সিলেটে অবস্থিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গতকাল সারাদিন থেকেই উত্তাল ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে। প্রস্তাবিত সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাতিল হয়েছে, ‘সিলেটী’দের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০% কোটা বরাদ্দের দাবী উঠেছে- এসবের প্রেক্ষিতে ডঃ জাফর ইকবাল ও ডঃ ইয়াসমিন হক পদত্যাগ করেছেন। এদিকে তাঁদের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত বাতিল, সমন্বিত পদ্ধতি চালু এবং ‘সিলেটী’ কোঠা প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে জোরালো ভাবে সংগঠিত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা।
প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে এই ঘটনাগুলোর সবার জানা হয়ে গেছে, পুনরাবৃত্তি অপ্রয়োজনীয়।
১৯৯৪ সালে ডঃ জাফর ইকবাল ও ডঃ ইয়াসমিন হক শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর থেকে স্পষ্টতই জামাত শিবির নানা ইস্যুতে তাদের সাথে সরাসরি বিরোধীতা চালিয়ে এসেছে।
গত একযুগের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি ও এখন জামাতের সাথে জাফর ইকবাল বিরোধী জোট। বিএনপি জামাতের প্রবল বিরোধীতা ও হেনস্তা মোকাবেলা করেই জাফর ইকবাল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে আছেন গত দুইদশক ধরে এবং কখনোই কোন আপোষ না করে। জাফর ইকবাল জানেন তার সাথে বিএনপি জামাতের যে বিরোধীতা সেটা মৌলিক এবং রাজনৈতিক, এই রাজনীতিতে ধর্মকে ও টেনে আনা হয়েছে বারবার তাকে অপদস্ত করার জন্য।
জাফর ইকবাল বিরোধীতায় কী কখনো আঞ্চলিকতা ব্যবহৃত হয়েছে এর আগে? যদি আমার ভুল না হয়- ‘না’। সারা দেশের মতো সিলেটে ও মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী একটি প্রগতিশীল ধারা টিকে আছে এবং জাফর ইকবাল নিজে ও এই ধারার সাথে সম্পৃক্ত।
তিনি কেবল বিশ্ববিদ্যালয় গন্ডীতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি, এর বাইরে সিলেটের যেসকল প্রগতিশীল কার্যক্রম, কর্মসূচী ও উদ্যোগ থাকে সে সবে ও তিনি জোরালো ভাবেই জড়িত থাকেন। গত ফেব্রুয়ারীর গনজাগরন এর সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচির পাশাপাশি সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মুল জমায়েতে জাফর ইকবালের সস্ত্রীক ও সবান্ধব উপস্থিতি ছিলো এক বিশাল প্রেরনা।
তাহলে এবার কেনো ধর্মের পাশাপাশি আঞ্চলিকতার আমদানী? এটা ও রাজনীতি। যে রাজনীতি ধর্মকে ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে, সেই রাজনীতি সহজেই আঞ্চলিকতাকে ও ব্যবহার করতে জানে। তাই ‘সচেতন সিলেটবাসী’ নামে যে কয়জনকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় দেখা গেছে তারা আঞ্চলিকতার অস্ত্র ব্যবহার করবে- অস্বাভাবিক নয়।
এরা সরাসরিই জামাত বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। সিটি মেয়র বিএনপির, আতাউর রহমান পীর – মদন মোহন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং বিএনপির লোক, লেঃ কর্ণেল ( অবঃ) আলী আহমদ জাতীয় পার্টি হয়ে বিএনপি- ছাত্র জীবনে ছাত্র সংঘ করতেন, ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) জুবায়ের সিদ্দিকী- জামাত ঘরানার এবং একটা বেসরকারী স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ ( সেই কলেজের মালিক আবার আওয়ামী লীগের সাংসদ)। এরা আঞ্চলিকতার ধোঁয়া তুলবে এবং জাফর ইকবালকে বহিস্কারের দাবী তুলবে- এতে অবাক হওয়ার কিচ্ছু নেই। জাফর ইকবাল যদি আজ সিলেটে না থেকে চট্টগ্রাম কিংবা খুলনার কোন বিসশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেন- একই ধরনের লোক তার বিরুদ্ধে একই অস্ত্র প্রয়োগ করতো। ধর্ম ও আঞ্চলিকতার নোংরা প্রয়োগ এই দেশে সকলেই করে।
