আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রসঙ্গ - পবিত্র ঈদ -উল-আযহায় প্রানি কুরবানি

প্রত্যেক মানুষই প্রতিভা নিয়ে জন্মায়, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা ধরে রাখতে পারেনা
বাংলাদেশের আকাশে ১৪৩৪ হিজরি সনের জিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখা গেছে। অতএব হিসাব মোতাবেক আগামী ১৬ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে উদযাপিত হতে যাচ্ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল- আযহা। ত্যাগের সাধনা, অন্তরের কুপ্রবৃত্তি তথা রিপু দমন,দানশীলতা তথা পরোপকার, আত্মশুদ্ধি ইত্যাদি মর্মবাণীকে হৃদয়ে ধারন ও লালনের সংস্কৃতি জাগ্রতকরনের নিমিত্তে প্রতি বছর ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জীবনে অপার আনন্দের উপলক্ষ হয়ে আসে পবিত্র কুরবানির ঈদ। মহান আল্লাহ তায়ালার আদেশ কিংবা ইচ্ছাকে শিরোধার্য জ্ঞান করে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) নিজের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ একমাত্র শিশুপুত্র ইসমাইলকে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হলে পরম করুণাময়ের নির্দেশে ইসমাইল(আঃ) এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কুরবানি হয়ে যায়। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর এই নিঃশর্ত ত্যাগের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য সেই থেকে বিশ্বের সকল মুসলমানদের জন্য হালাল প্রানি কুরবানি ফরয হয়ে যায়।

প্রানি কুরবানির মাধ্যমে সমগ্র মুসলিম জাহানের উম্মতগণ ত্যাগের এ অভূতপূর্ব ঘটনাকে স্মরণপূর্বক তা থেকে দীক্ষা লাভ করে ব্যক্তিগত জীবনে দৃষ্টান্ত স্থাপনে উদ্বুদ্ধ হন। হযরত ইব্রাহীম আঃ পরবর্তী যুগে প্রানি কুরবানির পর মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক যাদের কুরবানি কবুল হত সে সকল প্রানি সমুহ গায়েবি কায়দায় ভস্মীভূত হয়ে যেত। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর উম্মতদের অসম্মানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এ পদ্ধতি রহিত হয়ে কুরবানির প্রানির গোশত ভক্ষণ করার অনুমতি পাওয়া যায়। প্রিয় নবীর উম্মত হিসাবে এ পরম সৌভাগ্যের জন্য আমাদের অবশ্যই মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে শুকরিয়া আদায় করা উচিত। নইলে পূর্বের পন্থায় কুরবানি চালু থাকলে বর্তমানে কত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে কুরবানি কবুল না হওয়ার কারনে জনসমক্ষে অপদস্থ হতে হত তা একবার চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন।

যেহেতু প্রানি কুরবানির পর এর গোশত খাওয়ার রেয়াজ চালু আছে, তাই আসন্ন ঈদে কুরবানির প্রানিকে ঘিরে আমাদের নিতে হবে সম্ভাব্য সকল প্রস্তুতি। আর প্রস্তুতি ভাল থাকলে যে কোন ইভেন্ট সম্পন্ন করা যায় নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে। তাই কুরবানির কর্মযজ্ঞে নামার আগে এ সংক্রান্ত কিছু দিক নির্দেশনা মূলক টিপস জানা থাকলে প্রয়োজনের সময় তা দারুন উপকারে আসবে। কুরবানির প্রানি ক্রয়ের পূর্বে নিজের নিয়ত পরিস্কার থাকা অত্যাবশ্যকঃ প্রানি কুরবানি দেওয়া হয় মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য। তাই শুধুমাত্র এ নিয়তে কুরবানির প্রানি কিনতে হবে।

কুরবানির নামে কিছুতেই বিলাস ব্যাসনে নিমগ্ন হওয়া যাবে না। কুরবানির ঈদ এলে অনেকের মধ্যে নতুন ফ্রিজ কেনার হিড়িক পড়ে যায়। আস্ত গরু কেটে ফ্রিজ ভর্তি করে রেখে দেয়া হয় ভবিষ্যৎ রসনা বিলাসের কথা মাথায় রেখে। যারা এ ধরনের মজুদদারিতে অভ্যস্ত তাদের কুরবানি কখনোই কবুল হবে না। কুরবানির গোশত ৩ ভাগ করে ১ ভাগ নিজে রেখে বাকি ২ ভাগের ১ ভাগ গরীব আত্মীয়স্বজন এবং ১ ভাগ গরীব মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়াই শ্রেয়।

