আমি দুরন্ত দুর্বার, আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার। আমি অনন্ত উর্বর, আমি কালের হস্তে করি উষরকে সবুজ প্রান্তর। আমি মুক্ত, আমি উচ্ছ্বল, আমি তারুণ্য, কারণ- আমি যে দুরন্ত।
সেদিন আকাশে মেঘ ছিল। হালকা বাতাস, বাতাসে ভেঁজা মাটির আঁশটে গন্ধ।
চারদিকটায় কেমন যেন একটা স্যাঁতসেতে ভাব। অফিস থেকে মাত্র বের হয়েছে আরাফ। একটি বেসরকারী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। নতুন বদলি হয়েছে। জায়গাটা নতুন।
অনেক কিছুই অচেনা। আস্তে আস্তে চেনা হয়ে যাবে। এ নিয়ে তেমন একটা মাথা ব্যাথা নেই। যেখানটায় সে দাড়িয়ে, ফুটপাতটা যথেষ্ঠ প্রসস্থ, আরাফের ঠিক গা ঘেষে শুয়ে আছে একটা কুকুর। প্রতিদিনই দেখে কুকুরটাকে, এমনই করে।
কতক্ষণ কুঁই কু্ঁই করবে আর চারপাশটা ঘুরবে। আরাফ যখন একটা বিস্কুট বের করে দেবে, আয়েশ করে খাবে, খাওয়া শেষে একটু গড়াগড়ি। একটা রিক্সা খুজছে সে। পার্কে যাবে। মন চাইছেনা, প্রচন্ড ক্লান্ত আজ।
হেডঅফিসে একটা ফলোআপ পাঠাতে হয়েছে। সব দায়িত্ব তারই ছিল, নতুন অফিসার সে তাই না করতে পারেনি, করেই দিতে হল কাজটা। ম্যানেজার সাহেব একটা ধন্যবাদও দিলেন। তাতে কি?
এই রিক্সা, এই যে ভাই যাবেন?
কোথায়?
ঠিক তার মতই বেরসিক গলায় জবাব দিলেন রিক্সাওয়ালা। সামনের পার্কে।
যাব বিশ টাকা দিবেন?
বাক্য ব্যয় করল আরাফ উঠে পরল রিক্সায়। অন্য সময় হলে রিক্সাওয়ালাকে একটা ধমক দিত। এটা তার টেকনিক। নতুন যায়গায় ধমক বেশ কাজে দেয়। মনে করে এই এলাকার অনেক পুরাতন বাসিন্দা, ফলে অনেক সময় ভাড়া পাঁচ-দশ টাকা কমেও যায়।
আজ ভাল লাগছেনা। ফেইসবুকে নতুন পরিচয় মেয়েটির সাথে, দেখা করার কথা আজ। ফেইসবুকে তার অনেক মেয়ে বন্ধু আছে। দু-চারজনের সাথে আবার ঘনিষ্ঠ সর্ম্পক। মাঝে মাঝে দেখাও করতে যেতে হয়।
ভালই উপভোগ করে আরফান সময়টুকু। আজ ভাল লাগছেনা। প্রথম দেখা বলে যেতেই হচ্ছে, নইলে আবার ইম্প্রেশনটা থাকবেনা। বেলা সাড়ে পাঁচটায় দেখা করার কথা। সেই বাধ্য করেছে মেয়েটাকে, অনেক কসরত করতে হয়েছে আরাফকে।
মেয়েটি প্রথমে রাজি হয়নি। সে পাকা খেলোয়ার। কৌশল জানে, তাই পটিয়ে ফেলেছি। সময় প্রায় হয়ে গেছে। আরাফই আগে উপস্থিত হতে চায়।
কথায় আছে না First impression is the last impression. ভাড়া মিটিয়ে পার্কে ঢুকে, এদিক সেদিক তাকায়। যেখানটাতে তাদের বসার কথা সেখানে তাকায়, কেউ নেই আশে পাশে। একজন ভিক্ষুক অলস ভঙ্গিতে বসে আছে পাশের একটা গাছে হেলান দিয়ে। বৃষ্টি হয়েছে। মানুষজন তাই একটু কম।
এমনেতে বসার যায়গাও পাওয়া যায়না।
মেয়েটি মনে হয় আজ আসবে না। কী যেন নাম?
মনে করার চেষ্টা করে। নামটা মনে থাকার কথা। একজন বিখ্যাত নারীর সাথে মিল আছে নামটার।
আরাফ মেয়েদের নাম মনে রাখার একটা কৌশল অনুসরণ করে। তার পরিচিত সকল মেয়েদের নামকে তার কোন না কোন পরিচিত জন বা কোন বিখ্যাত কারও নামের সাথে মিলিয়ে নেয়। ব্যাস আর ভুল হয়না। যদি কখনও এক মেয়ের সাথে ডেট করতে গিয়ে অন্য নাম মুখে এসে যায়, কি লজ্জাস্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে ভাবা যায়। যদিও তার এমনটি হয়নি।
হ্যাঁ মনে পরেছে। ইলা, তেভাগা আন্দোলনের নারী নেত্রী ইলা মিত্রের নামে নাম।
য়দিও ফেসবুকে অনেকে নিজের আসল নামটি ব্যবহার করে না।
ইলার আসার কথা সাড়েপাঁচটায়, এখন ছয়টা বাজে। আরেকটু পরে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
ইলা আসল কিনা? এখানেই আসার কথা।
বড় গলা করে বলে ফেলেছিল তুমাকে আমি ঠিকই চিনে নেব!
