শাবিপ্রবি’র ছাত্র হিসেবে গত তিনদিন ধরেই দেখছিলাম কি তুলকালাম চলছে শাবি’র অনলাইন জগতে। সাবেক ছাত্র- সাবেক ছাত্রের বিরোধী গ্রুপ- রাজনীতিবিদ- শিক্ষক-সাধারণ শিক্ষার্থী- সাধারণ শিক্ষার্থীর বেশ ধরা বহিরাগত ফেক আইডি- অতি উৎসাহী অনলাইন একটিভিস্টস- অনলাইন একটিভিস্টের হাজার হাজার চ্যালা-চামুন্ডা কে নেই এই বিতর্কে? যে যার মত পারছে আগুনে ঘি ঢালছে। এই শীতে ভাস্কর্য্য বিতর্কই যেন দিতে পারে আমাদের শান্তির একটু উষ্ণতা! কিন্তু এতে যে কত বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে আমাদের ক্যাম্পাসের তিলে–তিলে গড়ে ওঠা পরিচয়টার, তা কেউ দেখছে না। বাইরের অতি-উৎসাহীদের কথা বাদ দিলাম, সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা অন্তত নিজের ভার্সিটির সম্মান এভাবে ধুলোয় লুটিয়ে দিতে পারে অকাতরে তা জানা ছিলনা। সবই দেখলাম, বুঝলাম এবং শেষমেশ মনের ভিতর জমে থাকা কথাগুলো ঝেড়ে ফেললাম একনাগাড়ে।
শাবিপ্রবি সেই নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ বড় একটা ফ্যাক্টর হয়ে ছিল। ঢাকার রাজনীতিতে যেমন পল্টন ময়দান, চট্টগ্রামে লালদীঘির ময়দান, সেরকম সিলেটের রাজনীতির সবচেয়ে বড় কেন্দ্রস্থল কোন ময়দানকে না বানিয়ে বানানো হয়েছে অথবা বানানোর চেষ্টা চলছে আমাদের প্রাণপ্রিয় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে। হ্যাঁ, সিলেটে কোর্টপয়েন্ট কিংবা আলীয়া মাদ্রাসার মাঠ বলে দু’টো রাজনৈতিক ভেন্যু আছে অবশ্যই, তবে সেখানে শুধু জনসভাই হয়,কোন ফলপ্রসূ আন্দোলন কখনো গড়ে উঠেছে বলে আমার জানা নেই। বরং এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন জনসভা না হয়েই এই অঞ্চলের রাজনৈতিক টার্নিং পয়েন্ট আমাদের শাবিপ্রবি। ৯০ এর দশকের শুরুতে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি সরাসর স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানানোর পর দেশে এরকম দৃষ্টান্ত আর একবারই স্থাপিত হয়েছিল- সেই দশকেরই শেষের দিকে হলের নামকরণ নিয়ে শাবিপ্রবিতে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসার মাধ্যমে।
পরবর্তিতে যা রাষ্ট্রপতি হস্তক্ষেপে অমীমাংসিত থেকে যায়। আজ তার প্রায় ১৩বছর পর সেই শাবিপ্রবিকে ঘিরেই আবার উত্তপ্ত হতে যাচ্ছে সিলেটের রাজনীতি।
এই সিলেটের মাটি হযরত শাহজালাল (রাঃ) এর স্মৃতিবিজড়িত। যে কারণে সিলেটকে বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানীও বলেন অনেকেই। হযরত শাহজালাল (রাঃ) তার ৩৬০ অনুসারীদের নিয়ে এ অঞ্চলে এসে অত্যাচারী রাজা গৌরগোবিন্দকে পরাজিত করে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন এ অঞ্চলে।
এ কারণে তাঁর প্রতি সিলেটের মানুষদের অগাধ শ্রদ্ধা। দেশের বড় বড় নেতৃবৃন্দের নির্বাচনী প্রচারভিযানও শুরু হয় শাহজালাল (রাঃ) এর দরগা জিয়ারতের মাধ্যমে। কিন্তু শাহজালাল (রাঃ) এর এই ঘটনা কতবছর আগের কেউ বলতে পারেন? অনেক ধর্মপ্রাণ মুসল্লিই এ উত্তর দিতে পারবেন না যারা দিনে অন্তত দু’বার দরগায় গিয়ে নামাজ আদায় করেন। মানুষের জানায় ঘাটতি থাকতেই পারে, সেটা ব্যাপার না এবং এজন্য আমি কাউকে কটাক্ষও করছি না। যারা জানেন না তাদের জন্য আমি সরাসরি উইকি থেকে তথ্য তুলে দিচ্ছি-
