রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র গ্যাস সংকট থাকলেও সিএনজি স্টেশনগুলো থেকে দেদার গ্যাস পাচার চলছে। ফিলিং স্টেশন থেকে প্রতিরাতে কাভার্ড ভ্যানবোঝাই সিলিন্ডার ভর্তি করে গ্যাস নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শিল্প-কারখানায়। গার্মেন্টসহ সব ধরনের কল-কারখানায় সেসব সিএনজির অবাধ ব্যবহার চলছে। ফিলিং স্টেশনের সিএনজি গ্যাস নিয়েই চালানো হচ্ছে বিদ্যুৎ প্লান্টও। সিএনজির সংশ্লিষ্ট কর্মীরা জানান, কাভার্ড ভ্যানযোগে আনা সিলিন্ডারগুলোতে রাতভর গ্যাস ভরার কাজ চলে।
এভাবেই গাড়ির জন্য বরাদ্দকৃত সিএনজি এখন শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎ প্লান্ট, বাসা-বাড়ি, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ সব বাণিজ্যিক কাজেই যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। সিএনজি স্টেশন থেকে যানবাহন ছাড়া অন্য কোথাও সিএনজি বিক্রি নিষিদ্ধ থাকলেও প্রভাবশালী সিএনজি মালিকরা তা পাত্তা দিচ্ছেন না। গ্যাসের চাপ কম থাকার অজুহাতে যেসব ফিলিং স্টেশন সিএনজি না দিয়েই গাড়িগুলোকে ফিরিয়ে দেয়, সন্ধ্যার পর থেকে সেসব ফিলিং স্টেশনও সরগরম হয়ে ওঠে। গ্যাস সরবরাহের কাজে তাদের সবগুলো মেশিন সরব থাকে রাতভর। তখন সিএনজিচালিত গাড়িগুলো সিএনজি নিতে গেলেও সংশ্লিষ্ট স্টেশনের কর্মীরা তাদের তেমন পাত্তা দেন না।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই 'গ্যাসের চাপ কম- তাই অন্য কোনো সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস নিন' মর্মে পরামর্শ দিয়ে থাকেন তারা। সপ্তাহব্যাপী অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে নানা চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। সীতাকুণ্ড ও মিরেশ্বরাই এলাকার একাধিক ফিলিং স্টেশনের সিএনজি চলে যায় বহিঃসমুদ্রে অপেক্ষমাণ বিদেশি জাহাজসমূহে, দাউদকান্দি ও আশুগঞ্জের তিনটি ফিলিং স্টেশনের গ্যাস নেওয়ার জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বার্জগুলো অপেক্ষায় থাকে মেঘনা নদীর নানা পয়েন্টে। দেশীয় গ্যাস পাচারকারী দালালরা অধিক লোভে বিপজ্জনক পদ্ধতিতে বানানো বড় বড় সিলিন্ডার ভরে তা পেঁৗছে দেয় ভিনদেশি নৌযানসমূহে। রাজধানী সংলগ্ন টঙ্গী, গাজীপুর ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকায় সিএনজি পাচার হচ্ছে বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো রিকশা ভ্যানের মাধ্যমে।
সাধারণ ভ্যানের মধ্যেই চার বা ছয়টি সিলিন্ডার স্থায়ীভাবে সেটিং করা হয়েছে। এসব ভ্যান সরাসরি ফিলিং স্টেশনে ঢুকে প্রয়োজনীয় সিএনজি ভরে তা বিভিন্ন কারখানায় ঢুকিয়ে থাকে। ভ্যানসমেত সিলিন্ডারগুলো কারখানায় রেখেই এর গ্যাস ব্যবহার চলতে থাকে। এ সময় একই ধরনের আরও ভ্যান নিয়ে গ্যাস সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকে কর্মীরা। অন্যদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম-কাপ্তাই রোডে 'ভ্রাম্যমাণ সিএনজি' সরবরাহের অভিনব প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে আরও বিপজ্জনকভাবে।
একশ্রেণীর ব্যবসায়ী খোলা ট্রাকে সিএনজি ভর্তি সিলিন্ডার সাজিয়ে রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় থাকে। যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে চালকরা তাদের খালি হওয়া সিলিন্ডার খুলে দিয়ে সিএনজি ভরা সিলিন্ডার পাল্টে নেয়। রাস্তার ওপর দাঁড় করিয়েই সেসব সিলিন্ডার হাতুড়ে মিস্ত্রির সাহায্যে সংযোজনের ঘটনাও ঘটে। সিলিন্ডার উঠানামা, খোলানো ও সংযোজনের সময় সামান্য অসাবধানতাতেই বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কাপ্তাই সড়কের দুটি সিএনজি স্টেশন ও পটিয়ার শাহ আমানত সিএনজি স্টেশন, মইজ্জ্যার টেকের জিলানী ফিলিং স্টেশন থেকে এসব সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে দেওয়া হচ্ছে।
