আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেক্যুলার রাজনীতির ভবিষ্যৎ



“বাংলাদেশ” অনিবার্য এটা যারা সেদিন অনুধাবন করেছিল তারা সবাই “বাংলাদেশের” পক্ষেই ছিল। “বাংলাদেশ” হবেই এ যেন বিধি লিখন, আজ হোক কাল হোক “বাংলাদেশ” হতোই। এই সত্য বা ভবিষ্যৎ যারা উপলব্ধি করতে পারেনি তারাই “বাংলাদেশের” বিরোধীতা করেছিল। তাই বলে “বাংলাদেশের” পক্ষে থাকা মানেই কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে থাকা নয়। যারা “বাংলাদেশ” চেয়েছিল তাদের মধ্যে ধরন নিয়ে ভিন্নতা ছিল।

জিয়াউর রহমান এবং কর্ণেল তাহের দুজনই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিন্তু তাদের “বাংলাদেশ” ভিন্ন হতে বাধ্য। এর প্রমাণ আমরা পাই জিয়াউর রহমান যখন ঘটনাচক্রে বাংলাদেশকে শাসন করার সুযোগ পেয়ে যায় তখন। তার সব কাজকেই “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” বিরোধী বলে প্রতিয়মান হয় এ জন্য। কেউ কেউ তাই তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে সন্দিহান হন। তাদের কাছে হিসেব মেলে না, কেমন করে খেতাবপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” বিরোধী কাজ করা সম্ভব হয়।

এটা বুঝা কিন্তু খুব সহজ। জিয়াউর রহমান এবং তার দল বিএনপি কেন আজকের চেহারা নিয়েছে সেটা বুঝা খুব কঠিন কিছু নয়। যদি আমরা পাকিদের আত্মসমর্পনের কথা মনে করি তাহলে দেখবো মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী অনুষ্ঠানে যোগ দেননি তার ভারত বিরোধী মনোভাবের জন্য। ভারতের কোন রকম ভূমিকা, খবরদারীকে তিনি সহ্য করতে রাজি ছিলেন না। এক্ষেত্রে বাস্তবতাকেও তিনি আমলে নেননি সম্ভবত।

১৬ ডিসেম্বর যদি পাকিদের আত্মসমর্পন না করানো যেতো তাহলে পাকিস্তান যে কোন উপায়ে জাতিসংঘ বা আমেরিকাকে ধরে “যুদ্ধ বিরতি” টাইপের কিছু করাতে পারলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঝুলে থাকতো অনিশ্চয়তার জালে। ওসমানীর পরবর্তীকালের রাজনীতির প্লাটফর্মকে বিবেচনা করলে তার ভারত বিরোধী অবস্থান বুঝতে বেগ পেতে হয় না। ১৪ ডিসেম্বর যাদের নিধন করা হয়, রাজাকার, আল বদররা যাদের লিস্ট করে হত্যা করে তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস, রাষ্ট্র চিন্তা, ধর্ম চিন্তা বিশ্লেষণ করলে বুঝা যাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে কি। ধরা যাক আজকের ফরহাদ মজহারের মত বুদ্ধিজীবীরা যদি বাংলাদেশ চাইত সেই সময়, তাহলে নিশ্চয় এটা বলা কষ্টকর হবে না যে, কেমন বাংলাদেশ চাইত তারা। ঘাতকের ছুরির নিচে যাদের গলা পেতে দিতে হয়েছে তাদের রাজনৈতিক চেতনার কথা মাথায় রেখে নতুন রাষ্ট্রকে নিয়ে তাদের স্বপ্ন কল্পনা করতে অসুবিধা হয় না।

তাই ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী নিধন অনেক ভেবেচিন্তে সুদূরপ্রসারী ভাবনা থেকে করা। এ ব্যাপারে আমার এখন কোন সংশয় নেই। নেহাত আক্রশ থেকে এই হত্যাযজ্ঞ হয়নি। “বাংলাদেশ” হচ্ছেই এটা বুঝতে পেরেই তারা এটা করেছিল যাতে ভবিষ্যতে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” কখনো নতুন রাষ্ট্র “বাংলাদেশ” ধারন করতে না পারে। ঘাতকরা সফল হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