“শাহজালাল (জন্ম ৬৭১ হিঃ ১২৭১ইং- মৃত্যু; ৭৪০ হিঃ ১৩৪১ ইং) ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি দরবেশ।
তাঁর পুরো নাম শায়খ শাহ জালাল কুনিয়াত মুজাররদ। ৭০৩ হিজরী মোতাবেক ১৩০৩ ইংরেজী সালে ৩২ বত্সর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে অধুনা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন বলে ধারনা করা হয়। সিলেট আগমনের সময় কাল নিয়ে যদিও বিভিন্ন অভিমত রয়েছে; তদুপরি শাহ জালালের সমাধির খাদিমগণের প্রাপ্ত পারসী ভাষার একটি ফলক লিপি হতে উল্লেখিত সন-তারিখই সঠিক বলে ধরা হয়[১]। পারসী ভাষায় লিখিত ফলক লিপি বর্তমানে ঢাকা যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে[২]। সিলেটে তাঁর মাধ্যমেই ইসলামের বহুল প্রচার ঘটে[১][২][৩] সিলেট বিজয়ের পরে শাহ জালালের সঙ্গী অনুসারীদের মধ্য হতে অনেক পীর দরবেশ এবং তাদের পরে তাদের বংশধরগণ সিলেট সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করেন[১]।
শাহজালাল ও তাঁর সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে সিলেটেই কবর দেয়া হয়। [৪]”
হযরত শাহজালাল (রাঃ) এর কথা এখানে কেন আনলাম তা এখন ব্যাখ্যা করি। সিলেটবাসী আজ থেকে প্রায় ৭০৯ বছর আগে কে এসে তাদের অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করেছিল তা মনে রাখলেও মাত্র ৪১বছর আগে যারা রাজা গৌরগোবিন্দের চেয়েও ভয়াবহ অত্যাচারীর হাত থেকে তাদের বাঁচিয়েছিল তাদের সম্ভবত মনে রাখেনাই। রাজা গৌরগোবিন্দের অত্যাচারের একটা কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত আছে।
কোন এক মুসলমান একবার লুকিয়ে গরুর মাংস খাওয়ায় রাজা তার দু’হাত কেটে নেন। মানলাম সেই রাজা অনেক অত্যাচারী ছিল, কিন্তু কেউ কি বলতে পারবেন সেই রাজার অত্যাচার পাকবাহিনীর অত্যাচারকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল? পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের মত হাজার-হাজার মানুষ মারার কোন কাহিনী কি প্রচলিত আছে রাজা গৌরগোবিন্দের নামে? আমার জানামতে এরকম কোন ইতিহাস নাই। এই বাংলাদেশে যখন নৃশংসতা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তখন এদেশকে বাঁচানোর জন্য সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই সিলেটেরই সন্তান জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। তিনি হয়তো যুদ্ধের মাঠে রাইফেল ধরেননি, কিন্তু তারচেয়ে গুরুভার পালন করেছেন তার অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, নিষ্ঠা, বীরত্ব এসবের সম্মিলন ঘটিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করে, সামরিক অভিযানের সমন্বয় ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। আর যুদ্ধক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতিতেও সিলেটের মাটিকে শত্রুমুক্ত রাখার জন্য প্রাণপণে লড়ে গেছে সুনামগঞ্জের জগৎজ্যোতি দাসের মত বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
