...............................................................................................................................................................।
‘আজ এই বৃষ্টির কান্নার দেখে মনে পড়লো তোমায়
অশ্রুভরা দুটি চোখ;তুমি ব্যাথার কাজল মেখে লুকিয়েছিলে ঐ মুখ!’
বৃষ্টির কোন গানের কথা মনে করতে গেলে প্রথমেই আমার মনে আসে ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর এই গানটির কথা। এই অসাধারন গানটি আমার অনেক পছন্দের। কথা,সুর,গায়কী,বৃষ্টি বিলাস, সব কিছু মিলিয়ে এক ভিন্ন মাদকতা রয়েছে এই গানটির মধ্যে। তাই আজ যখন ও আমাকে বৃষ্টির গান শোনাতে বলল আমি এই গানটি-ই গুনগুন করে গাওয়ার চেষ্টা করলাম।
বৃষ্টির গান ওর খুব পছন্দ। কিন্তু বৈরী আবহাওয়া ছাড়াতো আর বৃষ্টির গান শোনার বা গাওয়ার তেমন কোন আবহ তৈরী হয়না। বৈরী আবহাওয়ার বালাই নেই বেশকিছুদিন তাই তার মন খারাপ!বৃষ্টির গান শোনার পায়তারা করতে পারছেনা। সেদিন তার বিষন্ন চেহারা দেখে আমি বলেছিলাম,-অনেকদিন,বৃষ্টি হয়না তাই মন খারাপ?’সে মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল-‘হুম!
এটা কেমন মেয়েরে বাপ!আমি তো এমন কখনো দেখিনি। বৃষ্টি কি বারোমাসই হতে হবে?মেয়েটার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দিনভর বৃষ্টি হলেই বুঝি ভালো।
তার মন রক্ষা করতে গেলেতো সৃষ্টিকর্তাকেও হিমশিম খেতে হবে;সার্বক্ষনিক বৃষ্টি দিয়ে দশজনের ক্ষতি করে একজনের মন ভালোর কোন প্রয়োজন পড়েনা। বৃষ্টি আমাদের জন্য আশীর্বাদ তবে অতিবৃষ্টি কখনো আশীর্বাদ না হয়ে বিপরীত হয়ে দাড়ায়। অবশ্য এমনিতে মেয়েটা এতটা নাছোড়বান্দা নয়। বৃষ্টির জন্য আর্তনাদ তার সারাবছর থাকেনা। তবে যখন বৃষ্টির মৌসুম আসে তখন যদি এক নাগাড়ে কিছু দিন প্রখর রোদে একটু পুড়ে তখনি মাথা হেট হয়ে যায়।
‘বৃষ্টির দিনে,বৃষ্টি হবে না ভালো,তাই বলে এত রোদ দিতে হবে কেন?আকাশটা মেঘলা থাকলেই তো হয়!’
আমি বলি-
‘আমাকে না,সৃষ্টিকর্তাকে জিজ্ঞেস কর!’
