হার্ডলাইনে বেগম খালেদা জিয়া। তার সাফ কথা- প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি কোনো সংলাপ বা আলোচনায় বসবেন না। আলোচনা করতে চান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। আওয়ামী লীগের সঙ্গেও সংলাপ হলে তিনি চান, 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড'। আর সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে হবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে।
অন্যথায় সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপির কোনো আলোচনা নয় বলে দলের সর্বোচ্চ ফোরামের সদস্যদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়া। ফলে সংলাপ অনুষ্ঠানে সুবিধা করতে পারছে না সরকার। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকরাও দুই নেত্রীকে সংলাপে বসানোর জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্নভাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গত বুধবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে দুবারসহ কয়েক দিনে দফায় দফায় বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডবি্লউ মোজেনা।
এ ছাড়াও এ ব্যাপারে সরব চীন, ভারত, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্তও তৎপর হয়ে উঠেছে সংলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছে না। বেগম খালেদা জিয়ার এখন পরিষ্কার কথা_ নির্দলীয় সরকারের সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা ছাড়া কোনো আলোচনা নয়। আর তিনি সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো আলোচনা করবেন না।
আলোচনা করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সঙ্গে। আর এ জন্য আওয়ামী লীগ প্রধানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে আসতে হবে। তারপর দুই দলের আলোচনার মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত হবে, তা বাস্তবায়ন করবেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার যাই বলুক, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে রাজপথই আমাদের শেষ ঠিকানা। দেশের বেশির ভাগ জনগণই আমাদের পক্ষে।
আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায় করে আগামীতে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে বিএনপি সব সময়ই সংলাপ-সমঝোতায় বিশ্বাসী। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার আন্তরিক নয়। তাই তারা এখন সংলাপ নিয়ে নাটক তৈরি করছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতারা নানা কথা বলছেন।
তবে আন্দোলন নিয়ে খালেদা জিয়ার কঠোর মনোভাবের কথা জানিয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির একজন প্রবীণ সদস্য জানান, গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি সব সময়ই সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটের সমাধানে বিশ্বাস করে। কিন্তু সে জন্য দরকার লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড। তা না হলে আলোচনায় বসলে সে আলোচনা তেমন ফলপ্রসূ হয় না। সে জন্যই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নয়, বরং আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সঙ্গে আলোচনা হওয়া উচিত বিএনপি চেয়ারপারসনের। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে বসাতে।
২০১১ সালে মহাজোট সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর থেকেই সংলাপে বসার দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। কিন্তু এতদিন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পায়নি তারা। বরং বিএনপিকে দিয়ে আন্দোলন হবে না বলে তিরস্কারও করেছে সরকারের অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। গত ২৫ অক্টোবরের সমাবেশে সরকারকে অবৈধ ঘোষণা এবং ২৭ অক্টোবর থেকে ২৯ অক্টোবর তিন দিনের হরতালের পর থেকেই মূলত সরকার দুই নেত্রীকে সংলাপে বসানোর জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম গত কয়েক দিনে একাধিকবার যত দ্রুত সম্ভব সংলাপের আয়োজনের ওপর তাগিদ দিয়েছেন।
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংলাপেই সমাধান। বল এখন খালেদা জিয়ার কোর্টে। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করলেই কাঙ্ক্ষিত সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। তবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার যে ঘোষণা ইতোমধ্যেই দিয়েছেন, সেই ঘোষণাটি তিনি বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে সংলাপ শেষে আনুষ্ঠানিকভাবেই দিতে চান। কিন্তু বাদ সেধেছে বিরোধী দল।
