সূত্রহীন অসংখ্য খুনের রহস্য উদঘাটন করেছিলেন একসময়ের আলোচিত গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা ফজলুল করিম। একে একে গ্রেফতার করেছিলেন খুনি চক্রের সদস্যকে। পাঁচ মাস আগে পুলিশের এ চৌকস কর্মকর্তা রাজধানীতে নিজেই খুনের শিকার হন। কিন্তু তার খুনিরাই ধরা পড়েনি।
গোপীবাগে পিতা-পুত্রসহ ছয়জনকে জবাই করা হয় ২১ ডিসেম্বর।
চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় মাস পেরোতে যাচ্ছে। সে ফ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই একেক সময় একেক ধরনের বক্তব্য দিয়ে পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছে। খুনি কারা_ এ প্রশ্নের জবাবই নেই পুলিশের কাছে। এ ঘটনার কয়েক দিন আগে তেজগাঁও শাহীনবাগে সন্ত্রাসীদের হাতুড়ির আঘাতে নির্মমভাবে খুন হন হিরণ মিয়া (২৫)। তেজগাঁও থানায় মামলার পর তদন্ত শুরুও হয়।
কিন্তু হঠাৎই তদন্ত বন্ধ। কারণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) নেই!
শুধু এসব ঘটনাই নয়, গত দুই বছরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা এমন শতাধিক খুনের মামলার তদন্ত কার্যত বন্ধ হয়ে আছে। কোনো মামলার আইও নেই। আবার কোনো মামলার সাক্ষী হয়ে গেছেন নিখোঁজ। বিভিন্ন কারণে চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্ত আর আলোর মুখ দেখে না।
ফাইলচাপা পড়ে থাকে থানা ও পুলিশের বিভিন্ন দফতরে। এসব মামলার তদন্ত করছে পুলিশ, র্যাব, ডিবি ও সিআইডি।
রাজধানীর অপরাধ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এই সময়ে নিজ বাসায় কুপিয়ে অথবা গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, আইনজীবী, পুলিশের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, গৃহবধূসহ শতাধিক নারী-পুরুষকে।
মামলার তদন্ত থেমে যাওয়া ও আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় চরম হতাশায় ভুগছেন নিহতদের স্বজনরা। তাদের অভিযোগ, থানা পুলিশের কাছে ধরনা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তারা।
আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় নিজেরাই রয়েছেন আতঙ্কে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ এস এম শাহজাহান বলেন, খুনিদের গ্রেফতার করা পুলিশের কাজ। খুনের আসামিদের গ্রেফতার করা না গেলে এ ধরনের অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাবে। নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়বে। পুলিশের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে মানুষ।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন, চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা সব সময় থাকে। গোয়েন্দা পুলিশ এ ব্যাপারে কাজ করছে। তবে সম্প্রতি ছয় খুন বা পুলিশ কর্মকর্তা খুনের মামলার তদন্তে অগ্রগতি হয়নি বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের পুরোটাই জামায়াত-শিবিরের ধারাবাহিক সহিংসতা মোকাবিলা করতে গিয়ে রাজধানীসহ সারা দেশের পুলিশ সদস্যরা অনেকটাই কাহিল হয়ে পড়েন। এর পরও প্রতিদিনই তাদের দৈনন্দিন 'ক্রাইম ওয়ার্ক' বাদ দিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবিলা করতে হয়েছে।
এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশজুড়ে এখন অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পেশাদার অপরাধীরা। তারা বেডরুম পর্যন্ত ঢুকে গুলি করে লাশ ফেলে পালিয়ে যায়। পথে-ঘাটে খুন করে। এমনকি খুন হন জননিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরাও। কিন্তু অধিকাংশ মামলার তদন্ত আর বেশি দূর এগোতে পারেনি।
ডিএমপির একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, এক বছর ধরে পুলিশকে রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রটোকলেই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে বেশি। নিয়মিত ডিউটি করে মামলার তদন্তে তারা সময় পান খুব সামান্য। ওই সময়ে হত্যা মামলার তদন্ত চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশির ভাগ চাঞ্চল্যকর মামলায় আসামি গ্রেফতার হয়নি। শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর পুলিশ বঙ্ েস্থাপিত ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবল বাদল মিয়া গত ফেব্রুয়ারিতে খুন হন।
মতিঝিল থেকে উদ্ধার হয় তার লাশ। এ খুনের সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। ২৯ আগস্ট রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার নিজ বাসায় পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ফজলুল করিম খান (৬৫) খুন হন। সকাল পৌনে ১০টার দিকে অস্ত্রধারী তিন যুবক বাসায় ঢুকে তার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে। গতকাল পর্যন্ত পুলিশ ওই ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
৪ অক্টোবর রাতে কমলাপুর রেলস্টেশনের কাউন্টারের ক্যাশরুমে ঢুকে বুকিং সহকারী ইস াফিল হোসেনকে হত্যা করে প্রায় ১৭ লাখ টাকা লুট করে দুর্বৃত্তরা। আড়াই মাসেও এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজাবাজারের একটি বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। মামলার কোনো খুনি গ্রেফতার হয়নি। মামলার তদন্ত থেমে আছে বহু দিন আগে থেকেই।