বৃষ্টির দিনে তার এমন মুখ ভার করে থাকাটা আমার অনেক পছন্দের। শিশু সুলভ চেহারাটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে তখন। অদ্ভুত এক মায়া তৈরী হয় তার প্রতি।
গিটারটা তুলে রেখেছিলাম দীর্ঘদিন। বুঝেছি আমাকে দিয়ে এসব হবেনা।
না,সঙ্গীতের উপর কোন প্রকার মান-অভিমান নেই আমার। যত মান-অভিমান নিজের উপর। শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন কস্মিনকালেও দেখিনি আজও দেখবোনা!কেবল নিজের ভালোলাগা থেকেই গিটারে টুং টাং করতে একটু আগ্রহী হয়েছিলাম। আমার কেছে মনে হয়,প্রত্যেকের এমন কিছু বিষর উপর (বিশেষ করে গিটারে টুং টাং,আনমনে গান গাওয়া,কবিতার বইয়ে নিমগ্ন থাকা,বাশি বাজানো,ইত্যাদি) কিছুটা দক্ষতা থাকা উচিত। দক্ষতা বলাটা ঠিক মানায়না,ভালোবাসা থাকা উচিত বললেই বোধহয় মানানসই হয়!কেননা,মানুষের একান্ত খারপ মুহুর্তে নিজের নিসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে এসবের বিকল্প নেই।
আমাকে যে আবৃত্তিকার হয়েই কবিতা পড়তে হবে কিংবা শিল্পী হয়েই গান গাইতে হবে,গিটার বা বাশি শিখেই বাজাতে হবে এমনতো কথা নয়। নিজে নিজে চেষ্টায় মগ্ন থেকে নিজের একাকিত্ব বা বিষন্ন মুহুর্তগুলো যন্ত্রনা ভুলে থাকতে কিংবা অতিব্যস্ততার মাঝে একটুখানি সময় শান্তির পরশে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে পারাটাই মুখ্য হওয়া উচিত। শিল্প,সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে বেচে থাকলে জীবন কখনো নিরানন্দ হয়ে উঠেনা।
আমার এই অভ্যাসটার কথা তার আগেই জানাছিল। সে-ই আমাকে বাধ্য করেছে বহুদিন পর ধুলোজমা গিটারে হাত দেবার।
আজ আমি লুকিয়ে গিটারটা সাথে করেই বেরিয়েছি। আমাদের রোজ আড্ডার জায়গাটির পাশে একটা সুন্দর টং দোকান রয়েছে। আমাদের প্রতিদিন গল্পের সাথী হয় এই টং দোকানের চায়ের কাপগুলো। সেখানেই গিটারটি রেখে দিয়েছিলাম। তাকে দেখাইনি, চমকে দিব বলে।
আমি কোন কথা না বলে উঠে আসলাম। সে ভেবেছিল আমি হয়ত আমাদের জন্য চা নিয়ে আসতে উঠেছি। গিটার হাতে ফিরে এসে বসেছি,সেদিকে তার দৃষ্টিপাত নেই। অন্যদিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছে।
আমি গিটার নিয়ে একটু টুং টাং করতেই আমার দিকে ফিরে সে চমকে উঠে ঠোটের কোনে এক পশলা হাসি ভেসে উঠল।
আমি গুনগুন করে তাকে গেয়ে শোনালাম
-‘আজ তোমার মন খারপ মেয়ে,তুমি আনমনে,আমি তোমার জন্য এনে দিব মেঘ থেকে বৃষ্টির ঝিরঝির হাওয়া। সে হাওয়ায় ভেসে যাবে তুমি। ’
সেদিন সে আনন্দে আটখানা হয়ে গিয়েছিল। অনেক খুশি হয়েছিল। আমরা যতক্ষন একসাথে ছিলাম আমাদের মাঝে কথন যা হয়েছিল তা কেবল-ই সুরেই/গান আর গিটারেই সীমাবদ্ধ ছিল।
…………………
কারনবশত মাঝের বেশ কিছুদিন তার সাথে দেখা হয়না। যোগাযোগ যাই হয় মুঠোফোনে। তা আবার কয়েকমিনিটেই সীমাবদ্ধ!
