ছেলেবেলায় পুরোনোদের যখন ফেলে আসা দিন নিয়ে স্মৃতিকাতর হতে দেখতাম, মনে হতো, তারা যেন একটা সময় বুদ্বুদে আটকে আছেন, যেখানে পুরোনো মানেই ভালো, সমকালটা সমস্যাসংকুল। ‘আমাদের সময় শান্তি ছিল’, কেউ কেউ বলতেন; ‘মানুষে মানুষে ভালোবাসা ছিল’, বলতেন অন্যরা। আমরা শুনে হাসতাম। ‘আমাদের সময়ে এসে শান্তি কি তবে পালিয়েছে?’ আমরা জিজ্ঞেস করতাম, অথবা ‘মানুষেরা কি ভালোবাসা ভুলে গেছে?’ আজ, এত দিন পর, ছেলেবেলার উৎসব নিয়ে লিখতে গিয়ে সেই আমিই যে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ব এবং আমাকেই বলতে হবে ‘আমাদের সময় শান্তি ছিল’, এটি কি কখনো ভাবতে পেরেছিলাম? আমিও কি তবে সময়-বুদ্বুদে আটকে পড়া একজন মানুষ?
খবরের কাগজে পড়লাম, ঈদ ও পূজার জন্য থাকবে তিন স্তরবিশিষ্ট পুলিশি নিরাপত্তা। সঙ্গে থাকবে র্যাবের প্রস্তুতি।
ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসানো হবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে। গন্ধ শুঁকে তস্কর চেনে, সে রকম কুকুরও থাকবে। ছবি দেখলাম, কোনো কোনো জায়গায় মৃৎশিল্পীর শেষ করে আনা দুর্গা প্রতিমা গুঁড়িয়ে দিয়েছে জঙ্গিরা। তার পরও, আমি জানি, আনন্দের উৎসব হবে এবারের ঈদ ও পূজায়। ওই দুই দিন মানুষ ভুলে যাবে সব হানাহানি, উগ্রতা আর অসহিষ্ণুতা।
বাঙালির এই শক্তি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, আকাশটা ছুঁয়ে দেখার শক্তি জোগাচ্ছে। কিন্তু ঈদ-পূজায় গরিবেরাও কি শামিল হতে পারবে; গরিবদের মধ্যেও যারা গরিব, সেই হতদরিদ্ররাও? একটি বাড়িতে দেখলাম, এই ঈদ মাথায় রেখে একটা পেল্লাই ফ্রিজার কেনা হয়েছে। দুটি আস্ত গরুর জায়গা হয়ে যাবে সেখানে। গরিবেরা তাহলে কী পাবে?
ছেলেবেলায় ঈদে-পার্বণে প্রতিবছর আমরা উপহার পেতাম না। অনেক সচ্ছল পরিবারের সন্তানেরাও না।
এক ঈদে আমার এক বন্ধুর লন্ডন-প্রবাসী বাবা এলেন, কাফ লিংক লাগানো বিলেতি শার্ট নিয়ে। সেটি পরে একটা চক্কর দিতে না দিতে বন্ধুটাকে ডেকে নিলেন তার বাবা। কিছুক্ষণ পর সে রোজদিনের একটা শার্ট গায়ে চাপিয়ে এল। কেন? না, সবার যেহেতু নতুন জামা কেনা হয়নি, তারা তার বিলেতি শার্ট দেখে মন খারাপ করবে। আমার মা ঈদে বই দিতেন।
সেই বই পড়া শেষ হলে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করা যেত, শার্ট তো আর ভাগ করার জিনিস না।
সময়-বুদ্বুদটা কি তাহলে ভুল?