সিলেটের এমন কোন মানুষ নেই যাকে জিজ্ঞেস করলে শাহজালালের দরগার ঠিকানা বলে দিতে পারবে না। কিন্তু কয়টা মানুষ জানে জেনারেল ওসমানী’র সমাধি কোথায়। এমনকি অনেক উচ্চশিক্ষিত সিলেটবাসীই তার জীবনে কখনো জগৎজ্যোতি দাসের নামও শুনেনাই, তাকে স্মরণ করা তো দূরের কথা। আর যেখানে হযরত শাহজালাল (রাঃ) এর নামে সিলেটের সরকারী-বেসরকারী ভবন-প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়েছে সেখানে বঙ্গবীর ওসমানীর নামে আছে শুধুমাত্র একটি শিশুপার্ক, যেটাতে কাকপক্ষীও উড়তে দেখা যায়না। ! ব্যাপারটা কি পরিমাণে অবমাননাকর চিন্তা করলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
হে বঙ্গবীর, তোমরা মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছ, এ অবমাননা সহ্য করতে হয়নি।
একজন মুসলমান হয়ে আমি হযরত শাহজালাল (রাঃ) এর সাথে তুলনা দিচ্ছি ওসমানীর মত এক সাধারণ মুসলমানের আর জগৎজ্যোতি দাসের মত এক বিধর্মী কাফিরের! এ তো সরাসরি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ! শাহজালালের দরগা পর্যন্ত যদি এ খবর পৌঁছে, তাহলে তো নগদে আমার বাসার সামনে নাঙ্গা তরবারি হাতে লাখো মুসল্লির জঙ্গী মিছিল পৌঁছে যাবে আমার ধড় মাথা থেকে আলাদা করে নেওয়ার জন্য! কিন্তু আমি তাও উদাহরণটা আনলাম কেন? কারণ আজ থেকে শত-শত বছর আগে যে মহান পুরুষটি এ অঞ্চলের মানুষকে ঘৃণ্য অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করেছিল, তাকে এখানকার মানুষ আজো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তার মাজার স্থাপিত হয়েছে বলে। তিনি সম্মানের যোগ্য বলে তার সমাধিস্থল মানুষ যত্নের সাথে, সম্মানের সাথে বাঁধিয়ে দিয়েছে। দিন-রাত তার দরগায় গিয়ে মানুষ কান্নাকাটি করে, তার রুহের মাগফিরাত কামনা করে, অতি-ভক্তিবান অনেকে তার কবরে সিজদা দিয়ে মান্নত ও করে (তাঁর দরগায় মান্নত কখনো বিফলে যায় না বলে শোনা যায়, এ ব্যাপারে পরে আলোচনা করছি)। ৭০০ বছরেরও বেশি সময় আগের এই মনীষীকে এই এলাকার মানুষ মনে রাখলেও কত সহজেই ভুলে গিয়েছে ৪১বছর আগের তাদের ত্রানকর্তাদের! যাদের অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে, যাদের জীবনের বিনিময়ে, যেসব মা_বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আজ আমরা অত্যাচারীর কবল থেকে বেরিয়ে এসেছি, তাদের কত সহজেই আমরা ভুলে বসে আছি! হায়রে বাঙ্গালী!! তাদের স্মরণে যদি আজ সিলেটের মাটিতে একটা ভাস্কর্য্য স্থাপিত হয়, তাহলে কি খুব সমস্যা? হ্যাঁ, অনেক বড় সমস্যা।
যারা সাধারণ সিলেটবাসী তাদের না। সমস্যা তাদেরই যারা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে। যারা চায় এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে ভুলা যাক। যারা চায় আজ থেকে আরো ৪০বছর পরে যখন দেশে আর একজন মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের কেউ বেঁচে থাকবে না, তখন ১৯৭১ এর ইতিহাসকে একটা ‘গণ্ডগোল’ আখ্যা দিয়ে ইতিহাস লিখতে। যারা চায় মানুষের মন থেকে মুক্তিযুদ্ধকে মুছে দিতে।
যেসব আলেম-ওলামা গত ২সপ্তাহ ধরে সভা-সমাবেশ করে বেড়াচ্ছেন, জুম্মার নামাজের খুতবায় ভাস্কর্যবিরোধী বয়ান দিচ্ছেন তাদের প্রতি আমার কিছু প্রশ্ন আছে।
- আপনারা যে বলছেন শাবিপ্রবি’তে ভাস্কর্য্য স্থাপিত হলে তা হবে মূর্তিপুজার শামিল। আপনারা কি ভাস্কর্য্য আর প্রতিমার পার্থক্য বুঝেন?
