দরজায় কড়া নাড়ার পর কিছুটা সময় যায়, ঘড়ির কাঁটায় হয়তো এক-দুই মিনিট, কিন্তু রাশেদের কাছে একটা গোটা প্রহর। মিথিলা দরজা খোলে, মিষ্টি করে হাসে, একটু সরে দাঁড়ায়। রাশেদের হাত থেকে বই থাকলে বই, বাজার থাকলে বাজার নিজের হাতে নেয়, তারপর রাশেদ ঢুকলে, এবং দরজা বন্ধ হলে সেগুলো দরজার পাশের টেবিলটাতে নামিয়ে রাখে। তারপর গলায় কিছুটা অভিমান ঢেলে বলে, ‘এত দেরি হলো?’
দেরি? রাশেদ অবাক হয়, আবার হয়ও না। ঘড়ির কাঁটায় হয়তো ঘণ্টা দুয়েক; অথবা, অফিসের সময়টা হিসাবে নিলে একটা আধা দিন, কিন্তু মিথিলার কাছে একটা পুরো মাস।
অথবা, কে জানে, গোটা একটা বছর।
দুজনের সময়ের হিসাবটা অবশ্য এরপর একটা বিন্দুতে এসে মিলে যায়। ‘খুব দেরি হয়ে গেল?’ রাশেদ বলে, এবং দুই হাতে মিথিলাকে জড়িয়ে ধরে। খুব যে শক্ত করে, তা নয়, ইচ্ছে করলেই মিথিলা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারে। কিন্তু নেওয়ার ইচ্ছার কথাটা তার মনে আসে না।
মিথিলা বরং নিজেকে রাশেদের দুই হাতে সঁপে দেয়, তারপর একটা তরল আনন্দ তাকে দোলা দিতে থাকে। একসময়—এবং এই সময়ের হিসাবটা কারও মাথাতে আসে না—রাশেদের ঠোঁট নেমে আসে মিথিলার ঠোঁটে।
দিনে একবার অথবা দু বার। নাহ্, রাশেদ সেই হিসাবেও যায় না। তার বরং মনে পড়ে, এক অবাক সন্ধ্যার আলো-অন্ধকারের নকশা-কাটা আকাশটাকে, যার নিচে বসে একটা ঝোপের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে প্রথম মিথিলার ঠোঁটে সে ঠোঁট রেখেছিল।
মিথিলার শরীর কাঁপছিল। তার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এসেছিল। রাশেদের মনে হয়েছিল, যেন আকাশের দরজা খুলে ভেতরের জমানো সুখ ঝরে পড়ছিল। একটা মুহূর্ত এতটা সুগন্ধ ধরে রাখতে পারে, সে ভাবতে পারেনি।
রাশেদ মাত্র চাকরিতে ঢুকেছে তখন, মিথিলা পড়ছে ইডেনে।
সারা দিন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যেত। অফিসের ফাইলে মিথিলার ছবি, দেয়ালে মিথিলার ছবি, বড় সাহেবের মাথার ওপর টাঙানো প্রধানমন্ত্রীর ছবির ওপরও লেপ্টে বসত মিথিলার ছবি।
রাশেদ জিজ্ঞেস করত মিথিলাকে, ‘একটা আস্ত দিন আমাকে ছাড়া পার করে দাও কীভাবে, মিথি?’
