মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। অপেক্ষমাণ রাখার ১৮তম দিনে আসামির উপস্থিতিতে জনাকীর্ণ বিচারকক্ষে গতকাল এ মামলার রায় ঘোষণা করেন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। আদেশে বলা হয়, '১৯৭১ সালে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুট ও অগি্নসংযোগের দায়ে সর্বোচ্চ শাস্তিই আসামির প্রাপ্য। তবে বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় এ দণ্ড দেওয়া হলো। ' বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদানের দৃষ্টান্ত এটাই প্রথম।
অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনা ১৭টির মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে ৯টি অভিযোগ। প্রমাণিত না হওয়ায় বাকি ৮টি অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয় জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার এই সদস্যকে। দণ্ড শুনে কোনো মন্তব্য করেননি ৮২ বছর বয়সী আবদুল আলীম। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এটি অষ্টম এবং বিএনপির রাজনীতিসংশ্লিষ্ট কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে রায়। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে প্রসিকিউশন।
তবে আসামি পক্ষ আপিল করবে রায়ের বিরুদ্ধে। ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় রায় ঘোষণা উপলক্ষে। রায় ঘোষণা উপলক্ষে সকাল পৌনে ১০টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় আনা হয় আলীমকে। সাদা চেক লুঙ্গি ও সাদা ফতুয়া, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, হাতে সোনালি চেইনের ঘড়ি এবং পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল পরা আলীমকে সেখান থেকে কাঠগড়ায় নেওয়া হয় ১০টা ৩৫ মিনিটে। সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে এজলাসে আসন গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনালের তিন সদস্য।
চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের ডান পাশে ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ সদস্য বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া এবং কনিষ্ঠ সদস্য বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম আসন গ্রহণ করেন বাম পাশে। মূল রায়ের পাঠ শুরু হয় এর পরে। ৬৮৮ অনুচ্ছেদসংবলিত রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ থেকে প্রথমে পাঠ করেন বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। ১০টা ৫৪ মিনিটে রায় পড়া শুরু হয়ে শেষ হয় ১২টা ৪০ মিনিটে। বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম রায় পড়েন বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত।
এরপর রায় পড়া শুরু করে ১২টা ৮ মিনিটে তা শেষ করেন বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া। আর শেষ অংশের পাঠ শুরু করে চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দণ্ড ঘোষণার পর রায় দেওয়া শেষ করেন বেলা ১২টা ৪০ মিনিটে। ট্রাইব্যুনালের তিন সদস্য পর্যায়ক্রমে পাঠ করেন ইংরেজিতে লিখিত ১৯১ পৃষ্ঠা রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ। রায় ঘোষণার পর সঙ্গে সঙ্গে এজলাস ত্যাগ করেন ট্রাইব্যুনালের তিন সদস্য। ট্রাইব্যুনালের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা পক্ষ।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ৩০ দিনের মধ্যে করতে হবে এ আবেদন। আপিল নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে সর্বোচ্চ ৬০ দিনের মধ্যে।
বিচারকক্ষ : এজলাস সামনে রেখে ডান পাশে প্রসিকিউটররা আসন গ্রহণ করেন প্রসিকিউশনের জন্য নির্ধারিত স্থানে। বাম পাশে আসামি পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আহসানুল হক, অ্যাডভোকেট তারিকুল ইসলাম প্রমুখ। প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম, চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট এম কে রহমান, প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী, অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ প্রমুখ।
প্রসিকিউশনের ডান পাশে সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ও নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু প্রমুখ ছিলেন পর্যবেক্ষকের আসনে। ছিলেন আবদুল আলীমের ছেলে সাজ্জাদ বিন আলীম এবং খালিদ বিন আলীম। আর স্টিকে ভর করে কাঠগড়ার চেয়ারে ছিলেন আবদুল আলীম। এ ছাড়া গণমাধ্যমকর্মীদের ছিল উপচে পড়া ভিড়। রায় ঘোষণা উপলক্ষে ট্রাইব্যুনালসংলগ্ন এলাকায় গড়ে তোলা হয় কড়া নিরাপত্তা-বেষ্টনী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যের পাশাপাশি বাড়ানো হয় সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি। পরিচয় নিশ্চিত করে সংশ্লিষ্টদের কড়া নিরাপত্তায় প্রবেশ করানো হয় ট্রাইব্যুনালে।
