আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘জাতীয় মাথাব্যথার কারণ’ হতে পারে

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার-প্রক্রিয়া ও রায় সম্পর্কে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রধান নাভি পিল্লাই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেওয়ার পর বিষয়টির স্পর্শকাতরতা অনেকটাই বেড়ে গেছে।

এ ছাড়া রায় ঘোষণার পর সময়মতো তার অনুলিপি না পাওয়াসহ কিছু অব্যবস্থাপনা বিষয়টিকে আরও বেশি আলোচনার সামনে নিয়ে এসেছে। এ বিষয়গুলো যথাযথভাবে পর্যালোচনা করে দেখা না হলে তা ভবিষ্যতে ‘জাতীয় মাথাব্যথার কারণ’ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান।

তবে সরকারের কোনো মন্ত্রী বা কর্মকর্তা জাতিসংঘ হাইকমিশনারের বিবৃতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের কাছে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কার্যত বিষয়টি এড়িয়ে যান।

প্রথম আলোকে তিনি বলেন, জাতিসংঘ হাইকমিশনারের সম্পূর্ণ বিবৃতিটি না পড়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। বিবৃতিটি তাঁর কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি বলেন, ‘রোববার মন্ত্রণালয়ে পাঠান। তারপর দেখে মন্তব্য করব। ’

অবশ্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নাভি পিল্লাইয়ের বিবৃতিটি তাদের হাতে আছে। সেটি নিয়ে গতকাল তারা আলোচনাও করেছে।

তবে এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় বা সরকারের অবস্থান কী হবে, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

সরকারের উচ্চপর্যায়ে আরও কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলে তাঁরাও বিষয়টি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমনকি এ বিষয়ে জানতে চাওয়ার পর তাঁরা যে মন্তব্য করতে রাজি হননি, সে কথাও তাঁদের নাম উল্লেখ করে প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।

গতকাল যোগাযোগ করা হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার যখন নিজেই বিবৃতি দিয়েছেন, তখন তা হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেটি অবশ্যই গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।

মিজানুর রহমান বলেন, একসঙ্গে এত লোকের বিচার অবশ্যই একটি জটিল ব্যাপার। তার ওপর এর সঙ্গে জড়িত আছে বিরাট এক আবেগ। একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর বিরুদ্ধে এ হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। এসব কারণে বিচার-প্রক্রিয়ায় কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকতে পারে। সেই ত্রুটি থাকলে নিরপরাধ ব্যক্তি যেমন শাস্তি পেতে পারেন, তেমনি উচ্চ আদালতে আপিল করে প্রকৃত অপরাধীও ছাড়া পেতে পারেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, বিচার চলাকালে মানবাধিকার কমিশনের কাছেও পদ্ধতিগত ত্রুটির কিছু অভিযোগ অনেকবার এসেছে। কিন্তু কমিশন এসব অভিযোগের সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করেনি। তবে অভিযোগগুলো থেকে মনে হয়, হয়তো বিচারকাজে কিছুটা তাড়াহুড়ো করা হয়েছে। সে কারণে অনেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের যথাযথ সুযোগ না-ও পেতে পারেন। এ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখা না হলে বিষয়টি ভবিষ্যতেও জাতীয় পর্যায়ে মাথাব্যথার কারণ হয়ে থাকতে পারে।

৫ নভেম্বর পিলখানা হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হয়। পরদিন বুধবার জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের প্রধান এক বিবৃতিতে পুনর্বিচার ছাড়া ওই রায় কার্যকর না করার আহ্বান জানান। বিবৃতিতে তিনি গণবিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে প্রত্যেক অভিযুক্ত ব্যক্তির মামলা আলাদাভাবে পর্যালোচনার দাবি জানান। এ ছাড়া বিচার চলাকালে বন্দীদের ওপর নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনারও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেন তিনি।

এ ছাড়া রায় ঘোষণার দিন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে রায়কে ন্যায়বিচারের বিচ্যুতি বলে অভিহিত করে বলেছে, ১৫২ অভিযুক্তের ফাঁসির আদেশ আরেকটি অবিচার।

এই অবিচার আরও অনেক লোকের দুর্ভোগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ হবে।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের নামে পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে ঘটেছিল এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড। ওই ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। এই হত্যা মামলায় বিডিআরের জওয়ান ও কর্মকর্তাসহ ৮৪৬ জনকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। আসামির সংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হত্যা মামলা।

এই মামলার রায়ে তৎকালীন বিডিআরের ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দিয়েছেন আদালত। ১৬১ জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে আরও ২৫৬ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়েছেন ২৭৭ জন।

জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে এবং প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের সাজা দিতে হবে।

বাংলাদেশ ২০০০ সালের নির্যাতনবিরোধী জাতিসংঘ সনদ অনুস্বাক্ষর করেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আওতার মধ্যে পড়ে এমন যেকোনো স্থানে নির্যাতনের ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর আইনগত, প্রশাসনিক, বিচারিক বা অন্য ধরনের ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ বাধ্য।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপপরিচালক পলি ট্রুসকট বলেন, রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিফলিত হয়নি। এ রায় বাস্তবায়িত হলে তা হবে আরও ১৫২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা।

ট্রুসকট বলেন, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির ওই দুই দিনের ঘটনা নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক। এতে বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

এটি বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ ওই ঘটনার একটি সুষ্ঠু বিচার চায়। কিন্তু এতগুলো মানুষের মৃত্যুদণ্ড শুধু দুর্ভোগই বাড়াবে। তিনি বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রায়টি হয়েছে নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। মৃত্যুদণ্ড হলো চূড়ান্ত নিষ্ঠুর, অমানবিক ও মানহানিকর শাস্তি। এটি অপরাধের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে বলে প্রমাণিত হয় না।

পিলখানা হত্যাকাণ্ড মামলার রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সন্তোষ প্রকাশ করলেও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, এটি একটি গোঁজামিলের রায়। রায়ে যাঁদের খালাস দেওয়া হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ছিল, সেসব অভিযোগ ফাঁসির আদেশ পাওয়া অনেক আসামির বিরুদ্ধেও ছিল। ফাঁসির দণ্ড পাওয়া অনেক আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র একজন করে। এই রায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।



সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.