- ভাস্কর্য্যের বেদিতে যদি ফুল দেয় কেউ, তা কিভাবে শিরক হবে?
আপনারা এসব প্রশ্নের কি উত্তর দিবেন আমার ভালমত জানা আছে। আমি এবার ব্যাখ্যা করি আমার দৃষ্টিতে এ দু’টো প্রশ্নের উত্তর কি হবে
- ভাস্কর্য্য হচ্ছে সেই স্থাপনা যা আপনাকে কোন বিশেষ ব্যক্তি বা ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিবে। আর প্রতিমা হলো সেই দেব-প্রতিকৃতি যা তৈরি হয় উপাসনার জন্য।
মানুষ প্রতিমাকে উপাসনা করে, ভাস্কর্য্যকে না। তাই ভাস্কর্য্যকে প্রতিমার সাথে মিশিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না।
- প্রতিমায়ও মানুষ ফুল দিয়ে অঞ্জলি দেয়, ভাস্কর্য্যেও তাই। কিন্তু আমার মতে এটা শিরক না। কারণ একজন মানুষ যখন প্রতিমায় অঞ্জলি অর্পণ করে, তখন তার মনে থাকে স্রষ্টার প্রতি অগাধ ভালবাসা আর শ্রদ্ধা।
এ শ্রদ্ধা কখনোই অন্য কোন শ্রদ্ধার সাথে তুলনীয় না, কারণ উপাসনার সময় মানুষটি স্রষ্টার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়। আর একজন মানুষ যখন কোন স্মৃতিস্মারকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন, তখন তার মনে কোনরকম উপাসনা বোধ থাকে না। যা থাকে তা হল শুধুই শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা। নিজেকে সেই স্মারকের কাছে সমর্পণের কোন ব্যাপার এখানে থাকে না। মহান আল্লাহ’তাআলা সর্বজ্ঞানী, অন্তর্যামী।
তিনি জানেন কেউ স্মৃতিস্মারকে ফুল দিলে তার ঈমান নড়ে যাবে কিনা। আবার তিনি এটাও জানেন মসজিদে জামাতে নামাজ পড়তে গিয়ে কে কে দোকানের চাল-তেলের হিসাব করছে। তাই আল্লাহ’তাআলা আমাদের ইবাদত বুঝে তা কবুল করলেই যথেষ্ট।
তারপরও যারা যারা বলবেন যে ইসলামে মুর্তি স্থাপন নিষিদ্ধ। তাদেরপ্রতি আমার একটা অনুরোধ থাকবে।
আল্লাহ চাইলে আপনাদের সবাইকেই হজ্জ করার তৌফিক দিবেন। তো যখন হজ্জটা করতে সৌদী আরব যাবেন, দয়া করে ওখানে স্থাপিত ঊট-ঘোড়ার ভাস্কর্য্যগুলো (আপনাদের ভাষায় মুর্তি) ভেঙ্গে দিয়ে আসবেন। কারণ যেখানে হযরত শাহজালালের স্মৃতিবিধৌত সিলেটের বুকে হারাম মুর্তি আপনারা সহ্য করতে পারেননা, সেখানে স্বয়ং রাসুলেপাক (সাঃ) এর জন্মভূমিতে মূর্তি নির্মান করে রাসুল (সাঃ) এর স্মৃতির অবমাননা করা হবে তা কিভাবে হয়?!? আরেকটা কথা, আপনারা যারা বলছেন যে ভাস্কর্য্য স্থাপিত হলে তা শিরকের শামিল হবে, তারা দয়া করে আগে সিলেটের অসংখ্য মাজারে যেসব শিরক গত কয়েক শতক ধরে চলে আসছে তা বন্ধ করুন।
