নিভে আছে রাস্তার দুই পাশের সোডিয়াম বাতিগুলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার, কয়েক হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। একেবারে ভুতুড়ে পরিবেশ। পথ চলতে ভরসা মুঠোফোনের আলো। শাপলা চত্বরে বিকেল থেকে বসে থাকা হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের তুলে দেওয়া হবে, নিরাপত্তা বাহিনীর সেই অভিযানের খবর সংগ্রহের জন্য আমরা যাচ্ছি পল্টন হয়ে মতিঝিলের দিকে।
আমার সঙ্গে প্রথম আলোর আরও তিন সহকর্মী। এর মধ্যে হঠাৎ গুলির শব্দ। একটি, দুটি নয়, অসংখ্য। সঙ্গে কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট, গ্যাস গ্রেনেড আর সাউন্ড গ্রেনেডের কানফাটা আওয়াজ। গুলি-গ্রেনেডের শব্দে রাজপথও কেঁপে উঠছে।
সে কম্পন এসে বিঁধছে বুকের ভেতরে। পেছন থেকে এক সহকর্মী হাত টেনে ধরেন, ‘...ভাই, এত সাহস দেখানোর কী আছে, যদি গুলি লাগে!’
ওদিকে অফিস থেকে বারবার ফোন আসছে। সবার ফোনে উৎকণ্ঠা, কী হচ্ছে? আমরা যা দেখছি, তা-ই বলছি। অফিসে বসে নোট নিচ্ছেন নজরুল ইসলাম। লাজ্জাত ভাই (প্রধান বার্তা সম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি) ফোনে জানালেন, অভিযানের শেষ পর্যন্ত থাকতে হবে।
দরকার হলে একাধিক সংস্করণ বেরোবে। এর আগে রাত ১০টার দিকেই আমার কাছে খবর আসে পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তিন দিক থেকে শাপলা চত্বর ঘেরাও করে অভিযান চালানো হবে, যাতে সেখানে বসে থাকা লোকজন চলে যেতে পারে। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরে বুঝতে পারেন, এতে সমস্যা হতে পারে, এভাবে অভিযান চালালে অবস্থানকারীদের সরে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। তাতে হয়তো ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে। এরপর দুই দিক থেকে অভিযানের সিদ্ধান্ত হয় এবং যা হওয়ার রাতেই হবে।
এ খবরে আমরা ছুটে যাই মতিঝিলের দিকে।
সাবধানে এগোতে থাকি আমরা। আমার সঙ্গে হারুন আল রশীদ, মোশতাক আহমেদ আর কাজী আনিছ। চলে আসি হেফাজতের সমাবেশের একেবারে কাছে।
রাত তখন আড়াইটা।
মতিঝিলে সড়কের আশপাশে শুধুই ধ্বংসযজ্ঞ। র্যাব-পুলিশ দৈনিক বাংলা মোড় ছেড়ে তখন এগিয়ে যায় সামনের দিকে। হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব তখন মাত্র ১৫-২০ গজ। মধ্যরাতে হেফাজতের কর্মীদের অবস্থানে তখন কোনো সাড়াশব্দ নেই। কিন্তু র্যাব-পুলিশকে দেখামাত্র শুরু হয় চিৎকার-চেঁচামেচি।
রাত পৌনে তিনটায় হঠাৎ ঠুসঠাস শব্দ। হেফাজতের কর্মীদের লক্ষ্য করে স্বল্প শব্দের কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ছে র্যাব-পুলিশ। কিন্তু বিধি বাম। বাতাসে গ্যাস উল্টো নিজেদের দিকে চলে আসে। পেছনের দিকে সরে আসেন সবাই।
এরপর সাত-আট মিনিট বিরতি।
তিনটা বাজতে না-বাজতেই শুরু হয় মুহুর্মুহু কাঁদানে গ্যাসের শেল আর সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া। একের পর এক রাবার বুলেট আর গুলি। বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে চারদিক। যেন যুদ্ধক্ষেত্র।
প্রথম ১০ মিনিটের মাথায় হেফাজতের কর্মীরা নিজেদের অবস্থান ছেড়ে দ্রুত চলে যেতে থাকেন। কেউ যান সোনালী ব্যাংকের ভেতরে, কেউ পাশের অন্য ভবনে, কেউ বা অলিগলিতে।
শাপলা চত্বর এলাকা তখন বড়ই অচেনা। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য লাঠি, জুতা, ব্যাগ, খাবারের প্যাকেট, চিড়া, মুড়ি, কাপড়সহ বিভিন্ন জিনিস। সোনালী ব্যাংকের সামনে একটি প্রাইভেট কার, কাচ ভাঙা, কিছুটা দোমড়ানো-মোচড়ানো।
মূল মঞ্চের দিকে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে চার যুবকের লাশ। দিনের সহিংসতায় নিহত চারজনের লাশ এনে মঞ্চের কাছে রাখা হয়েছে। এই চারটি মৃতদেহ ছাড়া আমরা আর কোনো মরদেহ দেখিনি। তবে পরে জেনেছি, ওই দিন মোট ২২ জন নিহত হন।
ভোরের দিকে এগোতে থাকে রাত।
বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেওয়া হেফাজতের কর্মীদের একে একে বের করে আনা হয়। নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের বলেন, ‘নিরাপদে বাড়ি চলে যান। ’ একপর্যায়ে শূন্য হয়ে যায় শাপলা চত্বর। বাড়ি ফিরে আসি আমরাও।
ততক্ষণে ভোরের আলো উঁকি দিচ্ছে।
বেরিয়ে আসছে নতুন দিনের সূর্য।
কামরুল হাসান: বিশেষ প্রতিনিধি
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।