ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় বলেছেন, পশ্চিমারা এগিয়ে না এলে ইসরায়েল একাই ইরানকে দেখে নেবে। নেতানিয়াহুর এ বক্তব্য কেবল হুমকি নয়, বরং গভীর অক্ষেপের ফল। ইসরায়েল চাইছে, পশ্চিমারা ইরানকে পারমাণবিক গবেষণার কাজ বন্ধ করতে বাধ্য করুক। অথচ পশ্চিমারা তাতে গা করছে না।
পশ্চিমাদের কি তবে কোনো তাড়া নেই? নিশ্চয়ই আছে।
শুধু আছে নয়, বরং পশ্চিমারা ছুটছে সময়ের বিরুদ্ধে। সময় যত পেরোচ্ছে, পশ্চিমাদের ওপর চাপ বাড়ছে তত। এ সুযোগে ইরান নিজের গাম্ভীর্য ও গর্ব নিয়ে কথা বলছে পশ্চিমাদের সঙ্গে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দায় ঠেকেছে পশ্চিমাদের, ইরানের নয়। তবে সত্যি হলো, পশ্চিমাদের একটি অংশ চাইছে, ইরানের সঙ্গে সমঝোতার সব পথ বন্ধ হোক, যুদ্ধ বাধুক আর ফুলেফেঁপে উঠুক ‘যুদ্ধ অর্থনীতি’।
ইরানও পরিস্থিতি বোঝে। আর তাই পশ্চিমাদের সঙ্গে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে যার-পর-নাই চেষ্টা চালাতে কসুর করছেন না দেশটির প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রিপরিষদ। তবে ইরান পা ফেলছে সাবধানে।
রয়টার্স বলছে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক সাক্ষাত্কারে জানিয়েছেন, তেহরানের পারমাণবিক গবেষণা নিয়ে আলোচনায় বসার আগে ষড়শক্তির উচিত নতুন পরিকল্পনা ও প্রস্তাব ঘোষণা করা। আসছে ১৫-১৬ অক্টোবর জেনেভায় তেহরানের সঙ্গে ষড়শক্তির আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, গত ফেব্রুয়ারিতে ষড়শক্তি যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তেহরানের উচিত সেটা মেনে কাজ করা। তবে সমঝোতায় পৌঁছানোর উপায়গুলোর ব্যাপারে আলোচনার বিভিন্ন পক্ষ একমত না হলে কী হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। যদিও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি জানিয়েছেন, তিনি ছয় মাসের মধ্যে ষড়শক্তির সঙ্গে সন্ধি করতে চান।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য চীন, ফ্রান্স, ব্রিটেন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানিকে নিয়ে গঠিত ষড়শক্তির জোট (সাধারণত ইংরেজিতে পাওয়ার ফাইভ প্লাস ওয়ান) গত ফেব্রুয়ারিতে ইরানকে একটি প্রস্তাব দেয়। তাতে শর্ত ছিল, ইরানকে তার ইউরেনিয়াম শোধন ২০ শতাংশ কমিয়ে দিতে হবে; যা পরিশোধন হয়েছে, তা দেশের বাইরে অন্য কোনো দেশের হাতে তুলে দিতে হবে এবং শোধন চলছে এমন একটি স্থাপনা বন্ধ করে দিতে হবে।
এর বদলে ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হবে এবং দেশটি তার সোনা ও মূল্যবান ধাতুর বাণিজ্য করতে পারবে।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, গত সপ্তাহে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ইরানকে দেওয়া প্রস্তাব নিয়ে আলাপ করেছেন। কেরি চাইছেন, চীন ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করুক, যাতে ইরান বর্তমান প্রস্তাবে রাজি হয়।
গত শনিবার রাতে এক ইরানি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জাফরি বলেন, ‘পি ফাইভ প্লাস ওয়ান এর আগে ইরানকে যে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটি একটি ঐতিহাসিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। নতুন করে আলোচনা শুরুর জন্য ষড়শক্তির নতুন প্রস্তাব দেওয়া উচিত।
... ওই পক্ষের সদস্যদের এসব অলীক চিন্তা বাদ দেওয়া উচিত যে চাইলেই ইরানের জনগণের ওপরে যা খুশি চাপিয়ে দেওয়া যায়। ’