সিলেটের জনগণকে আমি উপরের লেখাগুলোতে কোনভাবেই হেয় করতে চাই নাই এবং করিও নাই। কারণ আমি জানি সিলেটের মানুষগুলো কতটা সরল এবং ভাল।
হ্যাঁ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা হয়তো আমাদের মত ‘আবাদি’দের পছন্দ করেন না আমরা তাদের সংস্কৃতি নষ্ট করছি বলে। তবে যারা আমাদের আপন করে নিয়েছেন এ সিলেটের মাটিতে তাদের আমি কখনোই ভুলবো না। আমি ঢাকা, চট্টগ্রামের মত বড়-বড় শহরে থেকে এসেছি। কিন্তু গত ৫বছর সিলেট থাকার পর আমি চাই আমার কর্মস্থল যেন সিলেট হয়। কারণ যে এখানে একবার এসেছে, এখানকার মানুষের ভালবাসা পেয়েছে তারা কখনোই এই ভালবাসা ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
তবে এই ভালবাসার বিনিময়ে আমি চাই আপনাদের চোখ খুলে দিতে। আপনাদের সরলতার এবং বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে যে ব্যবসা চলে আসছে সিলেটের মাজারগুলোতে তা কি আপনারা জানেন না? প্রতিদিন মাজারের সামনের দোকানগুলোতে যে লাখ-লাখ টাকার মোম-আগরবাতি বিক্রি হয়, তার মধ্যে কয় হাজার টাকার মোম-আগর দরগায় জ্বালানো হয় আর কয়লাখ টাকার মোম-আগর রিসাইকেল হয়ে আবার সামনের দোকানে চলে আসে তা কি আপনারা জানেন? এই ব্যবসার কমিশন খায় মাজার-কমিটি। এ মাজার কমিটির মেম্বার হয় যে মাওলানারা, তারাই এখন ভাষণ দিয়ে বেড়াচ্ছেন শাবিপ্রবি’র ভাস্কর্য্যের বিরুদ্ধে। ভাস্কর্য্যে কেউ কোনদিন সেজদা দিবেনা। কিন্তু একদিন হযরত শাহজালাল (রাঃ) এর দরগায় এক ঘণ্টায় দাঁড়িয়ে থাকবেন।
দেখবেন কি পরিমাণ মানুষ জেনে-না জেনে হযরত শাহজালালের (রাঃ) এর কবরকে সামনে রেখে সিজদা দিচ্ছে (যা কিনা সরাসরি শিরকের শামিল)। আল্লাহর সাথে বান্দার যোগাযোগ সরাসরি। বান্দার ইবাদত সরাসরি আল্লাহর কাছে পৌঁছে, এর জন্য দরগায় গিয়ে মান্নত করতে হয়না। বরং দরগায় গিয়ে আপনি যখন মান্নত করবেন (অনেক অশিক্ষিত/অল্পশিক্ষিত মানুষকে দেখেছি আল্লাহর কাছে মোনাজাত তুলে শেষে আবেগের আতিশয্যে হযরত শাহজালালের কাছে চেয়ে বসে!) তখন তা জোরালো না হয়ে বরং হালকা হয়ে যায়। আর মাজারে গিয়ে মান্নত করলে যে তা পূরণ হয় তা আপনাকে কে বলেছে? প্রতি নির্বাচনের সময়ই হাসিনা-খালেদা দুইজনই মাজার জিয়ারত করে (তাদের ভাষায় শাহজালালের দোয়া নিয়ে) নির্বাচনী সফর শুরু করে।
