আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাবার সামনেই চলে গেল মনির

হঠাৎ শুরু হলো ছটফটানি, হাত-পা ছোড়াছুড়ি। কিছুক্ষণ পর নিস্তেজ। স্বজনদের আর্তনাদ-চিৎকার। ছুটে এলেন চিকিৎসক। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানালেন, মনির হোসেন (১৫) আর নেই।


গত সোমবার হরতালের প্রথম দিনে গাজীপুরে রাস্তার পাশে পার্ক করা কাভার্ড ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেন হরতাল-সমর্থকেরা। ভেতরেই ছিল মনির। বাবা রমজান আলী একটু দূরে ছিলেন। আগুন দেখে ছুটে এসে চোখের সামনে ছেলেকে পুড়ে যেতে দেখলেন। গতকাল সেই রমজান আলীর চোখের সামনেই সব মায়া ছিন্ন করে চলে গেল মনির।

স্বভাবতই শোকে যেন পাথর হয়ে গেলেন তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে টানা তিন দিন চিকিৎসা চলেছে মনিরের। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর সোয়া চারটায় সে মারা যায়। হাসপাতালে উপস্থিত মনিরের গ্রামের বাড়ি গাজীপুর কালিয়াকৈর উপজেলার চাপাইর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ রকম নিষ্পাপ কিশোরের এমন মৃত্যু নেওয়া যায় না। ’
মনিরের মৃত্যুসংবাদ গ্রামের বাড়ি পৌঁছলে একেবারে পাগলপ্রায় হয়ে যান মা মনোয়ারা বেগম।

বিলাপ করতে করতে তিনি বলছিলেন, ‘হরতাল আমার পোলারে মাইরা ফালাইছে। ’
হরতালের আগুনে’ পুড়ে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন আরও সাতজন। মনিরের মৃত্যুর খবর সেই আহত ও তাঁদের স্বজনদের আরও মুষড়ে দিয়েছে।
গতকাল বেলা তিনটার দিকে মনিরের লাশ বাড়িতে পৌঁছলে গ্রামের শত শত লোক ছুটে যান। মনিরের মায়ের কান্না তাঁদের আলোড়িত করে।

‘আমার পোলারে ফিরাইয়া দেন। আমার পোলারে যারা মারছে, তাগো আমি বিচার চাই’—বলে বিলাপ করছিলেন মনোয়ারা। বিচার চাইলেন উপস্থিত প্রতিবেশীরাও।
কাজের কারণে বাসায় তেমন সময় দিতে না পারায় গত শনিবার বাসা থেকে মনিরকে নিয়ে এসেছিলেন রমজান আলী। শনি ও রোববার কাভার্ড ভ্যানে করে তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে ছেলে।

সোমবার রাজধানীর সোয়ারীঘাট থেকে তাঁরা যান গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তায়। পার্ক করে গাড়ি থেকে নেমে আসেন বাবা। ভেতরে ঘুমিয়ে ছিল মনির।
জয়দেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম কামরুজ্জামান জানান, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে জামায়াত-শিবিরের ১২ কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।


বার্ন ইউনিটে চিৎকার: গতকাল ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের দোতলায় উঠতেই শোনা গেল আর্তনাদ। ডান পাশের একটি কক্ষে গিয়ে দেখা মিলল ছোট্ট শিশু মোছাম্মৎ সুমির। মুখের কয়েক জায়গায় চামড়া নেই। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ। কাঁপছে।

গোঙাচ্ছে। আর বলছে ‘জ্বলতাছে, জ্বলতাছে। ’
হরতালের আগের দিন গত রোববার নেত্রকোনা থেকে দাদি রহিমা বেগমের সঙ্গে উত্তরায় ফুফুর বাসায় যাওয়ার সময় জয়দেবপুর চৌরাস্তায় হরতাল-সমর্থকেরা তাঁদের বাসে আগুন ধরিয়ে দেন। সেখানেই পুড়ে যান দাদি-নাতনি।
সুমির বিপরীত পাশের একটি বেডে শুয়ে আছেন দাদি রহিমা।

শরীর কাঁথায় ঢাকা। রহিমার মেয়ে রাবেয়া জানালেন, গতকাল দুজনকেই পুরোনো ব্যান্ডেজ খুলে নতুন ব্যান্ডেজ দেওয়া হয়েছে। পচে যাওয়া চামড়া কেটে ফেলার সময় দুজনই খুব চিৎকার, কান্নাকাটি করেছে। এখন মুখে মাছি বসে বলে মুখের ওপর কাপড় দেওয়া হয়েছে।
সুমি ও রহিমা যে কক্ষে, তার উল্টো পাশের কক্ষেও মাছির উপদ্রব।