কিন্তু অস্বাভাবিক ও আতংকের বিষয় হলো- সিলেটের একটা স্থানীয় পত্রিকার সূত্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়েছে তাহলো- ৫০% সিলেটি কোটা ও জাফর ইকবাল হঠাও কর্মসূচীতে এবার শুধু জামাত বিএনপি একলা নয়, সম্মিলিত যোগাযোগে কমরেড হয়েছে আওয়ামী লীগ, সিপিবি, জাসদ, বাসদ, সংস্কৃতি ও পরিবেশন সংগঠন অথচ জাফর ইকবালের সাথে এদের সখ্যতা প্রকাশ্য।
তাহলে ঘটনাটা কী? সেটা জানতে কাল থেক বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ খবর নিলাম। উল্লেখ্য আওয়ামী লীগ, সিপিবি, জাসদ, বাসদ, সাংস্কৃতি ও পরিবেশন সংগঠনের যাদের নাম প্রকাশিত হয়েছে তাদের প্রায় সকলেই ব্যক্তিগত বন্ধু, ছোটভাই, মুরব্বীজন।
স্থানীয় পত্রিকা ‘সিলেটের ডাক’ এর সংবাদ এ মনে হয় সম্মিলিত পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল,৫০% সিলেটি কোটা ও জাফর ইকবাল হঠাও কর্মসূচীতে এরা জামাত বিএনপির সাথে যৌথ স্মারকলিপি পেশ করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় বসেছেন। কিন্তু আসল সত্যটা সেরকম নয়।
বেদানন্দ ভট্টাচার্য্য- সভাপতি সিলেট কমিউনিস্ট পার্টি, লোকমান আহমদ- প্রধান নেতা (পদ জানিনা) সিলেট জাসদ, উজ্জ্বল রায় ( সিলেট বাসদ নেতা), মইনুদ্দিন জালাল ( যুব ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা), সমর বিজয় সী, সুজন এর ফারুক মাহমুদ চৌধুরী এরাই মুলতঃ উদ্যোগ নিয়েছিলেন সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে স্মারক লিপি দেয়ার। সেই স্মারক লিপিতে সমর্থন জানিয়ে স্বাক্ষর দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা বদরুদ্দীন কামরান ও আনম শফিকুল হক এবং পরিবেশ আন্দোলনের নেতা আব্দুল করিম কীম। তাদের যুক্তি হচ্ছে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট কালে যাতে এটিকে ইস্যু করে জামাত শিবির বিএনপি জনসমর্থন আদায় করে পরিস্থিতি ঘোলা না করতে পারে সে কারনে তারাই আগ বাড়িয়ে এটি বাতিলের দাবী তুলেছেন।
বিএনপি জামাত জোট তো আগে থেকেই এর বিরোধীতায় ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গতকাল বিরোধীতাকারী দুইপক্ষকে একই সাথে তাদের সাথে বসার আহ্বান জানালে আওয়ামি-বাম-প্রগতিশীল পক্ষ বিএনপি –জামাতের সাথে বসতে আপত্তি জানান।
এই অবস্থায় প্রথমে বিএনপি জামাত বসে বিকেল বেলা, সেই বসাতেই ৫০% সিলেটি কোটা ও জাফর ইকবাল হঠাও এর দাবী উঠে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন উঠে, সিলেটের ডাকে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে এই বৈঠকেই বিএনপি জামাতের পাশে বসা সিলেট সদর উপজেলার চেয়ারম্যান, অর্থমন্ত্রীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা আশফাক আহমদ- যিনি ফেব্রুয়ারীতে গনজাগরন মঞ্চে ডঃ জাফর ইকবালের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আশফাক সাহেবের বক্তব্য হচ্ছে- তাকে জানানো হয়নি যে আলাদা আলাদা বসা হচ্ছে। আগের শিডিউল অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে তিনি জামাত বিএনপির নেতাদের দেখতে পান এবং তাদের অনুরোধেই!