তারা চায় আন্দোলনের মুখেই প্রধানমন্ত্রী তার পদ থেকে সরে যাওয়ার এ ঘোষণাটি দিন। এর পর দুই দল আলোচনা করে যে সিদ্ধান্ত নেবে, রাষ্ট্রপতি তার বাস্তবায়ন করবেন। জানা গেছে, গত তিন দিনের হরতালের পর থেকে নিজেদের আন্দোলনের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা অনেক বেড়ে গেছে বিএনপির। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, দেশের ৯০ ভাগেরও বেশি মানুষ এখন তাদের নির্দলীয় সরকারের পক্ষে। তারা এখন রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করেছেন।
অন্যদিকে সচিবালয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ১৫ জনেরও বেশি সচিবসহ সরকারের নানা দফতরের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সরকারি ঊধর্্বতন কর্মকর্তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিএনপির এ দাবির সঙ্গে একাত্দতা প্রকাশ করেছেন। যে কোনো সময় তারাও মাঠে নেমে যেতে পারেন- ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একই দাবিতে তৎকালীন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব (বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মতো। বিএনপি নীতিনির্ধারকরা আরও মনে করেন, সারা দেশে রাজনীতির মাঠ এখন বিএনপির নিয়ন্ত্রণে। পুলিশ আর জামালপুরের ডিসির মতো প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা ছাড়া সরকারের বেশির ভাগ অংশের ওপর থেকেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলের নেতা মোহাম্মদ নাসিমের 'কথা না শুনলে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে' ঘোষণার পর থেকেই মূলত প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
আগামী দুই সপ্তাহ পর থেকে সরকার তার মেশিনারিজের ওপর থেকে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ হারাবে বলে আশাবাদী বিরোধী দল। এ পরিস্থিতিতে সরকারকে কোনো অবস্থাতেই আর ছাড় দিতে রাজি নয় বিএনপি।
দলের সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে বৈঠককালে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী গত ২৭ অক্টোবর থেকে জাতীয় সংসদের যে কার্যদিবস চলছে, তারও বৈধতা নেই। ফলে ২৭ অক্টোবরের পর সংসদে যে আইন পাস হয়েছে, সেটিও অবৈধ।
আজ কর্মসূচি ঘোষণা : আজ বেলা ১১টায় বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে ১৮ দলীয় জোটের মহাসচিব পর্যায়ের বৈঠক হবে।
সেখান থেকে আগামী ৪ থেকে ৬ নভেম্বর হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। গতকাল এ বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত করে শনিবার নেওয়া হয়। এদিকে আজ সারা দেশে থানা ও উপজেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। হরতালে গ্রেফতারকৃত নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে এ কর্মসূচি পালন করবে বিরোধী জোট। পরের সপ্তাহে টানা পাঁচ দিনের হরতাল দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে ১৮ দল।
এর পর সারা দেশে সব ধরনের অবরোধসহ অসহযোগ কর্মসূচিতে চলে যাবে তারা। আর তখন দলমত নির্বিশেষে সব ধরনের মানুষই একতরফা নির্বাচন প্রতিরোধে একযোগে রাজপথে নেমে আসবেন বলেই আশা করছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। সেভাবে হোমওয়ার্কও করছেন তারা। এ অবস্থায় বিএনপি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপস করবে না কিছুতেই। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের চেয়ারপারসন ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, আন্দোলন ও সংলাপ একসঙ্গে চলবে।
সরকার সত্যিই যদি সংলাপ চায় তাহলে আমরাও প্রস্তুত। কিন্তু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। শনিবার মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠক শেষে নতুন আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে কঠোর কর্মসূচি আসবে।
স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, নির্দলীয় সরকার না মানা পর্যন্ত আন্দোলনের কর্মসূচি শিথিল বা স্থগিত করা হবে না।
সংকট নিরসনে সংলাপ চলতে পারে। একই সঙ্গে আন্দোলনের কর্মসূচিও অব্যাহত থাকবে। যতদিন নির্দলীয় সরকারের দাবি না মানা হবে, ততদিন পর্যন্ত আন্দোলনও চলবে। তিনি বলেন, যত দুঃখ-কষ্টই হোক, এ সরকারকে হটাতে দেশের মানুষ সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে আজ প্রস্তুত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।