সেদিন বিকেলে বাসায় ফিরতেই চোখে পড়ল লাল নীল বাতিতে সমগ্র বাসাটিকে সাজানো হচ্ছে। আমি কারনটা খুজতে লাগলাম। বাসায় আম্মুকে জিজ্ঞেস করতেই শুনি-চারতলার মুনিয়াদের ছোট ভাইয়ের জন্মদিন।
আমাদের সবাইকে দাওয়াত করে গেছে। সবাইকে অনুষ্ঠানে গিয়েছে আমি যায়নি। ছাদে গিয়ে বসে আছি এক কোনে। গুনগুন করে রবি ঠাকুরের একটা গানকে বারবার আওড়ানোর চেষ্টা করছি।
বেশ খানিকক্ষন পর ছাদে যেন কারো সাড়া পেলাম!আমি সেদিকে দৃষ্টিপাত করিনি।
কত মানুষইতো আসে। আর তাছাড়া আজ বাসায় একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে অনেক অতিথি আসতেই পারে। তবুও একটু পর কৌতুহল বশত তাকাতেই মুনিয়াকে চোখে পড়ল। সাথে আর কেউ যেন আছে। আমি আর ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করিনি।
মুনিয়া এ বাসায় অনেকদিন থেকে। কিন্তু তবুও তার সাথে আমার তেমন বোঝাপড়া তৈরী হয়নি। শুধু সামনা সামনি দেখা হলে হায়-হ্যালো ছাড়া। একটু পর হঠাৎ করেই দেখলাম মুনিয়া কী যেন বলে উঠল-
-‘কেমন আছেন ভাইয়া?’
-‘হুমম!ভালো!’
‘তুমি ভালো আছ?’
-‘হুমম’
-‘আপনি আজ বাসায় আসলেন না কেন?’
-‘এমনিতেই! শরীরটা একটু অসুস্থতো তাই!’
ততক্ষনে আমার দৃষ্টি পড়ে যায় তার পাশে থাকা মেয়েটির দিকে।
আমি এতটা চমকে উঠেছি,যেন হঠাৎ আমি চোখে সর্ষে ফুল দেখছি।
অঙ্গুলি দিয়ে তার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই মুনিয়া উত্তর দিল-
-‘আমার বান্ধবী…()। ’
-‘ও আচ্ছা!’
আমরা কেউ কাউকে না চেনার ভান করলাম। সে আমাকেও ঐ মেয়েটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
হঠাৎ মুনিয়ার ডাক পড়ল!-‘ভাইয়া ওর সাথে একটু গল্প করেন আম্মু ডাকছে,আমি আসছি। ’
মুনিয়া ভালো করেই জানে আমি অতিশয় ভদ্র স্বভাবের ছেলে।
এই এত বছরে এখন পর্যন্ত একদিনও আমার কাছ থেকে অনাকাংখিত কিছু সে পায়নি…। মুনিয়া ছাদ থেকে নামতেই আমরা দুজনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। মুনিয়া তার বান্ধবী; আমি আজ এই মুহুর্তে জানলাম!এর আগে কোনদিন বলতে শুনিনি। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম!
-‘আমাকে আগে বলনি কেন?’
-‘বলার প্রয়োজন মনে করিনি। বললে কি হত!-এ বাসায় নিয়ে আসতে তোমার বায়না জাগত যখন তখন।
আমাকে হয়ত আসতে হত,পোহাতে হত অনেক ঝামেলা। ’
-‘তাহলে আজ আসলে কেন?’
-‘চমকে দিব বলে। ’
-‘এবার খুশিতো!’