কিন্তু একেক নির্বাচনে জিতে একেকজন। হিসাব মিলে? মাজারে কিছু চাওয়া/সিজদা দেওয়া শিরক জানার পরও মাজারের মাওলানারা আপনাদের মাজারে মোম জ্বালাতে, মান্নত করতে নিষেধ করেন না। এসব নিষেধ করলে তাদের উপরি ইনকাম বন্ধ হয়ে যাবে যে! বরং আপনাদের ধর্মানুভুতি কাজে লাগিয়ে তারা বন্ধ করতে চাচ্ছেন ভাস্কর্য্য নির্মাণ যা কোন যুক্তিতেই শিরক না। আপনারা অবশ্যই মাজারে যাবেন, ওলী-আউলিয়াদের মাজার জিয়ারত করবেন। তবে খেয়াল রাখবেন আপনার জিয়ারতের পদ্ধতি যেন শিরক হয়ে না যায়।
আর আপনাদের চোখ-কান খোলা রাখুন, কেউ যেন আপনাদের ব্যবহার করে নিজের স্বার্থোদ্ধার করতে না পারে।
এবার কিছু কথা বলবো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী ও শাবিপ্রবিতে পড়ে যাওয়া সাবেক/বর্তমান ভাইদের। আমরা সবাই চাই আমাদের গোলচত্ত্বরে ভাস্কর্য্যটা স্থাপিত হোক। হয়তো এ ভাস্কর্য্য কিরকম হলে ভাল হয়, বর্তমান প্রস্তাবিত আদলে নাকি বিমূর্ত আদলে তা নিয়ে কিছু মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে এক মতের মানুষ আরেক মতকে সুস্থভাবে গ্রহণ না করে অযথা গালাগালি করে লাভটা কি? এতে আমাদের ভাস্কর্য্য-নির্মাণের কাজ তো আগাবেই না কোনভাবে, বরং আমাদের বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে কিছু সুযোগসন্ধানী প্রতিক্রিয়াশীল তাদের সুবিধা আদায় করে নিবে।
ফলশ্রুতিতে ভাস্কর্য্য নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এই সহজ কথাটা না বুঝে আপনারা যেভাবে আত্মঘাতী আচরণ করছেন তা আসলেই আমাকে হতাশ করে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে যাওয়া আমাদের এক বড় ভাইকে আমি কিছু কথা বলতে চাই। গত দুইদিন ধরেই আমি ভালভাবে অনলাইনে পক্ষে-বিপক্ষে সব আলোচনা দেখছি এবং পারলে অংশগ্রহণ করছি। এবং সিএসই ডিপার্টমেন্টের ছাত্র না হয়েও এবং আমার সাথে কোনরকম সম্পর্ক না থাকার পরও আমি তাদের পক্ষে কথা বলেছি কারণ আমার কাছে তাদের বক্তব্য সঠিক মনে হয়েছে।
আপনি নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি দাবী করেন এবং আমরা জানি আপনার এ দাবী কতটা যৌক্তিক। আমারব্লগ এবং জন্মযুদ্ধের পিছনে আপনার অবদান কতটুকু। কিন্তু আপনার কাজের মাধ্যমে আপনি যে সম্মানটা আদায় করে নিয়েছিলেন সম্পূর্ণ অচেনা হওয়ার পরও, তা পুরোপুরি হারিয়ে গেছে গত দুইদিন আপনার দায়িত্বজ্ঞানহীন ছাগু-ট্যাগিং এবং আপনার সহচর/ অনুসারীরা আপনার ছত্রছায়ায় আমাদের ভার্সিটিকে একটা