অন্ধদের শহরে আয়না বিক্রি করি আমি। বিশ্বাস-একদিন চোখ খুলে দেব- অন্ধদের ও। দেখতে বাধ্য করবো....নিজেকে!
২০০৮ সালের এক গুমোট দুপুর। কলা ভবনের চারতলার শ্রীহীন এক ক্লাসরুমে বসে আছি। মাত্র তিন দিন আগে *** দাদা নামক এক অদ্ভুত প্রজাতির অকারন দুর্ব্যবহার সহ্য করে অবশেষে মার্কেটিং থেকে ইংলিশ-এ মাইগ্রেশন শেষ করেছি।
সাথে সাথে শেষ করেছি আরও অনেক কিছু- নিশ্চিত সুন্দর ভবিষ্যৎ এর স্বপ্ন, সেশনজ্যাম-হীন গ্রাজুয়েশান এর স্বপ্ন।
আব্বু ভীষণ বিরক্ত এই ডিসিশানে। আমিও কিঞ্চিৎ হতাশ। যে ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট এর এত নাম-ডাক শুনে (এবং পড়ে) এতবড় রিস্ক নিলাম, এই দীনহীন ডিপার্টমেন্টের সাথে কিছুতেই সেটা মেলাতে পারছিলাম না। স্বপ্নভঙ্গের একবুক হতাশা নিয়ে কলাভবন নামক পাঁচতলা এক আস্তাবলে ঘুরে বেড়াই প্রতিদিন।
গ্রীষ্মের সেই গুমোট দুপুরে চারতলার নোংরা ক্লাসরুমটাতে ক্লাস নিতে ঢুকলেন কালোমতন এলোমেলো বাবরি চুল-ওয়ালা এক অধ্যাপক। প্রথম দর্শনে তাঁকে ফকির আলমগিরের বড় ভাই হিসেবে চালিয়ে দেয়া যাবে। উনি নাকি আবার ডিপার্টমেন্ট-এর চেয়ার। খোন্দকার আশরাফ হোসেন। ডিপার্টমেন্টের চেয়ার বলেই বোধহয় উনি কাঠের চেয়ার-এ বসলেন না।
বসলেন চেয়ার এর হাতলের উপর।
প্রথমে কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা। তারপর শুরু করলেন T.S. Eliot এর The Love Song of J Alfred Prufrok। পরের একটা ঘণ্টা উনি যা করলেন সোজা বাংলায় তাকে বলে কেয়ামত।
প্রথম-বর্ষের এক সদ্য কৈশর পেরোনো বালকের সামনে উনি খুলে ধরলেন সাহিত্যের এক রাংতামোড়া বায়োস্কোপ।
আমার সমগ্র সত্তা অসাড় হয়ে আসলো, সমস্ত জগৎ নিস্তব্দ্ধ। কবিতা তাহলে এভাবে বুঝতে হয়? হৃদয়ের অলিন্দ-নিলয়ে ঝড় তোলা এই মাতাল অনুভূতির আরেক নামই কি সাহিত্য? কি আশ্চর্য!
আমি যেনো আমার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে অনুভব করলাম রোগা, টেকো, হতাশ প্রুফ্রকের হৃদয়ের ক্ষরণ। মুহূর্তের জন্য বিভ্রম হলো- আমিই কি প্রুফ্রক? সে কি পক্ষান্তরে আমার কথাই বলছে না? আচ্ছা, শতশত মাইল দূরের সেই কবি কিভাবে জানলেন আমার একান্ত নিজস্ব সব গহন-কথা? জীবনের সাথে সাহিত্য তাহলে এভাবে জড়িয়ে যায়?
কলাভবনে একটার সময় কারেন্ট চলে যায়। স্যার ক্লাস শেষ করলেন দেড়টায়। তখন প্রথমবারের মত অনুভব করলাম ঘেমে গোসল করে ফেলেছি।
আমি হুমায়ন রশিদ অসম্ভব অহংকার নিয়ে সবসময় বলি- এক জীবনে বহু সুন্দর কথা আমি শুনেছি। মানুষের কথা আমাকে আর মুগ্ধ করে না। আমার সেই অহংকার দুমড়ে-মুচড়ে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন আশরাফ স্যার। মাত্র ৪০ মিনিটের একটা ক্লাসে।
জীবনে যতবার মনে হয়েছে সাহিত্য পড়তে আসাটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো, আমি ততবার ফিরে গিয়েছি ২০০৮ সালের সেই দম-বন্ধ-করা মধ্যাহ্নে।
ঠিক ততবার, বিশ্বাস করুন স্যার, ঠিক ততবার পেয়েছি জীবন চালানোর শক্তি। আমার চরম হতাশার দিনে আপনি যে কি পথের সন্ধান আমাকে দিয়েছিলেন, আমি কোনোদিনই আপনাকে তা জানাতে পারিনি।
আশরাফ স্যার, প্রিয় কবি, আপনি না সব সময় Frost এর এই লাইনগুলো আবৃত্তি করতেন-
“The wood is lovely, dark and deep
But I have promises to keep
And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep”
তাহলে আপনি কেমন করে ভুলে গেলেন আমাদের দেয়া আপনার প্রমিসগুলো? একবারও ভাবলেন না আপনার আলফু সরদারের কি হবে? সে কি এখনও “মাগ্রেবের অক্তে” তাঁর জীবনটা মেপে বেড়াবে “বুরহানির গিলাস দিয়া”?
আর আমরা? তারাভরা মাতোয়ালী রাতগুলোতে কে আমাদের শুনাবে “তিন রমণীর ক্বাসিদা”? করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে আর কি কখনও উঁকি দেয়া হবে ২০৭৯ রুমটায়?
কবিতার যে অসহ্য সুন্দর জগতে আপনি আমাদের নিয়ে এসেছিলেন হ্যামেলিনের সেই বাঁশিওলার মতো- সেই জগৎ থেকে কেন আপনিই হঠাৎ করে হারিয়ে যাবেন এভাবে?
আপনার না আরও দূর যাবার কথা ছিল?
...ঘুমোবার আগে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।