কমেন্টার
খেলাধুলায় ম্যারাথন দৌড়ই বোধহয় দৌড় প্রতিযোগিতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাকর। এইরকম দীর্ঘ এক প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়া সত্যি কঠিন ব্যপার। দাপ্তরিকভাবে এ দৌড়ের দূরত্ব হচ্ছে ৪২.১৯৫ কিলোমিটার বা ২৬ মাইল ৩৮৫ গজ। বৃহৎ পরিসরের ম্যারাথনে দশ হাজারেরও বেশী প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করতে পারেন। বহু বছর আগে ম্যারাথন দৌড়ের মতোই এক রেকর্ড গড়েছিলেন ফ্রান্সের এক ব্যারিস্টার যার নাম লুইস বেনার্ড (১৭৮৮-১৮৮৫) ।
রেকর্ডটি ছিল অবিরাম কথা বলার রেকর্ড। এই রেকর্ডটি তিনি গড়েছিলেন তার এক মক্কেলকে শাস্তির হাত থেকে বাচানোর জন্য। একটানা ১২০ ঘন্টা কথা বলার এক অবিশ্বাস্য রেকর্ড তিনি করেছিলেন সেদিন। !!!
মি.লুইস বেনার্ডের মক্কেলের নাম ছিল জেনারেল জিন ট্রভট। তিনি ছিলেন তৎকালীন ফ্রান্সের একজন জেনারেল।
তিনি প্রকৃতপক্ষেই একজন সৎ ব্যক্তি ছিলেন । কিন্তু তা সত্ত্বেও তার কয়েকজন শত্রুর ষড়যন্ত্রে তিনি এক মামলায় ফেসে যান। তার বিরুদ্ধে কিছু গুরুতর অভিযোগ আনা হয় ।
১৮১৬ সালে এই মামলা দেয়া হয়। বিরোধীদলের মারাত্মক চক্রান্তে আইনের ফাক ফোকর দিয়ে সত্যি সত্যি দোষী সাব্যস্ত জেনারেল।
বিচারক তার মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন।
আপ্রাণ চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না লুইস বেনার্ডের মতো দক্ষ উকিলও। এদিকে রায় ঘোষণার পরে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই রায় কার্যকর হওয়ার কথা। রায় ঘোষণার পরে সাথে সাথেই তিনি এই রায় শীঘ্রই কার্যকর না হওয়ার আবেদন করেন বিচারকের কাছে। তিনি আবেদনে লিখেন-তার মক্কেল জেনারেল জিন ট্রভট সম্পূর্ণ নির্দোষ,দেশের একজন মহান বীরযোদ্ধা।
তিনি স্বয়ং ফ্রান্স সম্রাটের একজন স্নেহভাজন সৈনিক। তিনি সম্রাটের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করছেন। । তাই সম্রাটের কাছ থেকে প্রাণভিক্ষার খবর না আসা পর্যন্ত যেন তার রায় কার্যকর না করা হয়। কিন্তু সামরিক আদালত এই আবেদন মঞ্জুর করতে পারলেন না।
কারণ সমারাত থাকেন সুদূর ভার্সাই শহরে, যা বিচারালয় থেকে ৫ দিনের পথ। (তখন কোন গাড়ি ছিল না, যানবাহনের মধ্যে প্রধান ছিল ঘোড়া,ঘোড়ার গাড়ি) ।
কিন্তু আদালত তো এতোক্ষণ অপেক্ষা করতে রাজি নয়!!! একজন মৃত্যুদন্ড আজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামিকে অতিরিক্ত আয়ুদান করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
এদিকে রায় প্রকাশ করার সাথে সাথে উকিল সাহেব জেনারেলের স্ত্রীকে একটি দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন সম্রাটের কাছে।
মিসেস জিন সম্রাটের কাছে গিয়ে তার স্বামীর প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন।
যদি তিনি তা চেয়ে আনতে পারেন তবেই সম্ভব হবে জেনারেলের প্রাণ বাচানো!