স্বাধীনতার পর পরই “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রবল “বুদ্ধিজীবী চাপ” প্রয়োজন ছিল তা হয়নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশ সামলাতে কঠিন অর্থনৈতিক বাঁধা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, পরাজিত শত্র“র ষড়যন্ত্র সামালাতে যখন ব্যস্ত “বাংলাদেশ” তখনই তার ভাগ্যে নেমে আসে ১৫ আগষ্ট। এরপর যা হয়েছে তা বাংলাদেশের চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। ৭৫-এর ১৫ আগষ্ট পর যারা ক্ষমতার চারপাশে ঘুরঘুর করেছে তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের সেই অংশ যারা “বাংলাদেশ” চেয়েছে কারণ বাংলাদেশ অনিবার্য কিন্তু সেটা ইসলামী ভাবধারা পাকিস্তানী ইস্টাইলের হতে হবে। সেটা হতে হবে ভারতের কোন রকম সাহায্য ছাড়া।

কর্ণেল তাহের সফল হলে কি হতো জানি না, তবে আজকের বাংলাদেশ হেফাজতী-জামাতী আর যত পীর আলেম ওলামার রাজনীতির মচ্ছব চলছে, তা এতদূর আসতো বলে বিশ্বাস হয় না। বাংলাদেশের যেখানে আওয়ামী লীগ ও বামদের মধ্যে দেশ চালানোর কথা ছিল সেখানে বিএনপি, জাতীয় পার্টির মত দল জন্মালো। সামরিক উর্দির তল থেকে এলো “বহুদলীয় গণতন্ত্র” যার পথ ধরে ইসলামী রাজনৈতিক দলের জন্ম। আসে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামাতে ইসলামীর মত দলের রাজনীতি করার অধিকার। বঙ্গবন্ধুকে অস্থির করে ফেলেছিল যারা (তখনকার রাজনৈতিক শক্তিগুলো) তারা তাঁকে (বঙ্গবন্ধুকে) অন্তত দশটা বছর সময় দেয়া উচিত ছিল।

আর সবার মত কি তারাও বঙ্গবন্ধুকে ভয় পেতো? বাঙালি তাঁকে ছাড়া আর কাউকে তাদের নেতা বানাবে না- এই চিন্তা তাদের ভবিষ্যত অন্ধকার মনে হতো? কি মনে হতো জানি না, তবে তাদের অতি তাড়াহুড়া যে এখানে অনিচ্ছাকৃত ভূমিকা রেখেছিল তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে বাংলাদেশের। বিএনপির মত দলের জন্ম হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে এদেশের একটা বড় অংশকে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হতে শিখিয়েছে। দেশের একটা বড় অংশকে তারা বুঝাতে সক্ষম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটা আওয়ামী লীগের নিজস্ব ব্যাপার, যেহেতু ওটা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অর্জন তাই বিএনপির তাতে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।

এমনকি মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্বদানকারী ইতিহাসের মহান নেতাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করাতে বিএনপির মত দলের জন্যই সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশও পুরোপুরি সেক্যুলার রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে আসে। ফলাফল কি হয়েছে? যে আওয়ামী লীগ একদিন তার নামের সঙ্গে যুক্ত “মুসলিম” শব্দটি কেটে ফেলে সেক্যুলার রাজনীতির পথে হেঁটে ছিল তারাই এখন গায়ে “মুসলিম” নির্যাস লাগাতে অতিমাত্রায় ব্যস্ত। এ হচ্ছে বিএনপির রাজনীতির কাছে মার খেয়ে আওয়ামী লীগের সেক্যুলারিজম ত্যাগ করার প্রথম প্রয়াস। আওয়ামী লীগ নেতারা কতটা ধর্মপ্রাণ সেই প্রচারণা চালাতে বলা হয়েছিল ৯১ সালে নির্বাচনে হেরে যাবার পর আওয়ামী লীগের থিঙ্কট্যাঙ্ক থেকে।