এতে ঈদের আনন্দ সবার মাঝে সুষম বণ্টন হয়, আর এটাইতো ইসলামের শিক্ষা। আর প্রানি ক্রয়ের সময় দাম নিয়ে অন্যের সাথে ছেলে মানুষী প্রতিযোগিতাসহ অন্যান্য অহেতুক লোক দেখানো বাগাড়াম্বর ( প্রানির গায়ে প্রাইস ট্যাগ ঝুলানো, মালা পরানো কিংবা গায়ে রং মাখিয়ে এলাকায় ঘুরানো ) পরিহার একান্ত আবশ্যক। কেমন হওয়া উচিত কুরবানির প্রানিঃ (১) কুরবানির প্রানি হতে হবে শারীরিক ও মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। (২) কুরবানির প্রানি প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া উচিত। ২-৪ দাঁত যুক্ত (স্থায়ী দাঁত) প্রানি কিনতে হবে, কারন এরাই প্রাপ্ত বয়স্ক।

(৩) কেনার সময় প্রানির শরীরের তাপমাত্রা পরখ করে দেখতে হবে। প্রানির শরীরে অত্যাধিক জ্বর সংক্রামক রোগের লক্ষণ। আমাদের দেশে গরু ও খাসি থাকে কুরবানি তালিকায় সবার উপরের দিকে। তাই এই দুইটি প্রানির শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা জানা থাকা বাঞ্ছনীয়। গরুঃ ১০০-১০১ ডিগ্রী ফাঃ ছাগলঃ ১০২-১০৩ ডিগ্রী ফাঃ (৪) প্রানির নাক, মুখ, পায়ু পথে কোন অস্বাভাবিক নিঃসরণ আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখুন।

অস্বাভাবিক কিছু দেখলে ঐ প্রানি কেনা হতে বিরত থাকুন। (৫) গরু কেনার আগে এর ক্ষুর , জিহ্বা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নিন এটি ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত নয়। এ রোগে গরুর ক্ষুরে ঘা এবং জিহ্বায় ফোস্কা দেখা যায়। (৬) প্রান চঞ্চল ও চটপটে স্বভাবের প্রানি দেখে কিনুন। ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রানিতে রোগব্যাধি থাকার সম্ভাবনা প্রবল।

(৭) বেশি পরিমান মাংস প্রাপ্তির আশায় অধিক মোটা তাজা গরু কিনতে যাবেন না। আজকাল অনেকে বাণিজ্যিক ভাবে ব্রয়লার মুরগির স্টাইলে গরুকে বিভিন্ন স্টেরয়েড ড্রাগ প্রয়োগ করে নাদুস নুদুস ফিগার বানিয়ে কুরবানির হাটে নিয়ে আসে। (৮) প্রানির শরীরের মাংসল অংশে আঙ্গুল দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে দেখুন আঙ্গুলের দাগ বসে যায় কিনা বা পচ পচ শব্দ হয় কিনা। এ ধরনের ক্ষেত্রে অন্য প্রানি দেখুন। (৯) স্ত্রী প্রানি কেনার ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে প্রাণীটির পেটে বাচ্চা নেই নিশ্চিত হয়ে তবেই কিনুন। (১০) সম্ভব হলে দেশি প্রানি কিনুন। গৃহস্থের নিকট হতে গরু –ছাগল ক্রয় সবচেয়ে উত্তম। কুরবানির প্রানি ক্রয়ের আগে ও পরের কিছু ব্যক্তিগত সতর্কতাঃ (১) কুরবানির হাটে যাওয়ার পূর্বে টাকা পয়সা নিরাপদ স্থানে হেফাজত করুন। পকেটমার কিংবা ছিনতাইকারীর হাত থেকে বাঁচতে একাকী হাটে যাবেন না।

দুই একজন সাথী সঙ্গে নিয়ে যান। (২) গরু /ছাগল কেনার পর হাসুলি পরিশোধ করে রসিদ সংগ্রহ করুন। (৩) গরুর গুঁতো থেকে সাবধান। গরুর একটি শিং্যের খোঁচা জায়গামত লেগে গেলে জীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। (৪) প্রানির জন্য খড়, ভুষি, বিচালি, কাঁঠাল পাতা , পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করুন।

তার থাকার জায়গা টা যথাসম্ভব আরামদায়ক করুন। (৫) বেয়াড়া গরুকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাড়তি সতর্কতা হিসাবে অতিরিক্ত মোটা রশি, লাঠি হাতের কাছে রাখুন। মনে রাখবেন কোন কারনে গরু হাত থেকে ছুটে গেলে ওকে ধরতে আপনাকে প্রচন্ড বেগ পেতে হবে। (৬) কুরবানির মাংস কাটার জন্য ছুরি, কাঠের গুঁড়ি , ছাটাই ইত্যাদি আনুসঙ্গিক সামগ্রী আগেই সংগ্রহে রাখুন। (৭) ঈদের দিনে প্রানি কুরবানির জন্য হুজুর এবং মাংস কাটা পার্টিকে অগ্রিম বুকিং দিয়ে রাখুন।

সম্ভব হলে তাদের কিছু বখসিস আগেই দিয়ে রাখুন, নইলে ঈদের দিন ক্রাইসিসে পড়ে যেতে পারেন। কারন এ সময় জুম্মন কসাইদের থাকে হেভভি ডিম্যান্ড। (৮) ঈদের বেশিদিন আগে প্রানি ক্রয় করবেন না। কারন এতে আপনার বাড়ির পরিবেশ নোংরা হবে। প্রানির মল- মূত্র নিয়মিত পরিষ্কার করে ফিনাইল এবং ব্লিচিং পাউডার ছিটাতে হবে।