‘পার করতে পারি কই?’ ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে মিথিলা বলত।
এর কয়েক দিনের মধ্যে রাশেদের উড়ুক্কু ভাব আর উদাসীনতায় বিরক্ত তার বস তাকে টাঙ্গাইল পাঠিয়ে দেয়।
অনেক চেষ্টা করেও টাঙ্গাইলে যাওয়া আটকাতে পারেনি রাশেদ।
আকুরটাকুরপাড়ায় দুই কামরার এই ঘরটা ভাড়া নিতে হয়েছিল। বাড়িওলার হাত-পা ধরাটা বাকি ছিল। বলেছিল, এক মাসের মধ্যে বউকে নিয়ে আসবে।
সেই এক মাস গিয়ে তিন মাসে ঠেকেছিল।
মিথিলার পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো, তার মামার সামনে দাঁড়িয়ে, অনেক ঘাম আর ভয় আর তোতলামি মেশানো একটা বিকেলে সে বলেছিল, মিথিলাকে সে তার জীবনে চায়।
মিথিলার বাবা থাকেন মানামাতে। মা-ও। মানামা কোথায় রাশেদ মোটামুটি জানে। কিন্তু মামা যখন বলেছেন, পরীক্ষার পর মিথিলার মানামায় যাওয়ার কথা, বিয়ের প্রশ্নই তাই ওঠে না, রাশেদের মনে হয়েছে, মানামা বোধ হয় চাঁদ অথবা নেপচুনের দূরত্বের কোনো শহর, যেখানে গেলে মিথিলা আর ফিরে আসবে না।
ফলে যা করার তা-ই তাদের করতে হয়েছে।
দরজার দিকে যেতে যেতে মিথিলা নিজের সঙ্গে একটা খেলা খেলত। রাশেদকে আজ বিরাট এক অপরাধী বানাতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, তিন মাসের এই সংসারে প্রথম দিনটার মতো এখন সে আর তাকে সময় দিচ্ছে না। মিথিলাকে সে ভুলে যাচ্ছে। অফিসটাকে সে মিথিলার ওপরে জায়গা দিতে শুরু করেছে।
টাঙ্গাইলের ভূগোল রাঙিয়ে রাখে যে মিথিলা, তার চোখের আলোটা যেন তার কাছে কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে...ইত্যাদি।
প্রতিদিন সে নতুন একটা অভিযোগ খাড়া করত। মিথিলা জানত, অভিযোগটা যত গুরুতর হবে, রাশেদের কাছে তা পৌঁছাবে অনেক অভিমানের মোড়কে জড়িয়ে। এবং মোড়ক খুলতে খুলতে অভিযোগটা কী, তা বোঝার আগেই রাশেদ তাকে পৌঁছে দেবে একটা বিন্দুতে। অপার্থিব একটা বিন্দুতে।
সারা ঘরজুড়ে সেই অবাক সন্ধ্যার জাফরি-কাটা আকাশটা তখন বিছিয়ে থাকবে। মিথিলার মনে পড়ে, সেই সন্ধ্যায় রাশেদের গাল থেকে একটা অদ্ভুত সুগন্ধ এসে লাগছিল তার নাকে। নাকি তার নিঃশ্বাস থেকে? জিহ্বা থেকে? এমনি ঘোর লাগানো সেই সুগন্ধ, মিথিলা সুযোগ পেলেই তাতে ডুবে গেছে।
দরজা খুললে কোন রাশেদকে সে দেখবে, তারও একটা আন্দাজ সে করত, বিশেষ করে তার মামা যেদিন এসে জানিয়ে গেলেন, মিথিলার বাবা বিয়েটা মেনে নেননি, তার পর থেকে। বাবা মেনে নেননি, তাতে কী, মিথিলা নিজেকে বুঝিয়েছে।
কিন্তু রাশেদের চোখে একটা কষ্টের ছায়া যে জমেছে, কিছুটা দুর্ভাবনারও, সেটি টের পেয়ে তার অভিযোগের তালিকাটা সে লম্বা করেছে, আর হেসেছে। যতই চোখে ছায়া জমুক রাশেদের, দরজা খুললে বেশিক্ষণ সেগুলো ধরে রাখতে পারত না সে। একটা বিন্দুতে এসে যখন দুজনের সময়ের হিসাবটা মিলে যেত, তখন রাশেদের উদ্বিগ্নতা, তার ভয় অথবা কষ্ট তরল হয়ে মিলিয়ে যেত।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নিজেকে উদ্বিগ্নই লাগছিল রাশেদের। তার মনে পড়ল, মামাবাড়ি থেকে বেরিয়ে মিথিলা চোখে জাদু ঢেলে তাকে বলেছিল, ‘চলো, কোর্টে চলো।