এত কিছুর পরও ২০১৩ সালের হেফাজতী উত্থান আওয়ামী লীগকে কতটা দিশেহারা করে তুলেছিল তার প্রমাণ তাদের “মদিনা সনদের” অনুকরণে দেশ শাসন করার বাজারী বুলি কপচানো থেকে বুঝা যায়। অতীতে ধর্মীয় দলের সঙ্গে চুক্তিতে সই করে দেশের সেক্যুলার রাজনীতির এখনো শেষ ভরসা (সেক্যুলার রাজনীতির সমর্থকরা নিরুপায় হয়ে আওয়ামী লীগকে এখনো সমর্থন করে যাচ্ছে) আওয়ামী লীগ দেশের মুক্তবুদ্ধির প্রগতিশীল অংশকে প্রচন্ড আঘাত করে। সেই সঙ্গে দেশের সেক্যুলার রাজনীতিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে এটা ছিল পরিস্কার সরে আসা। সেক্যুলার রাজনীতি তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তাহলে ভবিষ্যৎ কি? যদি আওয়ামী লীগকে সেক্যুলার রাজনীতির ধারক ধরি তাহলে এই দলের সমর্থকদের সেক্যুলার ধরতে হবে।

কিন্তু বাস্তব চিত্র কি বলে? সেক্যুলার রাজনীতি যে দেশে কোনদিনই চর্চা হয়নি সেখানে সেক্যুলারিজম কেমন করে জনগণের মধ্যে প্রসার লাভ করবে? এখানে তাই সাধারণভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে গুণগত পার্থক্য নেই। তাসলিমা নাসরিনের মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের বিএনপি জামাতীদের সঙ্গে কোন মতভেদ নেই। “নাস্তিক ব্লগার” শুধু হেফাজতের টার্গেট নয়, আওয়ামী লীগেরও চক্ষুশূল। সব মিলিয়ে সেক্যুলার রাজনৈতিক দল যেমন নেই, সেক্যুলার রাজনৈতিক দলের সমর্থকও সেই অর্থে নেই। তবু এখনো কাউকে কাউকে “ধর্মনিরপেক্ষবাদী অপবাদ” দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের খেলা চলছে এই ভোটের হাওয়ার বাংলাদেশে।

“আমরা সংখ্যালঘুদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন” এই বুলি কপচানো ইসলামী দল ও বিএনপি “ইসলামী সেক্যুলারিজম” নামের এক কাঁঠালের আমসত্ব বিদেশী দাতাদের খাওয়াতে সক্ষম হবে বলেই মনে হয়। অপরদিকে “সেক্যুলারিজমের অপবাদ” মাথায় নিয়ে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হবে ভিন্নমতালম্বি ইসলামী রাজনৈতিক নেতাদের উপর জেলজুলুমের অভিযোগ! আমরা দেখতে পাচ্ছি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নিউজ আসছে এই সুরে তাল মিলিয়ে। আমার শংকার জায়গাটা হচ্ছে, এই অভিযোগের বিশ্বাস করার মত জনমত দেশে এখন বেশি বৈ কম নেই। কারণ খোদ আওয়ামী লীগের সমর্থকরাই বিশ্বাস করে মতিঝিলে হেফাজতের সমাবেশে অত বেশি না হলেও অন্তত ১০০-১৫০ জন সেই রাতে মারা গিয়েছিল! শত হলেও তারা আলেম মানুষ, কাজটা পার্টি ভাল করেনি!.... কাজেই যত দিন যাবে আওয়ামী লীগ বিএনপির রাজনীতির প্রচারণার কাছে টিকে থাকতে তার অবশিষ্ট প্রগতিশীল চেহারা দ্রুত ত্যাগ করতে সচেষ্ট হবে। চরম দুর্ভাগ্য এটা আমাদের জন্য।

সামনে ইলেকশান, এই ভোটের মাতাল হাওয়ায় ইসলামিস্ট হওয়ার দৌড়ে কে কাকে হারান আর “ইসলামী সেক্যুরালিজমের কেক” কেটে কে কত বিলি করেন সেই “কমেডি শো” দেখার খুব বেশি দেরী বোধহয় আর নেই। তাই সেক্যুলারিজমের ভবিষ্যত ইলেকশানের শেষেই না হয় বলি...।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.