(৯) কুরবানির প্রানিকে গোসল দিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। (১০) অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে বাচ্চাদেরকে অবলা প্রানি থেকে দূরে রাখুন। কুরবানির প্রানি জবাই এবং পরবর্তী করনীয়/ বর্জনীয় সমূহঃ (১) প্রানি কুরবানির জন্য দক্ষ লোক নিয়োগ করুন। নইলে অর্ধ জবাইকৃত গরু ঝাড়া দৌড় দিয়ে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। (২) প্রানি জবাইয়ের ক্ষেত্রে জোরে আল্লাহর নাম নিতে হবে।

(৩) প্রানির ধমনী যাতে পুরোপুরি কাটা যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রানি জবাইয়ের পর পুরোপুরি ব্লিডিং হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে জবাইয়ের সাথে সাথে মাংস কাটা শুরু করা হলে মাংসের ভেতর রক্ত থেকে যাবে। এ ধরনের মাংস মোটেও স্বাস্থ্য সম্মত নয়, কারন রক্তে অনেক ধরণের জীবাণু থাকতে পারে। (৪) প্রানির চামড়া সাবধানে ছাড়াতে হবে।

চামড়া কেটে গেলে এর বাজার মূল্য অনেক কমে যায়। (৫) প্রানির চামড়া উপযুক্ত দরে বিক্রি করতে হবে, কারন এতে আছে গরিব মিসকিনদের হক। (৬) কুরবানির মাংস শরীয়ত সম্মত উপায়ে বিতরণ করুন। (৭) কুরবানির বর্জ্য যত্র তত্র না ফেলে স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে মাটি চাপা দিন অথবা সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িতে তুলে দিন। ড্রেন নোংরা করবেন না।

প্রানির বর্জ্য ড্রেনে ফেলা হলে ওতে ব্যাপক দুর্গন্ধ ছড়ায়। একান্তই যদি ড্রেনে ফেলতে চান তবে ড্রেনের স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখার ব্যবস্থা করুন। প্রানি কুরবানির স্থানে প্রচুর পানি ঢেলে পরিস্কার করে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিন। ভোজন রসিকদের জন্য বাড়তি কিছু সতর্কতাঃ ভোজন রসিকদের জন্য কুরবানির ঈদ মানেই ভুরি ভোজের মহোৎসব। ঈদ উপলক্ষে বানানো নানা পদের বাহারি খাবার –দাবার দেখে অনেকেই জিহ্বা সংবরণ করতে পারেন না।

এটা পরবর্তীতে তাদের জন্য হিতে বিপরীত হয়। তেলমশলা , চর্বি যুক্ত গুরুপাক খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে ঈদের পুরো আনন্দই কিন্তু মাটি। তাই সকলের প্রতি অনুরোধ- একটু রয়ে সয়ে খাবেন। যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের ঝুঁকি কিংবা কোলেস্টেরল জনিত সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য রেড মিট এক বিপদজনক আইটেম। এ শ্রেণীর ভোজন বিলাসীদের জন্য উত্তম বিকল্প হল চিকেন।

অতএব গিন্নীকে বলুন বেশি বেশি চিকেন রেসিপি করতে। আর হ্যাঁ রেড মিটের ডিস গুলি অবশ্যই যেন থাকে আপনার নাগালের বাইরে। খাবার হজমে সহায়ক সামগ্রী যেমনঃ দই, বোরহানি, ইনো ইত্যাদি ঘরে মজুত রাখুন। ফার্স্ট এইড হিসাবে রেনিটিডিন, অমিপ্রাজল, ওরস্যালাইন, টেট্রাসাইক্লিন ইত্যাদি হাতের কাছে রাখতে ভুলবেন না যেন। পবিত্র ঈদ –উল –আযহা আমাদের সকলের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ, কল্যাণ, শান্তি ও সমৃদ্ধি।

আমাদের মাঝে পরমত সহিষ্ণুতা জাগ্রত হোক, গড়ে উঠুক দল-মত নির্বিশেষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। ইহজাগতিক ব্যক্তিগত ও দলীয় ক্ষুদ্র স্বার্থের উর্ধে স্থান পাক দেশ ও দশের কল্যাণ। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে শুভ বুদ্ধি দান করুন- এই কামনা থাকল আসন্ন ঈদ –উল –আযহায়। রাজনৈতিক অস্থিরতায় যেন ডুবে না যায় ঈদ পরবর্তী বাংলাদেশ, এ আশাবাদ ব্যক্ত করে ব্লগের সকল ব্লগার, পাঠক, মডারেটর ও শুভানুধ্যায়ীদেরকে জানাই অগ্রিম ‘ ঈদ মোবারক’ ।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।