আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফিরে দেখাঃ নজরুলের কিছু পরিচিত গান, পর্ব-৩

কি আর হবে অঙ্গে ধরে নকল রুপের বায়না.... ও রুপ দেখে চোখ ভোলে গো, মন ভোলানো যায় না

৩। মানুষের আবেগ অনুভূতির বোধগুলো প্রায় একই ধরণের হয়। কিন্তু সেই একই আবেগ যখন দখল করে কবি-হৃদয় তখন তার প্রকাশ হয়ে ওঠে অনিন্দ্যসুন্দর। যেমন, নজরুলের এই গানটি- যত ফুল তত ভুল কণ্টক জাগে মাটির পৃথিবী তাই এতো ভালো লাগে। ।

হেথা চাঁদে আছে কলঙ্ক, সাধে অবসাদ; হেথা প্রেমে আছে গুরু-গঞ্জনা অপবাদ; আছে মান অভিমান পীরিতি-সোহাগে। । হেথা হারাই হারাই ভয়, প্রিয়তমে তাই- বক্ষে জড়ায়ে কাঁদি, ছাড়িতে না চাই। স্বর্গের প্রেমে নাই বিরহ-অনল সুন্দর আঁখি আছে নাই আঁখিজল, রাঁধার অশ্রু নাই কুঙ্কুম-ফাগে। ।

প্রেম হতে পারে সৃষ্টিকর্তার প্রতি, হতে পারে সৃষ্টিকর্তার কোন অপরূপ সৃষ্টির প্রতি। তা যা’ই হোক না কেন, মানুষকে প্রেমে পড়তেই হয়। কেননা জীবনে প্রেম অনিবার্য। কিন্তু প্রেমের পথ কি ফুল বিছানো নাকি তা কণ্টকাকীর্ণ? প্রেমের পথ যদি ফুলেল না হয়ে কণ্টকময় হয় তবে কি প্রেম মানে শুধুই বেদনা? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রসঙ্গগত মনে পড়ে সুপ্রিয় গীতিকার ও সুরকার আবু জাফর এর লেখা ও সুকণ্ঠী গায়িকা ফরিদা পারভীনের গাওয়া একটি বিখ্যাত গান - নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে প্রেমের কি সাধ আছে বলো আঁধার না থাকে যদি কি হবে আলো? নিন্দার কাঁটা যদি হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত না’ই করলো তবে আর প্রেমে আনন্দ কিসের? নজরুলের গানের ভাষায়; হেথা প্রেমে আছে গুরু-গঞ্জনা অপবাদ / আছে মান অভিমান পীরিতি-সোহাগে। ।

লোকে যদি অপ্রিয় সমালোচনায় মুখর না’ই হলো, অভিমান দহনে মন যদি না’ই পুড়লো তবে মিছে এই প্রেম সাধনা। হ্যাঁ, প্রেম অবশ্যই একটি সাধনা। নিঃসঙ্গ নিস্তরিত জীবন থেকে আনন্দময় কল্যাণময় জীবনের দিকে ধাবিত হওয়ার এক মহান সাধনা। আর কে না জানে! সাধনার পথে থাকে শত বাঁধা। কণ্টকরুপ বাঁধা ঠেলে অগ্রসর হতে গেলে কাঁটার আঘাতে তো হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবেই।

তবে আশা এই যে, একদিন তিমির রাতের আঁধার শেষ হবে। প্রভাত-সূর্য অপার সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা নিয়ে কাছে আসবে। জীবন আলোকিত হবে। এবং জীবন আলোকিত হয়। আর মাটির পৃথিবীকে তখন আরো সুন্দর মনে হয়।

নজরুল সে কথাই জানিয়ে যাচ্ছেন তার এই গানের মধ্য দিয়ে। হেথা হারাই হারাই ভয়, প্রিয়তমে তাই- বক্ষে জড়ায়ে কাঁদি, ছাড়িতে না চাই। স্বর্গের প্রেমে নাই বিরহ-অনল সুন্দর আঁখি আছে নাই আঁখিজল, রাঁধার অশ্রু নাই কুঙ্কুম-ফাগে। । স্বর্গের প্রেমে তো বিরহ-অনল নেই।

সৃষ্টিকর্তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পূন্যবান মানুষ স্বর্গের সুষমা লাভ করবে। সেখানে সে যা চাইবে তা’ই পাবে। সেখানে থাকবে না কোন নিষেধ। থাকবে না কোন হারানোর ভয়। কিন্তু সেটাই কি হবে মঙ্গল? যেখানে হারাই হারাই ভয় নেই, যেখানে প্রিয়তমকে কাছে পাবার তীব্র আকুতি নেই; প্রিয়বিচ্ছেদের নির্মম যাতনা নেই_ সেখানে প্রেমের মূল্য কি? সেখানে তো প্রেম কোন সাধনা নয়।

যেখানে সুন্দর আঁখি আছে কিন্তু আঁখির অলঙ্কার আঁখিজল নেই। যেখানে কৃষ্ণবিরহে রাঁধার চোখ অশ্রুসিক্ত হয় না; সেখানে প্রেমের কি মূল্য? প্রেম আঘাতে আঘাতে দৃঢ় হয়। শত নিষেধের বেড়াজালে জড়িয়েই তার শ্রী বৃদ্ধি। তাই তো কবি স্বর্গের নয় বরং এই মাটির পৃথিবীতেই তার প্রিয়তমের প্রেম কামনা করছেন। এখানে যত ফুল তত ভুল কণ্টক জাগে, যতো প্রেম ততো বাঁধা এসে পথ রোধ করে।

হেথা চাঁদে আছে কলঙ্ক, সাধে অবসাদ; হেথা প্রেমে আছে গুরু-গঞ্জনা অপবাদ; আছে মান অভিমান পীরিতি-সোহাগে। । চাঁদের যেমন কলঙ্ক আছে। কলঙ্ক নিয়েই যেমন চাঁদ চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে আলোয় উদ্ভাসিত করে পৃথিবী। তেমনি গুরু-গঞ্জনা অপবাদ ছাড়া প্রেম পরিপূর্ণতা লাভ করে না।

মান অভিমানের দোলাচলে না দুলে এখানে-এই মাটির পৃথিবীতে, মন যে তৃপ্ত হয় না। তাই তো মাটির পৃথিবী এতো ভালো লাগে। এখানে মান অভিমান আছে বলেই প্রেমে এতো আনন্দ। গুরু -গঞ্জনা আছে বলেই তো প্রেমের এতো মূল্য। প্রিয়তমকে হারানোর ভয় আছে বলেই তো তাকে বুকের মধ্যে সদাসর্বদা আঁকড়ে ধরে রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা।

এই মাটির পৃথিবীতে তাই তো হৃদয়ে প্রেম এসে বাসা বাঁধে। মন ব্যাকুল হয় প্রিয়তমকে কাছে পাবার আকাঙ্ক্ষায়। বিচ্ছেদ বিরহে চোখে ঝরে শ্রাবণধারা। আবার প্রিয়মিলনের সুখ-স্বপ্নে বিভোর হয় মন। তখন কাঁটার আঘাত উপেক্ষা করে আমরা কুসুমের দিকে আমাদের হাত প্রসারিত করি।

প্রেমময় পৃথিবীর কাছে তাই প্রেম-সাধনাহীন স্বর্গ তুচ্ছ মনে হয়। প্রেমের কাছে স্বর্গের আবেদন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। যত ফুল তত ভুল কণ্টক জাগে। মাটির পৃথিবী তাই তো এতো ভালো লাগে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.