প্রমাণিত ৯টি অভিযোগ : ট্রাইব্যুনালে ১৭টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আবদুল আলীমের বিচার শুরু হয় ২০১২ সালের ১১ জুন। অভিযোগের মধ্যে ছিল গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুট ও অগি্নসংযোগসহ বিভিন্ন অপরাধ। ট্রাইব্যুনালের রায়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম, দ্বাদশ ও চতুর্দশ অভিযোগ।
এর মধ্যে প্রমাণিত দ্বিতীয়, অষ্টম, দশম ও চতুর্দশ অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয় আলীমকে। আর ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম ও দ্বাদশ অভিযোগে ২০ বছর করে এবং প্রথম অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় আসামিকে। তবে প্রমাণিত না হওয়ায় আলীমকে খালাস দেওয়া হয় বাকি সব অভিযোগ থেকে। এর মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম অভিযোগের সমর্থনে সাক্ষী হাজির করতে পারেনি প্রসিকিউশন।
প্রথম অভিযোগ অনুসারে, ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল আলীমের নেতৃত্বে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানার দমদমা গ্রামের মেহেরউদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে হামলা চালায় রাজাকার বাহিনী।
ঘটনার পর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন মেহেরউদ্দিন। দ্বিতীয় অভিযোগ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল জয়পুরহাটের কড়ইকাদিপুর এলাকার চকপাড়া, সোনারপাড়া, পালপাড়া ও যুগীপাড়ার হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামের মোট ৩৭০ জনকে গুলি করে হত্যা করে আলীমের নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনীসহ পাকিস্তানি সেনারা। ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের মে মাসের প্রথম দিকে আটক করা হয় আক্কেলপুরের ১০ জনকে। তাদের 'শেষ করে দেওয়া'র নির্দেশ দেন আলীম। পরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেওয়া হলে হত্যা করা হয় নয়জনকে।
তাদের মধ্য থেকে পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হন মোফাজ্জল নামে এক ব্যক্তি। সপ্তম অভিযোগ বলছে, '৭১ সালের ২৬ মে অপহরণের পর আলীমের পরামর্শ ও প্ররোচনায় গুলি করে হত্যা করা হয় নওদা গ্রামের চারজনকে। অষ্টম অভিযোগ অনুযায়ী, একাত্তরের মে মাসের শেষের দিকে আলীমের নির্দেশে হত্যা করা হয় বাদল, সচীন ওরফে ভানু, প্রবাস চন্দ্র শীল, মণিভূষণ চক্রবর্তী, কার্তিক চন্দ্র বর্মণ, নিমাই চন্দ্র বর্মণ ও প্রিয়নাথ বর্মণসহ অপরিচিত আরও তিনজনকে। নবম অভিযোগ হচ্ছে, '৭১ সালের ১৪ জুন জয়পুরহাটের আক্কেলপুর হয়ে ভারতে যাওয়ার পথে শান্তি কমিটির লোকজনের হাতে ধরা পড়েন বগুড়ার খোকন পাইকারসহ ১৫ যুবক। এরপর তাদের হাত-পা বেঁধে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয় আলীমের নির্দেশে।
দশম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের জুন মাসের শেষের দিকে জয়পুরহাটের সদর রোডের শাওনলাল বাজলার গদিঘরে শান্তি কমিটির অফিসে বসে 'মুক্তিযোদ্ধা' সন্দেহে পাহাড়পুর থেকে ধরে আনা ২৬ যুবককে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন আলীম। পরে গুলি করে হত্যা করা হয় ওই ২৬ যুবককে। দ্বাদশ অভিযোগ থেকে জানা যায়, '৭১ সালের ২৪ জুলাই অপহরণের পর ব্যাপক নির্যাতন শেষে আলীমের নির্দেশে ডা. আবুল কাশেমকে গুলি করে হত্যা করা হয় ২৬ জুলাই। চতুর্দশ অভিযোগে বলা হয়, আক্কেলুপুর সদরের ফজলুল করিম ও অন্য দুজনকে আলীমের নির্দেশে মুখে চুনকালি মাখিয়ে জয়পুরহাট শহর প্রদক্ষিণ করানো হয় '৭১-এর ৭ অক্টোবর। পরে তাদের হত্যা করা হয় গুলি করে।
যেসব অভিযোগে খালাস : তৃতীয় অভিযোগ অনুযায়ী, আবদুল আলীমের পরামর্শ ও প্ররোচনা এবং চিরোলা গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য রিয়াজ মৃধার সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা ২৮ জনকে বেঁধে গুলি করে একাত্তরের আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহে। এতে নিহত হন ২২ জন। ছয়জন বেঁচে যান প্রাণে। চতুর্থ অভিযোগ থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একদিন পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে আলীম নামেন পাঁচবিবির বকুলতলা রেললাইনের কাছে। এরপর বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে কোকতারা, বাগজানা ও কুটাহারা গ্রামে হানা দিয়ে বাড়িঘরে লুটপাট চালানো হয় এবং ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন।