মুখে কাপড় দিয়ে শুয়ে ছিলেন লেগুনাচালক আল আমীন। গত সোমবার সন্ধ্যায় আজিমপুরে যাত্রীবেশে উঠে দুই যুবক তাঁর লেগুনায় আগুন ধরিয়ে দেন।
পাশের বেডে ঘুমাচ্ছেন রোববার রাতে গাজীপুরে হরতালের সমর্থনকারীদের দেওয়া আগুনে দগ্ধ হওয়া কাভার্ড ভ্যানচালক রোকনুজ্জামান। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ। পুড়ে কালো হয়ে গেছে মুখ।


এ দুজনের স্বজনেরা জানালেন, যন্ত্রণা করে। হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে। তবে চিকিৎসকেরা বলেছেন, ঝুঁকি নেই। ক্ষত সারাতে সময় লাগবে।
বাবা হাসু আহমেদকে কখনো এই অবস্থায় দেখেনি ছোট্ট ইমন হোসেন।

বাবার দগ্ধ মুখের দিকে তাই বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে সে। আগুনে বাবা হাসুর পুরো শরীর তো পুড়েছে, পুড়ে বীভৎস হয়ে গেছে মাথা-মুখ। রোববার রাতে সাভারের ক্যান্টনমেন্ট-সংলগ্ন এলাকায় পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন তিনি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক আসাদুল গাজী। ওই বোমায় পোড়া হাসুর সহকর্মী মোস্তাফিজুর রহমান আগেই মারা গেছেন।

হাসু প্রথম আলোকে বললেন, ‘শরীর জ্বলে।

মাথা ঘুরায়। ঘটনার কথা মনে পড়লেই আরও বাইড়া যায়। ’ আশার কথা, হাসু এখন কিছুটা আশঙ্কামুক্ত।

তবে আশঙ্কামুক্ত নন সিএনজিচালক আসাদুল গাজী ও পোশাককর্মী নাসিমা বেগম। তাঁদের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।

গত ২৬ অক্টোবর হরতালের আগের দিন মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে বাসে আগুন দেওয়া হলে দগ্ধ হন নাসিমা। নাসিমা এখন কথা বলতে পারলেও আসাদুল পারছেন না। মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় ছটফট করেন। বার্ন ইউনিটের এক চিকিৎসক জানালেন, আসাদুলের অবস্থা ভালো নয়।

গতকাল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন গত ২৭ অক্টোবর শাহজাহানপুরে পেট্রলবোমায় দগ্ধ সিএনজিচালক আইয়ুব আলী।

তবে মুক্তি মিলছে না দুশ্চিন্তা আর শারীরিক যন্ত্রণা থেকে। তিন সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে তাঁর সংসার। সিএনজির চাকা ঘুরলেই চলে সংসার। সিএনজি পুড়ে গেছে। ছয় মাসের বিশ্রাম নিতে বলেছেন চিকিৎসক।

শরীরে এখনো ব্যান্ডেজ, ব্যথা, যন্ত্রণা। ফোনে যোগাযোগ করা হলে বললেন, ‘ভাই, আগুন শুধু আমারে না, আমার সংসারডারেও জ্বালাইয়া দিল। ’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, এর আগের হরতালের তিন দিনে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণে সাংবাদিকসহ অন্তত ২২ জন আহত হয়েছিলেন। গত রোববার থেকে গত বুধবার পর্যন্ত রাজধানীর ও রাজধানীর বাইরে একই ধরনের অরাজকতায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১৩ জন। মোট ৩৫ জনের মধ্যে মনির ও মোস্তাফিজ মারা যান।

এখনো সাতজন বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন। বাকিরা বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে গেছেন।

হাসপাতালে আওয়ামী লীগের নেতারা: হরতালে আহত ব্যক্তিদের দেখতে গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল। তাঁরা আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন এবং আর্থিক সহায়তা দেন।
প্রতিনিধিদলে ছিলেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক বদিউজ্জামান ভূঁইয়া, উপ-প্রচার সম্পাদক অসিম কুমার উকিল প্রমুখ।

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.