্যিই রূপকথাকেও হার মানায়। মাত্র পাঁচ বছর আগে যে দেশটি বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে দুর্বল স্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত, পাঁচ বছরের ব্যবধানে সেই দেশটিই ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্তরে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। টেস্ট ক্রিকেটের স্বাদ নিতে হয়তো এখনো অনেক বাকি, কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে একদিনের ক্রিকেটের বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়াটা অনেক বড় এক অর্জন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আফগানদের অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চেও তারা এরই মধ্যে আবির্ভূত হয়েছে। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও পা রেখেছে তারা।
কিন্তু বিশ্বকাপ ক্রিকেট, সে তো এক অনন্য অর্জনই। পাঁচ বছর আগে আইসিসির পঞ্চম ডিভিশনে জার্সিকে হারিয়ে দেশটির যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়ে তারা সে পথচলার পূর্ণতা দিল। প্রিয় পাঠক, আসুন একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক বিশ্ব ক্রিকেটে আফগানিস্তানের পথচলার বিভিন্ন পর্যায়ের দিকে। এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, সময়ের হিসাবে আফগান ক্রিকেটের এগিয়ে চলার গল্প ক্রিকেটপ্রেমীর হূদয়কে আলোড়িত করবেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামোহীন এই দেশটির ক্রিকেটাররা দেশপ্রেমের বলে যে ইতিহাস সৃষ্টি করল, তা মনের গহিনে ঝড় না তুলে পারেই না।
২০০১ সাল: পথচলা শুরু
তালেবান হিংস্রতা আর অন্ধতার হাত থেকে তখন সবে আফগানদের পরিত্রাণ মিলেছে। কিন্তু দেশজুড়ে তখন অনিশ্চয়তা। কাবুল-কান্দাহারের ভূমি তখন রক্তাক্ত, মার্কিন দখলদার সেনাদের পদভারে ন্যুব্জ। জীবনযুদ্ধের অনিশ্চয়তা তখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে গোটা আফগানিস্তানে। চাকরি নেই, খাবার নেই, নেই নিরাপত্তা।
জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো যেখানে মুখ্য, সেখানে খেলাধুলার মতো বিলাসিতা অনেক গৌণ এক ব্যাপার বলেই তখন আফগানিস্তানে বিবেচিত। কিন্তু যুদ্ধের দামামার আওয়াজ যেন আফগান তরুণদের কানে না পৌঁছায়, সে কারণেই হয়তো আফগান সরকার খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি খেলায় পথচলা শুরু হলো। আফগানিস্তানে ক্রিকেটের প্রসারের পেছনে প্রতিবেশী পাকিস্তানের একটা ভূমিকা ছিল সব সময়ই। আফগানিস্তানে বসবাসরত পাকিস্তানিদের হাত ধরেই আফগানিস্তানে ক্রিকেটের চর্চা শুরু হয়।
তখন আফগানরা ক্রিকেট খেলাটা সেভাবে বুঝে ওঠেনি। অভিবাসী পাকিস্তানিরাই টুকটাক ক্রিকেটের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে আফগানরা ক্রিকেটে অনুরক্ত হতে শুরু করে। ২০০১ সালে আফগানিস্তান আইসিসির অ্যাফিলিয়েটেড সদস্যপদের জন্য আবেদন করে। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থার কাছ থেকে তারা তা পেয়েও যায়।
শুরু হয় আনুষ্ঠানিকভাবে আফগান ক্রিকেটের পথচলা। আফগান জাতীয় ক্রিকেট দল প্রথমবারের মতো বিদেশ সফর করে। সফরটা অবশ্য খুব দূরদেশে হয়নি। হয়েছিল প্রতিবেশী পাকিস্তানে। সেখানে তিনটি সীমিত ওভারের ম্যাচে অংশ নিয়ে প্রতিটিতেই হারে তারা।
তবে সম্ভাবনার ইঙ্গিত ছিল দুটি বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচে। পাকিস্তানের আঞ্চলিক দুটো দলের সঙ্গে ওই বড় দৈর্ঘের ম্যাচ দুটি ছিল অমীমাংসিত।
২০০৪ সাল, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রথম অংশগ্রহণ, প্রথম জয়
এ বছর এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল আয়োজিত এসিসি ট্রফিতে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে আফগানিস্তান। প্রথম অংশগ্রহণটা তাদের ছিল স্বপ্নের মতোই। বাহরাইনকে হারিয়ে তারা প্রথম জয় তুলে নেয় সেই আসরে।
২০০৭ সাল, প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়