-‘হমম…অনেক। ’
ও এতটা নম্র স্বভাবের রাগ করেও কখনো একটু কড়া ভাষায় কথা বলেনা!আমিও যদি কখনো রাগের স্বরে কিছু বলি মুহুর্তেই মন ভোলানো একটা হাসি দিয়ে আমার সব কেড়ে নেয়। তার সব কিছুই আমার কাছে মায়াময়।
অবিশ্বাসের জায়গা তৈরী করবার কোন সুযোগ-ই দেয়না।
অনেকক্ষন হয়ে গেল মুনিয়াকে এখনো ছাদে আসতে দেখলাম না!ব্যাপার কি!রাত ক্রমাগতই বেড়ে যাচ্ছে। আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেও খুব ভালো লাগছে। মনে মনে ঠিকই বলছি- ‘আরেকটু দেরি হলেই ভাল। ’ কেননা আমার পাশে যে আমার সবসময় ভালোলাগার মানুষটি-ই বসে আছে।
তবে ও পাশে থাকা সত্ত্বেও পরিপূর্ন তৃপ্তির কোথাও যেন একটু ঘাটতি পড়ে আছে। চাদের আলোয় তার সমস্ত শরীর ঝলঝল করছে। চাদের আলোতে তাকে এত সুন্দর দেখায় আমি জানতাম না!জানবোই বা কিভাবে? আজই যে তাকে প্রথম চাদের আলোতে দেখেছি। আপছা আলোতে কাছের মানুষটির পাশে বসে থাকার অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হল আজ!আমি কখনো হতভম্ব ভাবে আনমনা হয়ে তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকি!যেন মনে মনে করুন প্রার্থনায় কবি নির্মলেন্দু গুণে’র এই কবিতাটাই আবৃত্তি করছি-
‘শুধু একবার তোমাকে ছোব,
ঐ আনন্দে কেটে যাবে সহস্র জীবন
শুধু একবার তোমাকে ছোব,
অহংকারে মুছে যাবে সকল দীনতা।
শুধু একবার তোমাকে ছোব,
স্পর্শ সুখে লেখা হবে অজস্র কবিতা
শুধু একবার তোমাকে ছোব,
শুধু একবার পেতে চাই অমৃত আস্বাদ।
শুধু একবার তোমাকে ছোব,
অমরত্ব বন্দী হবে হাতের মুঠোয়।
শুধু একবার তোমাকে ছোব,
তারপর হবো ইতিহাস। ’(আকাশ সিরিজ)।
-‘কী ব্যাপার!চুপ কেন?এভাবে হা করে কী দেখছ?’
ঘুম ভাঙ্গার মত করে আমি চমকে উঠি। তার উপর আমার সাময়িক বিরক্ত হয়!কেননা আমি যে তাকে আমার মত করে দেখছিলাম এতক্ষন।
-‘হমম!তোমাকেই দেখছিলাম!’
-‘আজ প্রথম দেখলে মনে হচ্ছে!’
-“হুমম,আজ প্রথম দেখেছি-‘চাদের আলোতে’। চাদের আলোতে তোমাকে এত সুন্দর দেখায় এতদিন শুধু কল্পনা করেছি,স্বপ্ন রাজ্যে দেখেছি, আজ আমি দেখছি আমার চোখের সামনে;নিজেকে বিশ্বাস করাতে মাঝে মাঝে হিমশিম খেতে হয়!”
-‘মানে!বিশ্বাস না হলে এই নাও আমার হাত ছুয়ে দেখ!’
আমার চোখ মুখ ভেতর বাহির একসাথে আনন্দে হেসে উঠে। সমস্ত শিরা উপশিরাজুড়ে উল্লাসের ঝড় বইতে থাকে। আমি-ই যে এতক্ষন এ বায়নাটা-র আশায় ছিলাম। আমার হাতটা বাড়াতেই অমনি ওপাশ থেকে একটা শব্দ ভেসে আসলো!মনে হল কে যেন আসছে ঐ!মুনিয়া কি তাহলে চলে এসেছে?আমরা হাত গুটিয়ে নিই।
কিন্তু তাকিয়ে দেখি না,মুনিয়া নয়!অন্য কেউও নয়!কেউ আসেনি। অজানা ভয়ে আমরা গুটানো হাতটা আর বাড়াই না। ‘কই অনেকক্ষণ তো হল!মুনিয়াতো এলোনা। ইসস!এতো দেরি করবে জানলেতো…!’