এ ছাড়া ওই বছরের জুলাইয়ে পল্লবী থানা আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন কাঞ্চনকে হত্যা করে চলন্ত মাইক্রোবাস থেকে দৈনিক বাংলা মোড়ে ফেলে দেওয়া হয়। ২৯ জুলাই রাজধানীর হাজারীবাগে ট্যানারি ব্যবসায়ী মোহাম্মাদ জসীম উদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করা হয়, পুলিশ হত্যার মটিভ উদঘাটন করতে পারেনি। এ ছাড়া আগস্টে বনশ্রীতে কনস্ট্রাকশন ব্যবসায়ী আহসান আরিফ বিল্লাহ, শান্তিনগরের চামেলিবাগের বাড়িতে সস্ত্রীক পুলিশ ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান, পল্লবীতে যুবলীগ নেতা শাহ আলী রকি, মতিঝিলে সমবায় ব্যাংকের নিচে ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সায়েদাবাদ বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খায়রুল হক মোল্লা, ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগ নেতা আসাদুজ্জামান আল ফারুক, হাজারীবাগের জমির হোসেন খুনের ঘটনা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেও পুলিশের তদন্তে নেই কোনো অগ্রগতি। এ ছাড়া রাজধানীর সুরক্ষিত ফ্ল্যাটের বেডরুমেও জোড়া খুনসহ বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। প্রতিটি ঘটনাই আলোচিত হলেও পুলিশ একটি মাত্র ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছে।
২৮ সেপ্টেম্বর মিরপুরের রূপনগরে ভরদুপুরে বাসার ড্রইংরুমে ঢুকে অস্ত্রধারীরা গুলি করে হত্যা করে আবাসন ব্যবসায়ী জাফরুল হক মোক্তারকে। ১৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ীতে ব্যবসায়ীর বাড়িতে ঢুকে বাবা-মায়ের সামনে বখতিয়ার মোহাম্মদ লতিফ (১৯) নামে এ-লেভেলের ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৮ ও ২০ সেপ্টেম্বর ভাটারা ও ডেমরায় দুই গৃহবধূ খুন হন নিজ ঘরে।
সূত্র জানায়, নয়াপল্টনের ফ্ল্যাট থেকে দৈনিক জনতার সিনিয়র সহ-সম্পাদক ফরহাদ খাঁ ও তার স্ত্রী রহিমা খানমের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ফরহাদ খাঁর ভাগ্নে নাজিমুজ্জামান ইয়ন গ্রেফতার হন।
কিন্তু নিহতের পরিবারের সদস্যরা মামলার তদন্তের শুরু থেকেই পুলিশের বিরুদ্ধে ঘটনা আড়াল করার অভিযোগ করেন। ইন্দিরা রোডের নিজ ফ্ল্যাট থেকে বৃদ্ধা ভার্জিনিয়া রোজারিও ও তার ছেলে ভ্যালেন্টাইন রোজারিও মিল্টনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শোবার ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিল ভার্জিনিয়ার গলা কাটা লাশ। আর খাটের সঙ্গে শিকলে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায় মিল্টনের লাশ। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করা হলেও প্রকৃত দোষী কে, তা এখনো পুরোপুরি চিহ্নিত হয়নি।
দক্ষিণখানে সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার নাসির উদ্দিন ও তার স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মুক্তা, গুলশানে ব্যবসায়ী বৃদ্ধ ফজলুল হক, মিরপুরে ব্যবসায়ী জিয়া হায়দার, যাত্রাবাড়ীতে মা সুফিয়া খাতুন ও স্ত্রী বীথি রহমানসহ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান মিল্টন, মিরপুরে বৃদ্ধা নূরজাহান বেগম, ধানমন্ডিতে অ্যাডভোকেট নাজির আহমেদ খান, গ্রিন রোডে এনজিও পরিচালক আবুল কাসেম, পল্লবীতে স্কুলশিক্ষিকা আকলিমা আক্তার ওরফে রুবি, মিরপুরে আলেয়া বেগম, বাড্ডায় নূরজাহান বেগম এবং বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সরকারি কোয়ার্টারে শোবার ঘরে খুন হন নারায়ণ চন্দ্র দত্ত ওরফে নিতাই নামের এক চিকিৎসক নেতা। এসব হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আসামিরা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কোনো কোনো ঘটনার রহস্যই এখনো পুলিশ উদঘাটন করতে পারেনি।
সাক্ষী নিখোঁজ : বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুমের পর থেকেই পাওয়া যাচ্ছে না তার গাড়িচালক আনসার আলীকে। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির বাসার দারোয়ান হুমায়ুন কবিরকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ঘটনার পর থেকে।
আলোচিত মামলাগুলোর তদন্তে সাক্ষী হিসেবে এই ব্যক্তিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রত্যেকের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন হলো এসব ব্যক্তির খোঁজ মেলেনি। তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টাও চলছে না। এমনকি মামলার তদন্তের প্রয়োজনেও তাদের হাজির করা হচ্ছে না।
নিখোঁজ এসব ব্যক্তির পরিবার দুশ্চিন্তায় রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড বিবেচনায় ৩২টি মামলা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু কোনো মামলার তদন্তই শেষ হয়নি। এসব মামলার মধ্যে রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. আফতাব আহমাদ, ঢাকা নগর আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম বাচ্চু, গণতন্ত্রী পার্টির নেতা নুরুল ইসলাম, গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম, কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র বিপ্লব হত্যাকাণ্ড অন্যতম। এসব মামলা পুলিশ, র্যাব, ডিবি ও সিআইডি তদন্ত করছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।