ছোটবেলায় কুকুর খুব ভয় পেত আবির। ভার্সিটিতে পড়ার সময় ও ভয়টি যায়নি। তবে এখন আর ও কুকুর ভয় পায় না। এই গলির চায়ের দোকানের পাশে বসে থাকা কুকুরটা ওর বেশ ভক্ত হয়ে গেছে। কুকুরটার মত দিনরাত এখানে বসে থাকাই ওর কাজ।
চায়ের দোকানটা বিখ্যাত পর্যায়ের। সারাদিন অনেক মানুষের আনাগোনা। দোকানদার রাসেল অবশ্য আবির এর উপর বিরক্ত না। আবির ভাইকে তার খুব পছন্দ, অনেক মজার মানুষ, দোকানের পুরনো কাস্টোমার। দোকান যখন নতুন,তখন আবির ভাই আসতেন।
নিশু আপাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে দোকানে এসে বসতেন। নিশু আপা আবির ভাই এর ভালবাসার মানুষ। দোকানে এসে যখন বসতেন আবির ভাই, আপুকে পৌঁছে দেবার পর তার তখন খুব মন খারাপ থাকতো। রাসেল কড়া লিকার এ চা বানিয়ে দিতো এক কাপ। আবির ভাই চা খেতেন আর ৫ তলার উপর নিশু আপার রুম এর দিকে তাকাতেন।
কিছুই দেখা যেত না, তবুও তাকিয়ে থাকতেন।
তিন বছর হলো নিশু আপার বিয়ে হয়ে গেছে। নিশু আপার বাবা এলাকার বিখ্যাত মানুষ, এলাকার সবাই দাওয়াত পেয়েছিল বিয়েতে। রাসেল অবশ্য বিয়েতে যায়নি। আবির ভাই এর জন্য ওর খুব মন খারাপ লেগেছিল, তাই।
তিন বছর পর আবার পুরাতন চায়ের দোকানে নিয়মিত আসছে আবির। কারণ, নিশু ওর বাবার বাড়িতে থাকবে কিছুদিন। ওর নাকি বেবি হবে। স্বভাবতই বাসার সবাই খুব খুশি। এই সময় মেয়েকে নিজের কাছে রাখতেই বেশী আগ্রহ নিশুর বাবা-মা’র।
নিশুকে দূর থেকে এক নজর দেখার আসায় বসে থাকে আবির।
বিয়ের পর আর নিশুর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি আবির। নিজের নম্বর চেঞ্জ করে ফেলেছে। যে চিরকালের জন্য চলে গেছে অন্যের বউ হয়ে, তার ফোনের অপেক্ষায় থাকার কোন মানে হয়না। তাছাড়া, বিবাহিত একটা মেয়ের জীবনে ওর কিই বা মূল্য থাকতে পারে!
গত ৫ দিনে এ পর্যন্ত নিশু ২ বার বাসা থেকে বের হয়েছে।
এর মধ্যে শুধু একবার ওকে পাশ থেকে দেখতে পেরেছে আবির। নিশুর হাসব্যান্ড এর কালো কাচ এ ঢাকা গাড়ির ভেতরকার নিশুর মুখটা আবিরের কাছে অদেখাই রয়ে যায়। এভাবেই চলতে থাকে দিন। আবির শত অপেক্ষা করেও নিশুর দেখা পায়নি কোনোদিন।
২১শে সেপ্টেম্বর নিশুর মেয়ে হয়।
মসজিদ এর মাইকে এই সুসংবাদ ঘোষণা করা হয়। এলাকার মানুষদের মিষ্টি খাওয়ানো হয়। সন্ধ্যায় আবির বাসায় ফিরে আসে। ছাদের রেলিং এ বসে চিন্তা করে চার বছর আগের কথা। চার বছর আগের এই দিনেই ও নিশুকে ভালবাসার কথা বলেছিল।
২৩শে সেপ্টেম্বর প্রথম বারের মত রক্তবমি হয় আবিরের, সারাদিন চলতেই থাকে। ২৬ তারিখ পর্যন্ত কাউকে জানায়নি ও, ভেবেছিল ঠিক হয়ে যাবে। ২৭ সেপ্টেম্বর ভোরে আবিরকে মেস এর ছেলেরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ২ দিনের মাঝেই ও জানতে পারে- ওর লিভার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কারন Hepatitis-B । সামনে সময় খুব কম।
হাসপাতালের বেড এ শুয়ে শুয়ে নিশুর কথা খুব মনে পড়ে আবিরের। ও বারবার বলত ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করতে। মাঝে মাঝে বলত, “তোমার চোখ এতো হলুদ কেন? ডাক্তার দেখাও তো জন্ডিস কিনা। ঠিকমত না খেয়ে খেয়েই তো এই অবস্থা বানিয়েছো.........”