ইলাও তাকে মোবা্ইল নাম্বার দেয়নি, বলেছিল চিনে যখন নিতে পারবে তখন নাম্বার দিয়ে কী হবে?
গাঁধার মত একটা কাজ হয়ে গেছে। আত্মবিশ্বাসই আসল পুজিঁ ছিল তার। অপেক্ষমাণ তরুণী ও তার উৎসুক চাহনি সহজেই তার জন্য অপেক্ষমাণ তরুণীর পরিচয় ফাঁস করে দেয়। সহজ পদ্ধতি।
আর এতটুকু বাহাদুরিতেই দেখা করতে আসা তরুণীরা মুগ্ধ হয়ে যেত। আসলে মেয়েরা অল্পতেই মুগ্ধ হয়ে যায়। সহজেই বোকা বানানো যায় ভেবে সে মনে মনে একটু খুশিই হয়।
যদিও আজ সেই বোকা বনে গেছে। মেয়েটা তাকে ফাঁকি দিয়েছে।
নিশ্চই তার পুরানো কোন প্রেমিকার বান্ধবি, নতুবা কোন বন্ধু মজা করেছে তার সাথে। আর অপেক্ষার প্রয়োজন নেই, এমনেতেই অনেক সময় হয়েছে। বাসায় গিয়ে ফ্রেস হয়ে একটা ঘুম, উঠে ফেইসবুকে আবার চ্যাট। ফেইসবুকের এই একটা সুবিধা, এক সাথে অনেকের সাথে আড্ডা দেয়া যায়। হালকা মেজাজের একটা রোমান্টিক আবাহও তৈরি হয়।
ইলাকে আজই ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে বাদ দিতে হবে। উঠে দাড়ায় আরাফ, রাস্তার দিকে হাঁটা দেয়। পথে একটা জটলা। এক্সিডেন্ট হয়েছে। রিক্সাওয়ালা ব্যাথা পেয়েছে, তবে আরোহীর অবস্থা সংকটাপন্ন।
পাশের হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। রক্ত মনে হয় লাগবে। জটলা এরিয়ে এগিয়ে চলল আরাফ। বাড়তি ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে চায়না সে। এসবের জন্য একদল বোকা লোক সব সময়ই থাকে।
আজও দুচারজন জোটে যাবে। মেয়েটির চিকিৎসা তারাই করাবে। সুন্দরী মেয়ে হলেত কথাই নেই। সুস্থ হলে ন্যাঁকামী, প্রেমের চান্স নেয়ার চেষ্টা। এধরনের পুরুষদের আরাফ ভালই চেনে।
যতসব অসুস্থ মানুষে ভরে গেছে দেশটা। এ নিয়ে ভাববারই প্রয়োজনবোধ করেনা সে। সময় নষ্ট।
এক সাপ্তাহপর আবার আরাফের নতুন ডেটিং। এবার বন্ধের দিনে।
ইচ্ছে করেই। যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে তাতে। কথাবার্তাও বলা যাবে মেপেমেপে। মেয়েদের সাথে ঠান্ডা মাথায় প্রেমের আড্ডা জমে ভাল। খুব দ্রুতই পটানো যায়।
আজ কোন পার্কে নয়। একটি অভিজাত রেস্তোরায়। নিজেকে প্রকাশের কোন ত্রুটিই রাখেনি সে। মেয়েটির সম্পর্কে আগেই খোঁজ নিয়েছে। যথেষ্ঠ সুন্দরী।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। তবে নামটা জানতে পারেনি।
মেয়েটি এসেছে, আরাফেরও পছন্দ হয়েছে। দারুন, জমবে ভাল, মনে মনে ভাবছে সে।
মেয়েটিই প্রথমে মুখ খুলল।
আমার নাম নীলা ফারজানা। নামটা যেন কেমন চেনাচেনা ঠেকে!
আরে ওইযে গত ডেটিং-এ যে মেয়েটার আসার কথা ছিল, তার নামের সাথে দারুন মিল।
ইলা, নীলা্। বোন নয়ত? নিজের রসিকতায় নিজেই মজা পায়।
আমি আরাফ, আরাফ হাসান।
জানি আপনার নাম পরিচয় সবই জানি। আপনি ব্যাংকার, তাইনা?