’
জাদুই বটে। তাদের প্রথম দেখাটা ছিল একটা জাদু, দ্বিতীয় দেখাটাও; এবং অবাক—এরপর প্রতিটি দেখাই। রাশেদ অবাক হয়েছে, বাবার সিদ্ধান্তের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে, মামাকে একটা কথাও না বলে, মিথিলা যখন একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখনো জাদুটা তার চোখ থেকে যায়নি।
কোর্ট থেকে বেরিয়ে রাশেদের হাতে একটা হাত রেখে সে আস্তে করে বলেছে, ‘এখন টাঙ্গাইলে চলো। আমাদের সংসার অপেক্ষা করে আছে।
’
মিথিলার মামা যেদিন টাঙ্গাইলে আসেন, সংসারটায় সেদিন প্রথম কাঁপন ধরল। তিনি মিথিলাকে বলেছেন, কাজটা মোটেও ভালো হয়নি। এখন সে যদি বাবাকে ফোন করে মাফ-টাফ চেয়ে নেয়, তাহলে হয়তো বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা থাকবে।
মিথিলা জানত, তার বাবা একটা পাত্র ঠিক করে রেখেছেন তার জন্য। পাত্র সেই মানামাতেই থাকে—ইঞ্জিনিয়ার।
তিনি কথাও দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাবার অবাধ্য হওয়া আর তার সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানাটা একই জিনিস, এটি সে বিশ্বাস করতে পারেনি।
সে শুধু আস্তে করে বলেছে, ‘ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় মামা, প্রশ্নই তো ওঠে না। ’
মামা জানিয়ে দিলেন, কোর্টের বিয়ের কোনো মূল্য নেই। এখন ঢাকায় ফিরে গেলে মানামা যাওয়ার ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন।
ইঞ্জিনিয়ার পাত্র তার পাগলামির কথা কিছুই জানে না। ফলে সমস্যা হবে না।
মিথিলা হেসেছে। আবার বলেছে, ‘সম্ভব নয়। ’ মামা এরপর উঠেছেন।
দরজার দিকে যেতে যেতে মিথিলা একটা খেলার কথা ভাবত। কেমন হয়, যদি রাশেদের মনে একটু ঈর্ষা জাগানো যায়? তাকে বলা যায়, ভাবছি, ঢাকায় যাব, তারপর মানামাতে। একটা হ্যান্ডসাম পাত্র বসে আছে আমার জন্য।
একদিন দরজা খুলতে গিয়ে এটি ভাবতে ভাবতে সে জোরে হেসে উঠেছে। রাশেদ অবাক চোখে তাকালে লজ্জা পেয়েছে।
তাতে ঈর্ষা জাগানোর খেলার কথাটা তার মন থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু মিথিলার হাসিটা একদিন বন্ধ করে দিতে স্বয়ং তার বাবা এসেছেন। ইঞ্জিনিয়ার মানুষ। হিসাব বোঝেন। সাধ্য বোঝেন।
তিনি বাড়িতে ঢুকেই নাক সিটকে বলেছেন, ‘এই বস্তির ঘরে তুই উঠেছিস?’
মিথিলার রেগে যাওয়ার কথা ছিল। বাবাকে দুটো কথা শুনিয়ে দেওয়ারও কথা ছিল। কিন্তু বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে সে রাগ ভুলে গেল। কেঁদেই ফেলল বরং। অনেক দিন পর সে বাবাকে দেখল।
বাবার বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে। চুল শুধু মাথার ছাদটাকে ঢেকে রেখেছে। গোঁফ সাদা হয়েছে। কপালে অনেকগুলো ভাঁজ জমেছে।
‘তোমার শরীর কি ভালো নেই, বাবা?’