এসিসি ট্রফিতে অংশ নেওয়ার তিন বছরের মাথায় আফগানিস্তান প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপাটাও নিজেদের করে নেয়। এটি অবশ্য ছিল টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতা। এসিসি টি-টোয়েন্টি কাপের ফাইনালে আফগানদের কাছে হারে ওমান। পরে ২০০৯, ২০১১ এবং এ বছর আফগানিস্তান এই প্রতিযোগিতার শিরোপা জিতেছে।
২০০৮ সাল, বিশ্ব ক্রিকেট লিগ পঞ্চম ডিভিশনের শিরোপা জয়
বিশ্ব ক্রিকেট লিগের পঞ্চম ডিভিশনের সেরা দল হয়ে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ বাছাই খেলার সুযোগ পায় আফগানিস্তান।
সেরা হওয়ার পথে তাঁরা পরাভূত করে জার্সিকে। পঞ্চম ডিভিশনের শিরোপা জয় করার পরপরই আফগান ক্রিকেটে দারুণ এক জোয়ার দেখা দেয়। ক্রিকেট হয়ে ওঠে দেশটির অন্যতম জনপ্রিয় খেলা।
২০০৯ সাল, এবার তৃতীয় ডিভিশনের শিরোপা জয়
বিশ্ব ক্রিকেট লিগ, তৃতীয় ডিভিশন ছিল ২০১১ সালে উপমহাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের বাছাই প্রতিযোগিতা। এই আসরে আফগানদের অবস্থান ছিল ষষ্ঠ।
তবে এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ক্রিকেটে একটা বড় অর্জনের দিকে এগিয়ে যায় আফগানিস্তান। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে স্থান করে নিতে না পারলেও এই প্রতিযোগিতার ফলাফলে দেশটি পেয়ে যায় একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার ছাড়পত্র, ওয়ানডে মর্যাদা।
২০১০, বিশ্ব পর্যায়ে প্রথম পদক্ষেপ
ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের ফাইনালে আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম ফরম্যাটের বিশ্ব আসরে পৌঁছে যায় আফগানিস্তান। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বিশ্বসেরা দুটি দলের বিপক্ষে আফগানিস্তানের লড়াই মুগ্ধ করে ক্রিকেট বিশ্বকে। একই বছর আইসিসির সহযোগী সদস্যদের নিয়ে আয়োজিত প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট প্রতিযোগিতা আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল কাপ জয় করে আফগানিস্তান।
ফাইনালে তারা হারায় স্কটল্যান্ডকে। এখানে উল্লেখ্য, আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ না পেয়ে কেবল ক্রিকেটশৈলীর গুণে আফগানিস্তানকে এই প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ দেওয়া হয়। আইসিসির এই আস্থার প্রতিদান আফগানরা বেশ ভালোভাবেই দিয়েছিল, বলাই বাহুল্য।
একই বছর আরও একটি সাফল্যে উজ্জ্বল আফগান ক্রিকেট। এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় রুপার পদক জয় করে তারা।
সেমিফাইনালে আফগানিস্তানের কাছে ২২ রানে হেরে যায় পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-২৩ দল। ফাইনালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দলের কাছে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়েই পরাভব মেনেছিল আফগানরা।
২০১২ সাল, আরেকটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
বাছাইপর্বে এবার অবশ্য চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি আফগানিস্তান। ফাইনালে হেরে যায় আয়ারল্যান্ডের কাছে। এ বছরই শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দ্বিতীয়বারের মতো পা রাখে আফগানিস্তান।
ভারত ও ইংল্যান্ডের সঙ্গে মোকাবিলায় অবশ্য খুব ভালো কিছু করতে পারেনি তারা। তবে তাদের খেলায় ক্রমোন্নতির ছাপটা ছিল সুস্পষ্ট। এ বছরই ওয়ানডে মর্যাদা পাওয়ার পর বিশ্ব ক্রিকেটের শীর্ষ দুই দল পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একদিনের ক্রিকেটে মাঠে নামে আফগানিস্তান
২০১৩ সাল বিশ্বকাপ ক্রিকেটের স্বপ্ন পূরণ
অবশেষে বিশ্ব ক্রিকেট লিগে রানার্স আপ হয়ে ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার যোগ্যতা অর্জন। তবে এর আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উঠে আসা দল হিসেবে সমীহটা কিন্তু ঠিকই আদায় করে নিতে পেরেছে গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত দেশটি। ক্রিকেটীয় ভবিষ্যত্ যে তাদের উজ্জ্বল, সামনের দিনগুলোতে আরও চমত্কার রূপকথার জন্ম দিতে যে তারা প্রস্তুত, সেটা বোধহয় হলফ করেই বলে দেওয়া যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।