গত জুনে রুহানির নির্বাচিত হওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করা জাফরিকে তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধান পারমাণবিক পরামর্শক নিয়োগ করার ঘটনা ইরানের জনগণ ও বিশ্বশক্তিদের আশান্বিত করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কয়েক দশক ধরে ইরানের পারমাণবিক গবেষণা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো যে ধোঁয়াশা তৈরি করেছে, এবার তা কেটে যাবে।
পশ্চিমা দেশগুলো দাবি করছে, ইরানের পারমাণবিক গবেষণার উদ্দেশ্য হলো বোমা ও গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করা। কিন্তু ইরান বলছে, তার এ গবেষণা পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হবে।
ওষুধ ও বিদ্যুত্ উত্পাদন করা তার মুখ্য লক্ষ্য।
সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই
দুপক্ষই চাইছে, অপরপক্ষ প্রথম পদক্ষেপ নিক। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরেঞ্জ ফেবিয়াস ‘ইউরোপ ওয়ান রেডিও’কে গতকাল রোববার বলেন, ‘(ইরানের পক্ষ থেকে) নতুন একটি কথা শোনা যাচ্ছে। আমরা চাই, তা আন্তরিক হোক। কিন্তু আমাদের দেখা দরকার তাতে কতটুকু কাজ হচ্ছে।
’
তবে লরেঞ্জ বলেন, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখতে পশ্চিমা দেশগুলো যে লক্ষ্য ঠিক করেছে, তা অর্জনের জন্য হাতে সময় খুবই কম। পশ্চিম ইরানের আরকে যে ভারী পানির চুল্লিটি আছে, সেটিতে আর কিছুদিন পরই প্লুটোনিয়াম তৈরি করা যাবে।
লরেঞ্জ বলেন, ‘যদি চুল্লির কাজ একবার শেষ হয়ে যায়, তবে আমরা তা কখনোই ধ্বংস করতে পারব না। কারণ ওই এলাকায় বোমা ফেললেই প্লুটোনিয়াম চুল্লিতে ফাটল দেখা দেবে। অর্থাত্ আমরা এখন সময়ের বিরুদ্ধে লড়ছি।
’
সক্ষমতা অর্জনের জন্য ইরানের কত সময় লাগতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে লরেঞ্জ বলেন, ‘লোকে তো বলে এক বছরের মতো ... আশা করছি এ ধরনের সমঝোতায় পৌঁছাতে পারব, তবে আমাদের হাত চালাতে হবে। ’
গত মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় রুহানি ও জাফরি বৈঠক, ভাষণ ও সাক্ষাত্কারের মধ্য দিয়ে ইরান বিষয়ে পশ্চিমাদের অবিশ্বাস কাটানোর চেষ্টা করেছেন। এর ফল হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রুহানিকে ফোন করে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন।
সমঝোতা বৈঠক নিয়ে উভয় প্রেসিডেন্টই নিজ দেশে বিরোধিতার মুখে পড়ছেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশীয় স্বার্থ যাতে খর্ব না হয়, সে চাপ আছে সব পক্ষ থেকেই।
তবে এ ক্ষেত্রে রুহানির অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো। সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্ট রুহানির তত্পরতাকে সমর্থন করেছে। এ ছাড়া দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি গত শনিবার রুহানির কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
তবে খামেনি বলেছেন, তিনি সমঝোতার অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করেন না। খামেনির সঙ্গে সুর মিলিয়ে জাফরিও বলেছেন, ‘আমরা তাদের (মার্কিনদের) বিশ্বাস করি না।
ইরানের জনগণের আস্থা অর্জনে তাদের উচিত প্রকাশ্য ও গোপন আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বাস তৈরি করা। ’
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।