সেখানে গুলি করে হত্যা করা হয় ১৯ জনকে। পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের বৈশাখ মাসের শেষ দিকে জয়পুরহাটের দক্ষিণ পাহুনন্দা মিশন স্কুলে আলীমের নির্দেশ ও প্ররোচনায় হত্যা করা হয় ৬৭ জন হিন্দুকে। একাদশ অভিযোগ অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধের সময় জুন মাসের শেষের দিকে কয়েকজন গাড়োয়াল এবং তাদের আত্দীয়স্বজনসহ আটক করা হয় ২৬ জনকে। এরপর গুলি করে হত্যা করে তাদের লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয় আলীমের নির্দেশে। ত্রয়োদশ অভিযোগ থেকে বলা হয়, একাত্তরের সেপ্টেম্বরে আলীমের নির্দেশ ও পরামর্শে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে হত্যা করে ১১ যুবককে।
পঞ্চদশ অভিযোগ হচ্ছে, '৭১-এর ২৫ অক্টোবর ২৫ জনকে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নেওয়া হয় আলীমের নির্দেশে। পরে তাদের হত্যা করা হয়। ষোড়শ অভিযোগ বলছে, একাত্তরে আক্কেলপুরের বিভিন্ন স্থানে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের মানবতাবিরোধী অপরাধে উৎসাহিত করেন আলীম। সপ্তদশ অভিযোগ হচ্ছে, রাজাকাররা আলীমের নির্দেশে হত্যা করে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের ১৭ উইংয়ের ইপিআর সুবেদার মেজর জব্বল হোসেনকে।
পেছন ফিরে দেখা : আবদুল আলীম গ্রেফতার হন ২০১১ সালের ২৭ মার্চ।
১ লাখ টাকা মুচলেকা এবং ছেলের জিম্মায় ৩১ মার্চ জামিন নেন তিনি। পরে বেশ কয়েক দফা বাড়ানো হয় এ জামিনের মেয়াদ। ২০১২ সালের ১১ জুন তার বিচার শুরু হয় ১৭ অভিযোগে। এর আগে ২০১২ সালের ১৫ মার্চ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে প্রসিকিউশন। অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১।
মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয় ১৬ এপ্রিল। ৪ থেকে ১১ সেপ্টেম্বর এবং ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ ও রানা দাশগুপ্ত। অন্যদিকে, ১৫ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর এবং ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় কার্যদিবস আসামি পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আইনজীবী আহসানুল হক, তাজুল ইসলাম ও আবু ইউসুফ মো. খলিলুর রহমান। ২২ সেপ্টেম্বর জামিন বাতিল করে আলীমকে পাঠানো হয় কারাগারে। ২৭ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আলীমের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনজন।
অন্যদিকে, গত বছরের ৬ আগস্ট থেকে এ বছরের ২২ আগস্ট পর্যন্ত প্রসিকিউশনের পক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ সাক্ষ্য দিয়েছেন ৩৫ জন। তবে ১৯তম সাক্ষী প্রসিকিউশন বৈরী ঘোষণা করে জেরা করেছে আবেদ হোসেনকে। এ ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া দুজনের জবানবন্দিকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয় গত ২২ সেপ্টেম্বর।
কে এই আলীম : আবদুল আলীমের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ নভেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলির পাঁদুয়া গ্রামে।
১৯৫০-৫১ সালে জয়পুরহাট শহরের থানা রোডে বসবাস শুরু করে আলীমের পরিবার। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র হিসেবে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মুসলিম লীগে যোগ দেন '৫৮ সালে। '৭১-এ কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। সে সময় বগুড়া জেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে জয়পুরহাটে শান্তি কমিটি গঠন করে নিজে তার চেয়ারম্যান হন। রাজাকার বাহিনী গঠন করে নেতৃত্ব দেন। '৭২ সালে দালাল আইনে জয়পুরহাট থানায় আবদুল আলীমসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় ২৩টি। পলাতক থাকার পর '৭২ সালের শেষ দিকে জয়পুরহাটে আত্দসমর্পণ করলে আলীমকে জেলহাজতে প্রেরণ করেন আদালত। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ছাড়া পান জেল থেকে।
পরে জয়পুরহাট পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। '৭৯ সালে যোগ দেন বিএনপিতে। জিয়াউর রহমান সরকারের প্রথমে বস্ত্র ও পরে হন যোগাযোগ মন্ত্রী। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে। জয়পুরহাট আইনজীবী সমিতিরও সভাপতি ছিলেন।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ভূমিকার জন্য 'সংস্কারপন্থি' হিসেবে চিহ্নিত হন বিএনপিতে। এ কারণে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি মনোনয়নবঞ্চিত হন বলে দলের অনেকে মনে করেন।