মিসস জিন তখন পাগলের মতো ছুটছেন ভার্সাই এর উদ্দেশ্যে...কিন্তু ঘোড়া যতো দ্রুতই ছুটুক না কেন...গিয়ে ফিরে আসতে তো ৫ দিন লাগবেই...এখন উপায়!!!
হঠাত উকিল সাহেবের মাথায় এক বুদ্ধি আসলো...তিনি আবারো একটি আবেদন করলেন বিচারকের কাছে... এইবার আবেদনে তিনি বলেন- তার মক্কেলের স্ত্রী ফিরে না আসা পর্যন্ত যদি তাকে সময় নাই দেয়া হয়, তবে মহামান্য আদালয় যেন তার আবেদনের স্বপক্ষে অন্তত তার নিজের কিছু বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দান করেন,। কারণ মক্কলের পক্ষ হয়ে তার কিছু বলার আছে যা তিনি পেশ করতে চান।
অতঃপর আদালত তার এই আবেদন মঞ্জুর করে।
অনুমতি পেয়ে চতুর উকিল বিচারকের আরো একটি শর্ত দেন যে -"আমার বক্তব্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন এই রায় কার্যকর করা না হয়। অর্থাৎ তিনি যতোক্ষন তার বক্তব্য দিবেন,ততোক্ষন এই রায় কার্যকর করা যাবে না।
---বেশ তাই হবে। আদালত উকিলের এই যুক্তি সানন্দচিত্তে মেনে নেয় ।
এবার শুরু হলো লুইস বেনার্ডের ঐতিহাসিক ম্যারাথন বক্তব্য...
দিন গেল...রাত গেল...কিন্তু সেই যে তিনি তার বক্তব্য শুরু করেছেন আর তো শেষ হয় না!!...বয়োবৃদ্ধ পক্বকেশ বেনার্ড সাহেবের মুখ থেকে যেন কথার খই ফোটা শুরু হয়েছে... অজস্র ধারায় বেরিয়ে আসছে একটার পর একটা যুক্তি...দৃষ্টানের পর দৃষ্টান্ত...বিচারপতির আসনে বসে একসময় ঘুমিয়ে পড়েন বিচারক।
সহসা জেগে উঠে চোখ কচলিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখেন বেনার্ড সাহেব তখনো তার বক্তব্য চালিয়ে যাচ্ছেন। কোন শ্রান্তি নেই, ক্লান্তি নেই,নেই যেন কথার শেষ।
এমনি করেই পার হলো ...এক দিন...দুই দিন...পাচ দিন...পাচ রাত!! সুদীর্ঘ এই পাচদিন পাচরাত ধরেই উকিল সাহেব তার বক্ত্রিক্তয়া দিয়ে গেলে অবিরাম গতিতে অনর্গল। সবাই ব্যাপারটা ধরতে পারলো অবশেষে যে তিনি শুধুমাত্র সময় নষ্টো করার জন্যই এই কান্ড করছেন...
কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না...কারণ আদালত তাকে কথা দিয়েছে তার বক্তব্য শেষ হবার আগে রায় কার্যকর করা যাবে না। যুক্তির এই কঠিন মারপ্যাচেই তার কাছে কাবু হয় আদালত।
এদিকে ৫ দিন ৫ রাত পরেই হন্তদন্ত হয়ে আদালতে ঢুকেন মিসেস জিন...সম্রাটের কাছ থেকে আদেশনামা নিয়ে। সম্রাট তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা করে দিয়েছেন।
এবার উকিল সাহেব মিসেজ জিনের হাত থেকে আবেদনটি পেশ করে শেষ বারের মতো বলেন- "মহামান্য আদালত , মাদের মহানুভব সম্রাট আমার মক্কেল জেনারেল জিন ট্রভটকে অতীত গৌরব ও বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তার অপরাধ ক্ষমার করে দিয়েছে। আমি মহামান্য আদলাতের সামনে সম্রাটের সেই আবেদেশ নামা পেশ করছি"
এই বলে শ্রান্ত ক্লান্ত উকিল সাহেব বসে পড়লেন তার নিজের আসনে... তার মুখে ফুটে উঠে বিজয়ের হাসি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।