‘কী করে থাকে বল, মা?’ বাবা বললেন, সেই ছোটবেলা যেমন বলতেন, তার সঙ্গে রাজা আর রাজকন্যার খেলাটা যখন তিনি খেলতেন।
মিথিলার চোখে বাষ্প জমে যেন একটা মেঘলা দিন নিয়ে এল। চোখের মেঘ সরিয়ে সে বাবাকে দেখল, বাবা দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছেন। ‘আয় মা,’ তিনি বলছেন, ‘এই বস্তির ঘর ছেড়ে আয়। ’
মিথিলার মনে পড়ল, ভাইয়াটার বয়স যখন নয়, এবং তার সাত, এবং নানাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পুকুরে সাঁতার কাটতে নেমে ভাইয়াটা আর উঠে এল না, এমনি করে হাত বাড়িয়ে বাবা বলেছিলেন, ‘আয় মা, এই নরকে আর এক মুহূর্তও না। ’
এরপর বাবা আর নানাবাড়ি যাননি।
মিথিলাও না।
অনেকক্ষণ পর, ঢাকা থেকে ভাড়া করা মাইক্রোবাসে উঠে বসতে গিয়ে বাবা বললেন, ‘হামীমটাকে হারালাম। তোকে হারাতে পারি না। ’
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ খুব অস্বস্তি হয় রাশেদের। এমন কী হলো যে একটা অনন্তকাল পার করে দিয়ে দরজাটা খুলতে হবে? হঠাৎ কেন দুজনের হিসাব একটা বিন্দুতে এসে মিশে যাচ্ছে না? এই বাড়িটাতে যে নকশা-কাটা আকাশ নামত প্রতি সন্ধ্যায়, সেটি হঠাৎ অনেক উঁচুতে উঠে কি হারিয়ে গেছে? মিথিলা কি আজ বলবে, যেমন সে একদিন কোনো কিছু না ভেবেই বলেছিল, ‘একটা বড় বাসা দেখলে হয় না?’
‘বড় বাসা? কার জন্য?’ রাশেদ জিজ্ঞেস করেছিল, যেন সে অবাক হওয়ার সুযোগটাও পায়নি।
‘কেন, আমাদের জন্য?’
‘আমাদের জন্য?’
মিথিলা আর কথা বাড়ায়নি।
তার মনে পড়ে, মিথিলার বাবা মানামা ফিরে গেলে তার হাসিটাও যেন বিদায় নিয়েছিল। একদিন অনেকটা সময় নিয়ে সে হামীমের শেষ দিনটি নিয়ে কথা বলল। তাকে নিয়ে কোনো দিন দু-এক কথার বেশি কিছু বলেনি মিথিলা। অথচ আকুরটাকুরপাড়ার জাদুর ভূগোলে একটা কালো ছায়া বিছিয়ে মিথিলা তাকে বলতে থাকল, পুকুরে নামার আগে হামীম কী করেছিল, কী বলেছিল।
ইত্যাদি।
আরেক দিন মিথিলা জানাল, তার পর থেকে বাবা তাকে কীভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন। ‘বাবা আমার দিকে দুটি হাত বাড়িয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার চোয়াল শক্ত, চোখে আগুন,’ ইত্যাদি।
তারপর গল্পটা সেখানে ফেলে রেখে সে উঠে বিছানায় গেছে।
দরজার দিকে যেতে যেতে একদিন মিথিলার মনে হয়েছিল, আজ তার অভিযোগের তালিকায় তিনটি নতুন বিষয় সে ঢুকিয়ে দেবে। আঙুলে এক-দুই-তিন হিসাব করতে গিয়ে দেখল, তার আঙুল শক্ত হয়ে আছে, হাত শক্ত হয়ে গেছে, চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। সে অবাক হলো, অথবা হলো না, কারণ তার অভিযোগগুলো স্পষ্ট। রাশেদ কেন তার একটা কথাও রাখছে না, এই বাড়িটা ছেড়ে একটা ভদ্র, বড় বাড়ি কেন নিচ্ছে না? কেন সে ঢাকায় একটা বড় চাকরি খুঁজছে না; এবং কিছুদিনের জন্য সে যে মানামায় বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে আসতে চাইছে, সে জন্য কিছু টাকার জোগাড় কেন রাশেদ করছে না?