নিশুর বিয়ে হয়ে যাবার পর এসব বলার কেউ ছিল না। তাই অনেক কিছুই করা হয়নি।
ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করা হয়নি, ভালো একটা চাকরী করা হয়নি, আরও কত কী...!!
৫ই অক্টোবর বাসায় ফিরে আসে আবির, কিছুটা জোর করেই। হাসপাতালের বিল দিতে গিয়েই জমানো সব টাকা শেষ হয়ে যায়। বাবা-মা বাড়তি টেনশন করবে ভেবে তাদের কিছু জানায়নি আবির। তবে এখন ও ঢাকা থেকে চলে যাবে, বাবা-মার কাছে ফিরে যাবে। যাবার আগে ও শেষ দেখা করে যাবে নিশুর সাথে।
৬ তারিখ সকাল ১১টায় আবির নিশুদের বাসায় যায়। দরজা খুলে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নিশুর মা। ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা যায়।
- ভালো আছেন আন্টি?
- ভালো। তা তুমি কী মনে করে এতদিন পর?
- এইতো আন্টি আসলাম।
নিশুর সঙ্গে একটু দেখা করতে আসলাম। ওর নাকি মেয়ে হয়েছে, বাবুটাকেও একটু দেখতে আসলাম।
- নিশু ঘুমাচ্ছে। দেখা করা সম্ভব না।
- প্লিজ আন্টি...
- দেখ বাবা, তোমার অনেক বয়স হয়েছে।
কেন বুঝতে পারছ না এতে নিশু কষ্ট পেতে পারে।
- আন্টি ওর বিয়ের পর তো কখনো আমি একটা ফোন ও করিনি, আপনাদের সামনেও আসিনি। এই শেষবারের মত একটু সুযোগ দিন।
আন্টি কিছুটা নরম হলেন। ঠিক সেই সময়ে কলিংবেল বেজে উঠল।
দরজা খুলে দিলেন আন্টি। নিশুর হাসব্যান্ড। শেষ আশাটাও শেষ হয়ে গেল!
- কে উনি? চিনলাম না।
- ও আবির। পাশের বিল্ডিং এ থাকে।
একটা কাজে আসছে। তুমি ভেতরে যাও।
নিশুর হাসব্যান্ডকে কোনোরকম ভেতরে পাঠালেন আন্টি।
- এবার বাবা, তুমি চলে যাও। আমার মেয়ের সংসার ভাঙার চেষ্টা করো না...
- না না আন্টি, সমস্যা নেই।
আমি বুঝতে পারছি। আল্লাহ্ ভাগ্যে রাখে নাই শেষ দেখাটা।
- আচ্ছা একটু বস তুমি। কিছু একটা খেয়ে যাও...
আবিরকে বসিয়ে রেখে ভেতরে গেলেন তিনি। নিশুর জন্য আবির একটা খামের ভেতর কিছু জিনিস নিয়ে এসেছিলো।
সাড়ে তিন বছর আগে যেরকম করত, সেভাবেই আবির খামটা ছোফার পাশের বেড’টার তোশক এর নীচে রেখে দিয়ে চুপচাপ বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
নিশু জানে আবির এসেছিলো। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ও মানুষটার সব কথাগুলো শুনেছে। আবির বের হবার কিছুক্ষন পরেই নিশুর হাসব্যান্ড ও আবার বেরিয়ে গেল। মেয়েকে ঘুম পড়িয়ে নিশু ড্রয়িং রুম এ আসে, সোফাটায় এসে বসে।
মানুষটা এখানে বসেছিল ও জানে। সোফায় হাত বুলিয়ে মানুষটার শরীরের উষ্ণতা খুজে পেতে চেষ্টা করে নিশু। ও ভেবে পায় না, কেন ওদের জীবনটা এরকম হয়ে গেল। কেন সব স্বপ্নগুলো ভেঙে গেল। খুব কান্না পেল ওর।
হঠাৎ ওর আগের কথাগুলো মনে পড়ল। আবির বাসায় বেড়াতে আসলে নিশুকে সবার সামনে কিছু না দিতে পারলে মাঝে মাঝেই একটা জায়গায় সেগুলো লুকিয়ে রাখতো যেন পরে নিশু এসে নিতে পারে। নিশু খাটের পাশে গেলো। তোশকটা উচু করেই ও মাঝারি সাইজের খামটা পেল। ভেতরে কিছু চকলেট, কয়েকটা চাকরীর Appointment Letter, আর একটা চিঠি পেল ও।
একে একে সবগুলো Appointment Letter খুলল ও। বি সি এস, বাংলাদেশ ব্যাংক, army, Dutch Bangla Bank, আর ও অনেক জব এর Appointment Letter সেখানে। চিঠিটা খুলল ও...