অবাক হওয়ার ভান করে সে। ফেসবুক প্রোফাইলেই তার সম্পর্কিত সব তথ্যই দেয়া আছে। কথার এক ফাঁকে ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার দিয়ে নেয়। সব খাবারই মেয়েটির পছন্দের।
রুচি আছে মনে মেন প্রশংসা করে আরাফ। কথা প্রসংগে অনেক কথায়ই হয়। বন্ধুবান্ধব, চাকরী, বাড়ীর ঠিকানা সবই। কথা এগোয়-
এখনো কি সিঙ্গেল?
হ্যাঁ, আপনার মত কেউ এখনও মনের দরজায় কড়া নারেনিত তাই।
মেয়েটিও হেসে রসিকতার জবাব দেয়।
আড্ডা ভালই জমে উঠে। বেশির ভাগই হালকা মেজাজের রোমান্টিক কথা। প্রথম ডেটিংএ এরকমই কথাবার্তাই বলতে হয়। আস্তে আস্তে নাম্বার বিতরন, ঘনিষ্টতা, অতপর…..
কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে নীলার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবি গত সাপ্তাহে মারা গেছে। একটি ছেলের সাথে দেখা করতে এসে এক্সিডেন্ট করে, হাসপাতালে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে মারা যায় বান্ধবীটি।
ধক করে উঠে আরাফের বুক।
কী নাম তার? ইলা। বুকের ভিতরটা আরাফের মোচর দিয়ে উঠে। ভয় পেয়ে যায় সে। যদি ধরা পরে যায়।
কথা বলতে চেষ্টা করে। কেমন যেন গুলিয়ে উঠছে সব কিছু। অপরাধ যেন তার সর্বাঙ্গ গ্রাস করছে। কথা জড়িয়ে আসছে। বুকের ভেতর যেন একটা চাপা কষ্ট অনুভব করতে থাকে সে।
যানে না কেন?
মুখ খুলে সে। কেন সময় মত রক্ত দেয়া যায়নি?
না, আমরা পৌছাতে পৌছাতে অনেক দেড়ি হয়ে গিয়েছিল। কেউই দায়িত্ব নিয়ে রক্তদানের ব্যবস্থা করেনি। সবাই জেন কেমন দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চায়। মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ আজ প্রায় শূণ্যের কোঠায়।
রক্তের কী গ্রুপ ছিল?
এ+(পজেটিভ)।
আরাফের রক্তের গ্রুপওত এ+(পজেটিভ)। তার সাথে দেখা করতে এসে ইলা মারা গেছে। সেদিন পালিয়ে নাগেলে আজ হয়ত ইলা বেঁচে থাকত। কল্পনাও করেনি সেদিনের এক্সিডেন্ট-এর অভাগা মেয়েটি ইলা।
যারই এক্সিডেন্ট হউক, মানবিক দায়িত্ব থেকেই আরাফের থাকার প্রয়োজন ছিল। মেয়েটিকে হাসপাতালে নেয়ার সময় সঙ্গে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল আর সে কিনা পালিয়ে গেল।
কাপুরুষ। ছিঃ।
নিজের উপর ঘৃণা আসে তার।
বুকফাটা্ কান্না যেন ডুকরে বেরিয়ে আসতে চায় ভিতর থেকে।
আর একদন্ডও বসে থাকতে পারেনা সে। ছুটে বাইরে বেড়িয়ে আসে। নীলাকে সে চোখের পানি দেখাতে চায়না। সে যে অপরাধী।
নিজের অজান্তেই যে এক পশুকে সে লালন করে আসছে মনে মনে। এতদিন যে পশু বাস করে আসছে গোপনে আজ তার অস্তিত্ব ধরা পরেছে। মনের পশুটা সে যেন আজ এক ঝটকায় মেরে ফেলতে চাইছে। আর কথা বাড়ায়না আরাফ। বিল মিটিয়ে নীলাকে নিয়ে উঠে পরে।
একটি রিক্সা করে দেয় নীলাকে। আকাশে মেঘ করেছে যেকোন সময় বৃষ্টি আসতে পারে। নিজের দুই চোখে হালকা জ্বালা অনুভব করে। বাঁধ ভাঙ্গা এক বুক কষ্ট যেন বের হয়ে আসতে চাইছে বুকের ভিতর থেকে। চিৎকার করে সেই জ্বালা মিটাতে ইচ্ছে করছে।
আজ যেন সে শুদ্ধ নতুন এক মানুষ। দুচোখ বেয়ে নোনা জলের ধারা নেমে আসে। সেই ধারা কারও চোখে পরুক তা যেন আকাশ চায়না। মাটিতে পড়ার আগেই বৃষ্টির জল ধুয়ে নিয়ে যায় লোনা কষ্টগুলো। আজ জমাট বাঁধা সব কষ্ট যেন আকাশের কান্না হয়ে ঝরে পরছে।
অঝোর ধারায়, নোনাজলের ধারা হারিয়ে যাচ্ছে জলে জলে মিতালি করে। সেই সাথে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে আরাফের অন্তরে লুকিয়ে থাকা সকল নোংরা-আবর্জনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।