অভিযোগগুলোর ভেতর দিয়ে আরেকবার যেতে গিয়ে সে দেখল, রাশেদ যদি এসব শুনে চুপ করে না থাকত, যদি তার চোখে গম্ভীর কিছু কষ্টের ছায়া জমে তাকে হতবাক করে না দিত; এবং সে একটুখানি হেসে শুধু বলত, আমি চেষ্টা করছি, মিথি, খুবই চেষ্টা করছি, তাহলে এই অভিযোগের খেলাটা একটা বিন্দুতে গিয়ে মিশে যেত, তরল হয়ে যেত।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রাশেদের মনে হলো, একটা দুই কামরার ভাড়াবাড়িতে তার এক জীবনের সব বিনিয়োগ ঢেলে দেওয়ার কোনো মানে হয়নি।
সে নিজেকে প্রশ্ন করল, একবারও কেন সে মিথিলাকে বলেনি, চলো, একটা বাড়ি তুমি আমি মিলেই বরং দেখি? কেন সে চুপ থেকে বরং এ রকমটি বুঝিয়েছে মিথিলাকে, এই বাড়িটা তার অনন্ত বাসরঘর, তার সারা জীবনের ঠিকানা, যেখানে একটা পা রাখলেই সে অবাক করা সন্ধ্যার নকশা-কাটা আলো-অন্ধকারে ঢুকে যাবে, আর তার চোখে জমবে একটার পর একটা স্বপ্ন?
দরজাটা শেষ পর্যন্ত খুলল। একটা মুহূর্ত, রাশেদ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আমার নাম রাশেদ আহমেদ,’ ইত্যাদি। ‘দুই বছর আগে এই বাড়িটাতে আমি ছিলাম, বাড়িটা আমার জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে,’ ইত্যাদি।
যার সঙ্গে রাশেদ কথা বলছিল, মিথিলার থেকে তার বয়স বছর পাঁচেকের বেশি হবে না। শুক্রবার সকালের কাজ তার সারা হাতে, চেহারায়, শাড়িতে।
খুব বিরক্ত হওয়ার কথা, কিন্তু মুখে একটা হাসি মাখিয়ে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, ভেতরে আসুন। ’
তারপর তিনি বললেন, তাঁর নাম লায়লা।
ভেতরে একটা পা রাখতেই রাশেদের মনে হলো, মাত্র একবারের মতো, একটুক্ষণের জন্য কেউ তাকে সুযোগ করে দিয়েছে, তার সেই অবাক-সন্ধ্যার জীবনটা একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য। মাত্র একবার, তারপরই তার হাতটা গুটিয়ে নিতে হবে। এক ফালি একটা বারান্দা, একদিকে বসার ঘর, অন্যদিকে রান্নাঘর।
বসার ঘরটা পার হয়ে শোবার ঘর—ব্যস। রান্নাঘরের পাশে আধখানা একটা ঘর অবশ্য আছে, যাতে রাশেদ তার পড়ার টেবিলটা রেখেছিল। বইয়ের একটা শেলফও ছিল। চোখ বুজে সে বাড়িটাকে অনুভব করল। চোখ বুজে, যেহেতু চোখ খুললেই তাকে আঘাত পেতে হবে, যেহেতু খোলসটা ছাড়া সব পাল্টে গেছে বাড়িটার।
সবই অচেনা। একবার তার ইচ্ছা হলো, দৌড়ে শোবার ঘরটা দেখে আসবে। কিন্তু ভাবল, দরজা-দেয়াল ছাড়া সবই তো অচেনা দেখতে হবে; তার ভয় হলো, মধুমাখা দুপুর-বিকেল-রাতগুলো তাহলে হারিয়ে যাবে, এমনকি স্মৃতি থেকেও। সে চুপ করে বসার ঘরের একটা বেতের সোফায় বসে থাকল। এবং নিজের অজান্তে লায়লাকে বলেই ফেলল, যে কথাগুলো এখনো কাউকে বলতে পারেনি সে।
লায়লা তাকে বললেন, ‘একটু চা দিই?’