আপিল করবে আলিমের পরিবার : মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আবদুল আলীমকে দেওয়া আমৃত্যু কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছে তার পরিবার। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া রায় ঘোষণার পর আবদুল আলীমের ছেলে সাজ্জাদ বিন আলীম সাংবাদিকদের জানান, এটি একটি ন্যায়ভ্রষ্ট রায়, এ রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। জয়পুরহাটের কোথাও আমার বাবার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তিনি একজন নির্দোষ ব্যক্তি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।
আবদুল আলিমের আরেক ছেলে খালিদ বিন আলীম বলেন, জয়পুরহাটে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন আব্বাস আলী খান এবং আলফাজ উদ্দিন সিকদার ছিলেন রাজাকার কমান্ডার। যা প্রসিকিউশনের উপস্থাপিত নথিপত্রে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং আমার বাবাকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তা অযৌক্তিক।
আমার বাবা একজন নির্দোষ ব্যক্তি। পরিবারের পক্ষ থেকে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।
রায়ে সন্তুষ্ট না অসন্তুষ্ট কোনো মন্তব্য করছি না : আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর দেওয়া আমৃত্যু কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, প্রসিকিউশনের পরবর্তী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে এ রায় আমাদের মেনে নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রসিকিউটররা। এদিকে পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ প্রতিক্রিয়া জানাবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
গতকাল আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর প্রসিকিউশন ও অ্যাটর্নি জেনারেল এ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট না অসন্তুষ্ট, সে বিষয়ে মন্তব্য করছি না। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আলীম যে যুক্ত ছিলেন, এটা এ রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত থাকার কারণে ট্রাইব্যুনাল তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষ পরবর্তীতে রায় নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করে প্রতিক্রিয়া জানাবে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী আলীমের যুদ্ধাপরাধের রায় না হলেও এটা আমাদের মানতে হবে। তবে দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী হলে ভালো লাগত। আমরা অবনত মস্তকে মেনে নিচ্ছি। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা করে কোনো গ্রাউন্ড পাওয়া গেলে আপিল করা হবে বলে তিনি জানান। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, আবদুল আলীম যে যুদ্ধাপরাধী তা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে।
আদালত তার শারীরিক অক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন। আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে বিচারহীনতার রেওয়াজ বিলুপ্ত হবে।
গণজাগরণ মঞ্চের বিক্ষোভ : যুদ্ধাপরাধী আবদুল আলীমের সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বিক্ষোভ করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। তারা আবদুল আলীমের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার দাবি জানিয়েছে। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে বিএনপি নেতা আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশের পর শাহবাগে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে গণজাগরণ মঞ্চ।
রায় প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভ মিছিল শাহবাগ মোড় থেকে শুরু হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে আবার শাহবাগে এসে শেষ হয়।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় হতাশা ব্যক্ত করে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, এ রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমরা এ রায়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ। আমরা বিশ্বাস করি আপিলের মাধ্যমে প্রত্যাশিত রায় পাব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।