চকরিয়া, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ার অবৈধ সিলিন্ডারযুক্ত কমপক্ষে ১৪টি মিনি ট্রাক প্রতিদিন গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত তিনটি সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস নিয়ে যাচ্ছে। আশপাশের ২৫/৩০ কিলোমিটার রাস্তায় আর কোনো সিএনজি ফিলিং স্টেশন না থাকায় গাড়ির চালকরা বেশি দাম দিয়েও ভ্রাম্যমাণ সিলিন্ডার ট্রাক থেকেই সিএনজি সংগ্রহে বাধ্য হন। চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, ট্রাকভর্তি এসব সিলিন্ডারে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ৩৪০০ পিএসআই (পাউন্ড পার ইঞ্চি স্কোয়ার এরিয়া) চাপ থাকে, যা খুবই বিপজ্জনক। বিন্দুমাত্র অসাবধানতায় ঘটতে পারে ভয়ঙ্কর কোনো দুর্ঘটনা। কোনোমতেই ট্রাকে সিলিন্ডার ভর্তি গ্যাস বিক্রির অনুমতি নেই, অনুমতি দেওয়ার প্রশ্নও উঠে না।
এসব ব্যাপারে বিস্ফোরক অধিদফতরের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলা প্রশাসককে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানো হয়েছে। গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির পদস্থ কর্মকর্তারাও চিঠি দিয়েছেন ফিলিং স্টেশনগুলোকে। তবু সিএনজি-গ্যাস পাচার বন্ধ করানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। সারা দেশে সিএনজি সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি সংস্থা আরপিজিসিএল সূত্র জানায়, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) সিলিন্ডারের মাধ্যমে শিল্পকারখানা ও বাসাবাড়িতে জ্বালানি হিসেবে অবৈধভাবে ব্যবহার সরকারিভাবেই নিষিদ্ধ। একইভাবে খোলা সিলিন্ডারে গ্যাস বহন করে বাসাবাড়িতে, কারখানায় বা গাড়িতে ব্যবহার করাও অপরাধ।
কিন্তু অবৈধ কাজটিই চলছে প্রকাশ্যে, সবার চোখের সামনে-অথচ দোষীদের কাউকে শাস্তিও পেতে হচ্ছে না। ফলে দেশজুড়েই সিএনজি পাচারজনিত অপরাধ পাল্লা দিয়েই বেড়ে চলেছে।
গ্যাস পাচার হচ্ছে ভারতেও! : অতিসম্প্রতি বিজিবি সদস্যরা বেনাপোল সীমান্ত থেকে ৫৫ সিলিন্ডার সিএফসি গ্যাস আটক করেছে। ভারতে পাচারকালে শার্শার উত্তর পুটখালীর বারপোতা সীমান্ত পয়েন্ট থেকে গ্যাস বোঝাই সিলিন্ডারগুলো আটক করা হয়। উদ্ধারকৃত এই গ্যাসের আনুমানিক মূল্য ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
যশোর ২৬ বর্ডারগার্ড ব্যাটালিয়নের অপারেশন কর্মকর্তা মেজর ফিরোজ ওয়াহিদ জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ভোররাতে পুটখালী বিওপির বারপোতা সীমান্তের বিশেষ টহল দল অভিযান পরিচালনা করে। ভারতে পাচারকালেই এসব গ্যাস জব্দ করা সম্ভব হয়। চোরাকারবারিরা পালিয়ে যাওয়ায় কাউকে আটক করতে পারেনি বিজিবি। বিজিবির অভিযান ও তথ্যের সঙ্গে কুমিল্লা সীমান্ত এলাকার চালচিত্রের মিল পাওয়া গেছে। কুমিল্লা সদর, সদর দক্ষিণ ও চৌদ্দগ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা অনেকেই জানান, ইদানীং বিশেষ ধরনের ভ্যানযোগে গ্যাস ভর্তি ৬টি করে সিলিন্ডার নিয়ে যাওয়া হয় শিবেরবাজার ও তালপট্টি সীমান্ত পয়েন্টে।
সেখান থেকে রাতের আঁধারে শত শত সিলিন্ডার ওপারে পাচার করা হয় বলেও অভিযোগ করেন তারা। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থেকে চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত রাস্তায় ১২টি সিএনজি ফিলিং স্টেশনের অস্তিত্ব রয়েছে। তুলনামূলকভাবে এসব ফিলিং স্টেশনে সিএনজি গ্রহণকারী যানবাহনের ভিড় দেখা যায় না মোটেও। কিন্তু প্রতিদিন তাদের সিএনজি সংগ্রহ ও সরবরাহের পরিমাণ অসম্ভব বেশি বলে মনে করেন আরপিজিসিএলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ঢাকার পিলখানার বিজিবি হেডকোয়ার্টারের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, অতিসম্প্রতি সিএনজি পাচারের বিষয়টি বিজিবির বিশেষ নজরে এসেছে।
সারা দেশে সীমান্তবর্তী ও সীমান্তের কাছাকাছি থাকা সিএনজি স্টেশনগুলোর ব্যাপারে এরইমধ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং সীমান্ত পয়েন্ট এলাকায় খালি বা গ্যাস ভর্তি যে কোনো সিলিন্ডার পাওয়া গেলে তা ভালোভাবে তদন্ত করার জন্য প্রতিটি বিওপিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।