কোথাও থেকে শোনা একটা গল্পের কথা আমার মনে পড়ে যায়! গল্পটা ছিল এমন-
“নব বিবাহিত এক দম্পতি বিয়ের পর হানিমুনের উদ্দেশ্যে রওনা হল এক মনোরোম জায়গায়। ট্রেনে করে যাচ্ছে।
ট্রেন চলছেতো চলছে!নববরের খুব সাধ হল,বউকে একটা চুম্বন করার!কিন্তু সে রকম কোন পরিবেশই চোখে পড়ছেনা। চারপাশের মানুষগুলো কেমন দিব্যি তাকিয়ে আছে। হঠাত করে চারপাশ জুড়ে অন্ধকার নেমে আসলো। ট্রেনটি দুর্গম পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছে। দু’পাশের পাহাড়ের কারনে সমস্ত ট্রেন জুড়ে অন্ধকার পরিবেশ।
বর খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ল,ভাবছে এই সুযোগ, বউকে চুম্বন করার। কিন্তু সাহস পেলনা বেচারা। এই বুঝি অন্ধকার কেটে গেল!ট্রেনটি বুঝি আলোতে চলে এসেছে! এমন ভাবতে ভাবতে ঠিকই অন্ধকার কেটে গেল। বেচারার আর বউকে চুমো খাওয়া হলনা। আধার কেটে যাওয়ার সাথে সাথেই একটু মেজাজি হয়ে আক্ষেপ করার মত নিজে নিজে বলে উঠল-
-‘ইস!এতক্ষন থাকবে জানলেতো…!’
বউ শুনে পাশ থেকে বলল-‘কি?জানলে কি করতে?’
বর বলল-‘তোমাকে চুমু খেতাম!’
বউ বলল-‘কেন,তুমি দাওনি??তাহলে কে দিল?’
হুমম!!বরের দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকার ফাকে অন্ধকারের সুযোগটা লুফে নিয়েছে পাশের অন্য লোকে……।
”
এ গল্পের কথা মনে পড়তেই আমার ভেতরে একটু সাহসের সঞ্চার হল। বোধদয় হল,-সুযোগ পেলে তা সাথে সাথেই গ্রহন করা উচিত। আমি হাত বাড়িয়ে তার হাতটা আমার মুঠোতে নিলাম!অদ্ভুত ভালোলাগার এক হিম শীতল বাতাস বয়ে গেল আমার হৃদয় জুড়ে। মনে পড়ে গেল কবি শামসুর রাহমানের কবিতার কথা তবে একচুলও মিথ্যা নয়-
‘……স্পর্শ করলাম তোমাকে,যেমন কোনো
সুরসাধক গভীর অনুরাগে তার বাদ্য যন্ত্রের তার
স্পর্শ করেন অভীষ্ট সুর বাধার জন্যে।
যখন তোমাকে ছুই,মনে হয় এই বার আমার প্রথম ছোয়া।
…………’’(অন্য কোন সাক্ষী নেই,শামসুর রাহমান)
আমাদের আঙ্গুলে আঙ্গুলে খেলা করছে আর আমরা কথা বলছি,কখনো নিশ্চুপ থেকেছি,আনমনে তাকিয়ে দেখেছি মেঘ আর চাদের লুকোচুরি খেলা।
মধ্যরাত গড়িয়ে পড়েছে এরই মধ্যে। কিন্তু মুনিয়া এখনো এল না!তার মুখ থেকে যাবার কোন তাড়া না পেয়ে আমিও নিশ্চুপ থেকেছি!খুব ইচ্ছে করছে চাদের আলোয় তাকে চুমু খেতে। আমার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে চুমুর জন্য অসহায় আর্তনাদ শুরু হয়ে গেল-
‘একটি চুম্বন দাও
শীতার্ত রাত্রিতে আমি তোমার দরোজায়
সারারাত দাঁড়িয়ে থাকবো।
একটি চুম্বন দাও
ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে আমি একা-একা
সমুদ্রে নৌকা ভাসাবো।
একটি চুম্বন দাও
আমি যুদ্ধক্ষেত্রে অনায়াসে মর্টারের সামনে
বুক পেতে দেবো।
একটি চুম্বন দাও
আমি মধ্যরাত্রির কাটাতার ছিড়ে ফেলে
গ্রেফতার বরন করবো।
একটি চুম্বন দাও
আমি নির্দ্ধিধায় বরফশীতল ইংলিশ চ্যানেল
অতিক্রম করে যাবো।
………(একটি চুম্বন দাও-অসীম সাহা)’
আমাদের দৃষ্টি যখন মুখোমুখি হয় অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি দুজন। অন্ধকারে কারো চোখ স্পষ্ট দেখা না গেলেও আমরা যেন এর মাঝেও দুজন দুজনকে দেখছি।
আমাদের চোখ যেন কথা বলছে!আমাদের ভেতর থেকে যেন একসুরে চিৎকার উঠছে হৃদয়ে হৃদয় মেলাবার,আপন দেহে বাহুডোরে বাধিকার। বিদ্রোহী কবির একটি গানের কথাই বারবার আমার মনে পড়ছে-‘প্রিয় এমনও রাত যেন যায় না বৃথাই!’