সন্ধ্যার পর প্রগতিশীল পক্ষ কর্তৃপক্ষের সাথে দেখা করে তাদের স্মারক লিপি প্রদান করেন যেখানে কোটা বা জাফর ইকবাল সংক্রান্ত কিছু নেই।
এই হলো ঘটনা।
আমার নিজের পর্যবেক্ষন দুটি।
প্রথমতঃ প্রগতিশীল পক্ষে যাদের নাম- তারা সিলেটে জাফর ইকবালের ঘনিষ্ঠজন বলেই পরিচিত। বিশেষ করে নামকরন বিরোধী আন্দোলনে জাফর ইকবালকে সবধরনের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সমর্থন তারা দিয়েছেন। কিন্তু এবার নয় কেনো?
এর মধ্যে যে পরিবর্তনটি ঘটেছে- প্রথম আলোর সাথে জাফর ইকবালের সম্পর্কের অবনতি। পত্রিকাটির বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি’র শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট এবং সেই প্রেক্ষিতে তার ছাত্রত্ব বাতিলকে কেউ কেউ এই অবনতির মুল কারন বলে দাবী করেন যদি ও জাফর ইকবাল এর সমর্থকরা প্রথম আলোর গনজাগরন বিরোধী অবস্থানকে এই ক্ষেত্রে নির্দেশ করেন।
যা হোক, উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ স্থানীয় পর্যায়ে প্রথম আলোর আস্থাভাজন । প্রথম আলো ঘিরে জাফর ইকবালের সাথে তাদের কোন সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিলো কিনা- আমি নিশ্চিত নই।
দ্বিতীয়তঃ
একটা বিশ্ববিদ্যালয় তার ভর্তি পরীক্ষা কোন পদ্ধতিতে নেবে সেটা একান্তই বিশ্ববিদ্যালয় নামক স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানটির। এতে যদি ছাত্রদের/ ভর্তিচ্ছুকদের কোন আপত্তি থাকে তাহলে প্রতিবাদ আসবে প্রথমতঃ তাদের পক্ষ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে আছেন আচার্য্য- মাননীয় রাষ্ট্রপতি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ, জাসদ, বাসদ, কমিউনিষ্ট পার্টি, যুব ইউনিয়ন, সুজন , পরিবেশ আন্দোলনের কী কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে নাক গলানোর? সবকিছুতে নিজেদের অংশীদারিত্ব প্রমানের বিশ্রী বাজে অভ্যাস!
নাক যদি গলাতেই হয় তাহলে আরেকটু বিচার বিবেচনা তো করা দরকার। যে দাবী জামাত-বিএনপি তুলছে তার রাজনৈতিক স্বার্থে, সেই দাবী আপনারাই আগ বাড়িয়ে তুলতে গেলেন জামাত বিএনপিকে টেক্কা দিবেন বলে? ফলাফল- লবডংকা!
ব্যক্তিগত আলাপচারীতায় যে প্রশ্নটি করেছি, সেই প্রশ্ন এখানে ও লিখে রাখলাম। যারা একটা ঘটনার কো-সিকোয়েন্স বুঝতে অক্ষম তারা কী করে রাজণীতিবিদ হয়? কাল যে সিলেটী ৫০% কোটা দাবী করা হলো এর প্রেক্ষিতে যদি সিলেটের বাইরের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন সিলেটী ছাত্র হেনস্তা হতেন, সেই খবর সিলেটের আসার পালটা হেনস্তা হতেন নন-সিলেটী কেউ? সিলেটী- নন সিলেটী রায়ট লাগিয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরী করতে পারলে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট কালে লাভ হতো কার?
এইসব ন্যুনতম কান্ডজ্ঞান, রাজনৈতিক দূরদর্শন যাদের নেই- তাদের হাতে ভিশন-২০২১ এর ভার!
বিএনপি-জামাতের নষ্টামী নিয়ে কিছু লেখার দরকার আছে কী? যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করে- ধর্ম, আঞ্চলিকতা, লিঙ্গ পরিচয় সবকিছুকেই এরা ব্যবহার করতে জানে- সুচারু রূপে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।