মাদ্রাসার সাথে তুলনা করে সমগ্র দেশের সামনে আমাদের নামে অপপ্রচার চালানোতে। ছাগু-বিতর্কের কারণে আরিফ জেবতিকের মত জনপ্রিয় কলামিস্ট যখন শাবিপ্রবি’কে শাহজালাল জামেয়া মাদ্রাসার সাথে তুলনা করে, আপনি সেটার প্রতিবাদ করেননি। আপনার মালিকানাধীন আমারব্লগের একটি নিক ‘আইজুদ্দিন’ যখন শাবিপ্রবিকে ব্যঙ্গ করে ‘শাবই ওয়াহাবী মাদ্রাসা’ নামকরণ করে, আপনি তারও প্রতিবাদ করেননি (আপনি আইজুদ্দিনের ফ্রেন্ডলিস্টে আছেন, এ কথা জানি বলেই বলছি)।
সামান্য একটা ফেক ফেবু আইডি যখন জাফর স্যারের ১৮বছরের পরিশ্রমে গড়ে তোলা তার পরিবার-তূল্য সিএসই ডিপার্টমেন্টকে ছাগলের খোঁয়াড় বলে গালি দেয়, তখনো আপনি তার প্রতিবাদ করেননি। এই ক্যাম্পাসে পরে যখন আপনি এই ক্যাম্পাসেরই বদনাম করেন অথবা বদনামকারীদের সহায়তা করেন, আপনাকে আর কিভাবে সম্মান করি বলুন? আপনি নাহয় একজনকে ছাগু-ট্যাগ দিয়েছেন। কিন্তু আপনি ভালভাবেই জানতেন এই ইস্যু গরম হলে তা ভাস্কর্য্যটাকেই হুমকির মুখে ফেলে দিবে। তারপরও আপনি এই ক্যাচাল চালিয়ে গিয়েছেন কি নিজের ইগো ধরে রাখার জন্য? আপনাকে ছোট মুখে আরেকটা প্রশ্ন করি, আপনি নিজেও তো এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ছিলেন। তো আপনার ছাত্রজীবনে আপনি কি উদ্যোগ নিয়েছিলেন এই ভাস্কর্য্য স্থাপনে? এখন ভাস্কর্য্য স্থাপিত হচ্ছে বর্তমান প্রশাসনের উদ্যোগে, বর্তমান শিক্ষার্থীদের উৎসাহ ও সমর্থনে।
বরং আপনার কারণে এই প্রকল্প এখন হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। নাকি আপনি নিজেই চাচ্ছেন পরিস্থিতি জটিল হোক যাতে ভাস্কর্য্যটা দাঁড়ানোর পর আপনি ক্রেডিট নিয়ে বলতে পারেন “আমাদের ছাগু-বিরোধী আন্দোলন না হলে শাবিপ্রবি’র মাটিতে এই ভাস্কর্য্য কখনোই দাঁড়াতে পারতো না”? আপনার অভিপ্রায়টা একটু খোলাসা করুন তো দয়া করে।
সবকিছুর পরও আমরা চাই সব বিভেদ আর মতানৈক্য ভুলে একসাথে হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে এই ভাস্কর্য্যটা গড়ে তুলতে। যেন কোন ভাস্কর্য্যবিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠীই এর গায়ে আঁচড়ও দিতে না পারে। গত ৫বছরে আমার এই ক্যাম্পাস, এই ক্যাম্পাসের মানুষগুলো, সুন্দর এই সিলেট শহর আর তারচেয়েও সুন্দর এর মানুষগুলোকে অনেক ভালবেসে ফেলেছি।
আশা করি এতদিন পর এই ধারণা ভেঙ্গে যাবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।