ছাদের রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দুজন!আমি তার সামনে এসে দাড়াই দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাতে থাকি।
সে বলে উঠল-‘কী ব্যপার!’
আমি কোন কথা বলিনা। অপলক তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষন!তার কাছাকাছি এসে প্রাণ ভরে তার নিঃশ্বাস নিই। তার নিঃশ্বাসে নিঃসৃত কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে অক্সিজেন ভেবে আমি নিঃশ্বাস নিতে থাকি।
বাতাসে উড়তে থাকা এলোমেলো চুলগুলোকে এক হাত দিয়ে তার কপাল থেকে সরিয়ে আলতো করে একটা চুম খাই। তারপর বাহুবন্ধনে আকড় ধরি রাখি। পরম বাধনে সে-ও আমাকে আগলে রাখে সযতনে। হুট করেই ঝুম বৃষ্টি নেমে আসে প্রকৃতি জুড়ে। আমরা যেন ঘুমিয়ে।
আমি তার কানে কানে বললাম-
-‘বৃষ্টি পড়ছে!’
সে বলল-‘হুম!দেখতেই তো পাচ্ছি-বৃষ্টি হচ্ছে!’
আমি আবার বলে উঠি-‘বৃষ্টি পড়ছে…ভেতরে যাওয়া উচিত,তুমি ভিজে যাচ্ছ!’
সে বলল-‘তো কি হয়েছে!আজ-ই তো ভেজার সময়!’
আমার ভেতরে কিছুটা ভয় সঞ্চার হলেও আমিও যেন চেয়েছি আমরা আলিঙ্গনেই ডুবে থাকি বাকিটা রাত। কিন্তু না,বৃষ্টি শুরু হয়েছে,টের পেয়ে এক্ষুনি মুনিয়া চলে আসবে। আমরা মাথা তুলে দাড়াই,তার যেন কোন ভয় নেই,সে যেন কোনভাবেই ছাড়তে চাইছেনা। বৃষ্টি ভেজা ঠোটে চুমু খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে সব ভয় ভুলে আমরা মেতে উঠি। ততক্ষনে আমরা ভিজে একাকার।
ছাদ থেকে নেমে পড়ার উদ্দেশ্যে হাটা ধরি। দুজনের দেহ থেকে বৃষ্টি স্রোত আমাদের মুঠোয় এসে মিশে এক স্রোত হয়ে গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। সিড়ির পাশটায় এসে মাথা তুলে তাকাতেই দেখি মুনিয়া দাঁড়িয়ে আছে। হাতে গামছা আর পোশাক;দেখলে মনে হবে সেও বুঝি বৃষ্টিতে ভিজতে এসেছে। আমরা লজ্জিতভাবে মাথা নিচু করার আগেই মুনিয়া হেসে ফেলে।
–‘এক রাতেই এতসব!’
আমাদের ভয় কেটে যায়…!
-‘এখনো দাঁড়িয়ে কেন,বোকার মত?একটু পরেই রাত পোহাবে?তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যান। ‘-বলে ওর দিকে গামছা আর পোশাক বাড়িয়ে দেয়!
…আনন্দে সব ভুলে বিদ্রোহী কবির ঐ গানটিকে নিজের মত গাইতে গাইতে আমি তাদের থেকে বিদায় নিয়ে আগেই নেমে পড়ি!-‘প্রিয়,এমন রাত যেন যায়না ভোলা!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।