‘জি না,’ অস্থির হয়ে বলল রাশেদ। ‘আমি এখন যাব। ’
‘যাবেন?’ তিনি বললেন, তারপর নিজেই যেন উত্তর দিলেন, ‘যাওয়াই ভালো, শুধু কষ্ট বাড়বে। ’
রাশেদ ভেজা চোখে তাকাল।
‘এই আকুরটাকুরপাড়ায় আমরাও প্রথম সংসার পেতেছিলাম,’ একটুখানি দীর্ঘশ্বাস যেন তিনি ফেললেন।
‘পাঁচটা বছর কেটেছে সেই বাড়িটাতে। পাঁচটা বছর। যেন স্বপ্ন দিয়ে বোনা। সেই স্বপ্নের মাঝখান থেকে অমিত এল...। ’
লায়লার আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা বছর চারেকের ছেলেটির নাম তাহলে অমিত।
‘অমিত আসার পর আস্তে আস্তে সব যেন বদলে গেল। মনে হলো, ওর বাবা যেন একটু একটু করে অন্য একটা মানুষ হয়ে গেলেন। চিরদিনের চেনা, কিন্তু কেমন করে যেন অচেনাও। বাসাটার পাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করেছি, একবার ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু এক রাতে হঠাৎ আমাকে হাত ধরে টেনে সে বলল, চলো বাড়িটা একবার দেখে আসি।
সেদিন মনে হলো, সবকিছুই আসলে ভেতরের ব্যাপার। কী বলেন?’
রাশেদ একটু অপ্রস্তুত হলো। ‘উনি কোথায়?’ সে জিজ্ঞেস করল।
‘চুল কাটতে গেছে। এক্ষুনি ফিরবে,’ তিনি বললেন, তারপর গলায় আর্দ্রতা মাখিয়ে বললেন, ‘চলেই গেলেন শেষ পর্যন্ত?’
রাশেদ মাথা নাড়ল।
‘মানামা না কোথায় যেন বললেন, একেবারে সেইখানে?’
‘হ্যাঁ’ রাশেদ বলল, তারপর দরজার দিকে পা বাড়াল। পা বাড়াতে বাড়াতে সে শুনল, দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। কড়া নাড়ার শব্দে লায়লার চোখে নিত্যদিন আবার ফিরে এল। ‘ও এসেছে,’ আস্তে করে তিনি বললেন।
দরজার ভেতরে পা রেখেই চমকে গেলেন গৃহকর্তা।
চোখে প্রথমে ভয় জমেছিল, পরে কৌতূহল, তারপর বিরক্তি। ‘কী চাই?’ তিনি জানতে চাইলেন।
‘বাড়িটা দেখতে এসেছিলেন,’ লায়লা বললেন।
‘বাড়ি তো আমি ছাড়ছি না যে ভাড়া হবে,’ তার চোখের দৃষ্টিতে এবার সন্দেহ।
‘এই বাড়িতে থাকতেন একসময়, সে জন্য দেখতে এসেছেন।
’
‘আচ্ছা? তাহলে আমাকে এখন জাদুঘরের লোকজনের মতো ঘুরে ঘুরে বাড়ি দেখাতে হবে?’
‘আহ্, এ রকম করে বলতে হয় না,’ লায়লার ক্ষতি-মেরামতির চেষ্টা।
‘তা ছাড়া আর কী,’ ভদ্রলোকের মেরামতির কোনো চেষ্টা নেই। ‘গত শনিবার বাড়ি দেখার আবদার নিয়ে হাজির এক মহিলা। আজ ইনি। ’
‘আচ্ছা?’ অবাক হয়ে লায়লা জিজ্ঞেস করলেন।
‘তুমি অমিতকে নিয়ে ছোট আপুর বাসায় গিয়েছিলে। তুমি ছিলে না বলে আমি ঢুকতে দিইনি। ’ ভদ্রলোক বললেন। তারপর যেন কিছুটা দয়া দেখা দিল তার ভেতর। তিনি রাশেদকে বললেন, ‘দেখতে চাইলে আসুন।
’
রাশেদের ভেতরে একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। ‘যে মহিলা এসেছিলেন, দয়া করে তিনি কী রকম দেখতে একটু বলবেন?’
ভদ্রলোক এবার বিরক্ত হলেন। ‘একজন মহিলার চেহারা কী করে মনে করে বসে থাকি, বলেন? তবে তিনি ঢাকা থেকে এসেছিলেন। একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে। ’
কেন জানি রাশেদের চোখ পড়ল লায়লার চোখে।
সেখানে কি একটুখানি হাসি দেখল রাশেদ, নাকি আকুরটাকুরপাড়ার ভূগোলটা আবার মায়াময় হয়ে ছায়া ফেলল তার চোখে?
দুটি সিঁড়ি টপকে রাস্তায় নামতে নামত।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।