ঢংগীলা,
অনেকদিন পর তোমাকে এই নাম এ ডাকলাম। কেমন আছ তুমি? এ কয়টা বছর খোঁজ নেইনি বলে কি রাগ করেছো? কী করবো বল, তোমাকে ধরে রাখতে পারিনি বলে আর লজ্জায় সামনে আসতে পারলাম না। তাছাড়া, ততদিনে তুমি অন্য একজনের বউ হয়ে গেছ।
অপরাধটা আমারই। সময়মত একটা ভালো চাকরী যোগাড় করতে পারলামনা। তাই তো এতো দূরত্ব। আমি কিন্তু এরপর অনেক ভালো ভালো চাকরী পেয়েছি। Appointment Letter গুলো জমিয়ে রেখেছি, জয়েন করিনি।
হয়তো, আমার জায়গায় পরে অন্য কেউ সুযোগ পেয়েছে। হয়তো Appointment Letter পেয়ে সে তার প্রেয়সীকে আনন্দে জড়িয়ে ধরেছে বিয়ের জন্য সামনে আর কোন বাধা থাকল না বলে!
আমাদের ও তো এরকমই স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন পূরণ হলনা। অন্তত অন্যদের স্বপ্নগুলো পূরণ হোক। তুমি অবশ্য পারতে আমাদের স্বপ্নটা পূরণ করতে।
কিন্তু সমাজ হোক, বাবা-মা হোক, আর যে কোন কারনেই হোক- বিয়েতে রাজী হয়ে গেলে। থাক, তোমাকে আর দোষারোপ করবো না। যা হয়েছে, সবই ভাগ্য।
মাঝের এ কয়টা বছর আমি কি করেছি, হয়তো জানতে চাও। তুমি যেরকম নিজের জন্য চাইতে, ঠিক সেরকম করেই- সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছি।
আগে বুঝতে পারিনি, স্বপ্ন ভেঙে যাবার পর এখন বুঝি- স্বপ্নহীন মানুষগুলকে স্বপ্ন খুজে দেবার মত আনন্দের আর কিছু নেই।
আমার সারা জীবনে মাত্র দুটো স্বপ্ন ছিল- ভালোবাসা আর শান্তি। এ দুটোর খোঁজেই কাটিয়ে দিলাম একটা জীবন। খুঁজে পেয়েছি কি না, তা তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ বলতে পারবে না। আমি এখন জীবনের শেষ প্রান্তে।
শেষ বারের মত তোমাকে দেখতে এলাম। দেখা হয়েছে কি না জানিনা! তুমি ভালো থেকো। সুখী হবার চেষ্টা করো। প্রতিটা গল্পের মাঝেই আরও অনেক গল্প থাকে, স্বপ্নের মাঝে স্বপ্ন থাকে- এর মাঝে কিছু একটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থেকো আজীবন। অনেক ভালবাসতাম তোমাকে, এখনও ভালোবাসি।
আমাকে মনে রেখো। প্রতি বছর শুধু দুটো দিন আমার জন্য রেখো- আমার ভালবাসার কথাটা বলার দিনটা, ২১শে সেপ্টেম্বর আর তোমার ভালবাসার কথাটা বলার দিনটা, ২০শে অক্টোবর। এ দুটো দিন পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ দুটো দিন ছাড়া আর কোনোদিন আমার কথা মনে করবে না, মনে থাকবে? কখনো কাদবেনা, মনে থাকবে??
পুনর্জন্ম বলতে কিছু নেই জানি। তবে যদি কখনো পুনর্জন্ম হয়- আমি তোমাকেই ভালোবাসব।
তখন আর কখনো তোমাকে হারাতে দেবোনা। ভালো থেকো-
“Between the right and the wrong,
There is a garden.
And we will meet there…….”
ভালোবাসি...। ।
ইতি
তোমার আমি...
পুনশ্চঃ অলৌকিক ভাবে ২০শে অক্টোবর দুপুর ১২টা ৫১মিনিটে আবির ওপারে চলে যায়। এক গুচ্ছ বেলি ফুলের মালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে ও নিশুর অপেক্ষায়।
নিশুর মেয়ে ইমু অনেক বড় হয়। সে তার মায়ের একমাত্র কাছের মানুষ। প্রতিবছর ইমু দেখে ওর জন্মদিনে ওর মা খুব কাঁদে। আরও একটা দিন ওর মা খুব কাঁদে- ২০শে অক্টোবর। ইমু জানেনা কেনো।
গল্পের ভেতরের সব গল্পগুলো সবসময় জানা হয়না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।