পূজার সময় অনেক দিন থেকে প্রস্তুতি চলত। সেই মহালয়ার দিন থেকেই। ঢাকের বাদ্য শুনতাম মণ্ডপ থেকে। খুব বেশি যে মণ্ডপ হতো শহরে তা নয়, কিন্তু প্রতিটিই থাকত জমজমাট।
মসজিদে যখন আজান হতো, ঢাকের বাজনা থেমে যেত। নামাজ শেষ হলে আবার শুরু হতো। কোনো দিন শুনিনি দেবী-প্রতিমা কেউ ভেঙেছে। আমাদের কাজ ছিল মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে প্রসাদ খাওয়া। জিবে পানি ঝরানো শারদীয় উপহার।
আমরা পূজার আনন্দে ভাগ বসাতাম, আর অবাক হয়ে দেখতাম অমুক দিদি অথবা তমুক মাসিকে যেন পূজার সাজে চেনাই যাচ্ছে না। কোরবানির ঈদে আপা-খালারা পাড়া ঘুরতে বেরোতেন বিকেলে। তাঁদের দেখেও আমরা অবাক। ছেলেবেলার উৎসবগুলো রঙে ভরা থাকত। সেই রং থাকত চোখে, পোশাকে, মনে, শহরের আকাশে আর রাস্তাঘাটে।
বাকি দিনগুলো কাটত নিস্তরঙ্গ, সাদামাটা। উৎসবের দিনগুলো তরঙ্গ তুলত রঙের, আনন্দের। এ জন্য সব উৎসবেই আমরা ভাগ বসাতাম। আমাদের পাড়াটা ছিল মণিপুরিপ্রধান। তাদের যত উৎসব—ঝুলন, রাসলীলা—যেন ছিল আমাদের জন্যও।
। রথযাত্রায় শামিল হতাম, রথের রশিতে হাত না লাগাতে পারলেও প্রসাদে ভাগ বসাতে সমস্যা ছিল না।
ছেলেবেলার ঈদ আর পূজায় রং ছিল, আনন্দ ছিল, উচ্ছ্বাস ছিল, কিন্তু চাকচিক্য ছিল না, লোক দেখানোর আয়োজন ছিল না। কোরবানির ঈদে গরু কেনার প্রতিযোগিতা ছিল না। মানুষের হাতে পয়সা ছিল কম, ফলে কৃচ্ছ্রসাধনটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
ফলে যেটুকু সাধ্য, তাতেই আবশ্যকতাগুলো সারতেন মানুষ। কিন্তু যার কোনো কমতি ছিল না, তা হচ্ছে অন্যের জন্য দায়িত্ববোধ। কারও বাড়িতে ফ্রিজ ছিল না, ফ্রিজার ছিল না। ফলে সঞ্চয়ের কৃপণতা কাউকে দেখাতে হতো না। অল্প কিছু মাংস অবশ্য অনেক বাড়িতে রেখে দেওয়া হতো ‘খুশবু’ দিয়ে।
এই খুশবু দেওয়া কী, কী তার রসায়ন, আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। আমি শুধু অবাক হতাম, ঈদের দুই মাস পর যখন অল্পখানি খুশবু দেওয়া মাংস রেঁধে মা আমাদের অবাক করতেন। কিন্তু গরিবের ভাগ নিয়ে কেউ হিসাবে বসত না। সময়টা ছিল অকাতর মানসিকতার, আঙুলে গুনে হিসাবের নয়।
উৎসব মানেই তো আনন্দ।
এই আনন্দের এমনই রূপ যে একে নানা সংকীর্ণতা, উগ্রতা দিয়ে মাপতে গেলে এটি হাওয়া হয়ে যায়। এই আনন্দে কালো-ধলো, লুঙ্গি-ধুতির আলাদা আলাদা জায়গা করে দিতে গেলে তাতে ভাটার টান পড়ে। আমার ছেলেবেলার আনন্দটা ছিল আকাশটার মতো। একে ফালি ফালি করে নানান পাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টাই তো হাস্যকর।
সময়-বুদ্বুুদটা কি তাহলে মন্দ ছিল?
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।