পার্থ মজুমদার ও বাপ্পা মজুমদার দুই ভাই। দুজনই গানের মানুষ। ছোট ভাই জনপ্রিয় শিল্পী। বড় ভাই নিভৃতচারী। তবে, বাপ্পার গুরু তাঁর দাদা।
দুজনে কাজ করেন দুটি আলাদা সংগীত দলে। ‘দলছুট’ আর ‘ধ্রুবতারা’। এই দুই ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন আরেক সংগীতশিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু
১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতসাধক পণ্ডিত বারীন মজুমদার তাঁর দ্বিতীয় সন্তান পার্থ মজুমদারকে ডেকে বললেন, চলো হাসপাতালে যাই। তোমার একটি ভাই হয়েছে।
মাকে আর ভাইকে আনতে বাবার সঙ্গে হাসপাতালে চললেন আট বছর বয়সী পার্থ। অনেক দিন পর আজও পার্থ মজুমদারের মনে পড়ে, দিনটি ছিল অসম্ভব আনন্দের। কারণ, মাত্র ১১ মাস আগে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ত্রাস রাজত্ব ঢাকা শহর ছেড়ে পালানোর সময় বুড়িগঙ্গা নদীতে গানবোট থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হলে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় পণ্ডিত বারীন মজুমদার ও ইলা মজুমদারের বড় মেয়ে ১০ বছর বয়সী মধুমিতা। সেই শোক প্রশমনের জন্যই বাপ্পার জন্ম।
এই সংগীতসাধক পরিবারের উত্তরাধিকার বহন করে চলা দুই সহোদর পার্থ মজুমদার ও বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে ‘আনন্দ’ আড্ডার নানা গল্প আজ।
l বাবা ও মা কতটা প্রভাব ফেলেছেন আপনাদের জীবনে?
পার্থ মজুমদার: জীবনের সব ক্ষেত্রেই তাঁদের প্রভাব আছে। তাঁদের সন্তান বলেই পার্থ মজুমদার না হয়ে আমার আর অন্য কিছু হওয়ার উপায় ছিল না। ঘরে সময় কাটত গানে। অবসরেও গান। স্নানের সময়ও গান।
কিন্তু শুরুর দিকে মা-বাবা সংগীতটা চাপিয়ে দেননি জোর করে।
বাপ্পা মজুমদার: সংগীতটা আমাদের বংশপরম্পরার উত্তরাধিকার বলেই আমার বিশ্বাস। আমাদের দাদু সংগীতামোদী মানুষ ছিলেন। দিদা বাজাতেন সেতার। মায়ের বাবা ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী।
ছিলেন সংস্কৃতিচর্চার পৃষ্ঠপোষক। মায়ের অন্য ভাইবোনেরা সংগীত চর্চা করতেন। দুই মামা খুব ভালো তবলা বাজাতেন। শুদ্ধ সংগীতচর্চার পক্ষে তাঁদের একটা শক্ত অবস্থান ছিল।
পার্থ মজুমদার: আমাদের পারিবারিক জীবনে কোনো অসৎ উপার্জন ছিল না।
‘অসৎ’—কথাটা কখনো শিখিনি। মা-বাবা শেখাননি।
বাপ্পা মজুমদার: খুব ছোটবেলায় একবার রাস্তায় পুলিশের ঘুষ খাওয়া দেখে মন খারাপ করে বাসায় চলে এসেছিলাম। খুব খারাপ লেগেছিল। মাকে বলেওছিলাম।
পুলিশ কেন ঘুষ খাবে? এখন হাসি।
l পণ্ডিত বারীন মজুমদার এ দেশে মিউজিক কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেসব করতে গিয়ে নিজের সাধনা ব্যাহত হয়েছে তাঁর। অসম্মানিতও হয়েছেন কুচক্রী মহলের অপচেষ্টায়। তার পরও এই সংগীতকেই কেন বেছে নিলেন আপনারা?
পার্থ মজুমদার: কোনো ধরনের কষ্টের কথা আমরা বুঝতে পারতাম না।
কারণ, মা-বাবা কখনো তা বুঝতে দেননি। দিদির জন্য মা সারাক্ষণ কাঁদতেন। অসুস্থ হয়ে পড়তেন। সেই কষ্ট কাটানোর জন্য বাপ্পার জন্ম। বাপ্পা বাবার বুকে ঘুমোত।
ওকে বুকে নিয়েই বাবা তানপুরায় স্বরসাধনা করতেন। তালগুলো নিশ্চয়ই বাপ্পার কানে ঢুকে যেত। চার বছর বয়সী বাপ্পা একদিন গেয়ে ফেলল, ‘আমার দীপ নেভানো রাত’ গানটি। আমাদের আরও একজন দাদা পার্থ প্রতিম মজুমদার (মূকাভিনেতা। বাবা-মার পালকপুত্র) বাসায় কিশোর কুমার, ভূপেন হাজারিকার গান আনতেন।
বাবা তখন থেকে শেখানো শুরু করলেন। তবলা বাজাতাম, কিন্তু লয় বেড়ে যেত। আমি ফাইটার প্লেনের পাইলট হতে চেয়েছিলাম। বাবাও রাজি ছিলেন। কিন্তু আমার দৃষ্টিশক্তি খুব দুর্বল।
বাপ্পা মজুমদার: আমার খুব ইচ্ছে ছিল স্থপতি হব। কিন্তু লেখাপড়ায় ছিলাম মহা ফাঁকিবাজ। তাই রেজাল্ট ভালো হয়নি। আমি তখন গিটার নিয়ে মেতে উঠেছি। আমার গিটারগুরু কিন্তু দাদা।
একটা গণসংগীতের দল করলাম। অরণি। সেটাও টিকল না। এখানে-ওখানে গিটার বাজাই। দেখলাম টুকটাক আয় হচ্ছে।
আসলে আমার বেলায় পূর্বনির্ধারিত কোনো দিনক্ষণ ছিল না। এখন মনে হয়, আমাদের আমলে সংগীতটাই করার কথা ছিল।
l সংগীত সাধনা বা চর্চা আপনাদের জীবন বদলে দিয়েছে কতটুকু?
পার্থ মজুমদার: এখন পর্যন্ত আমাদের দুজনের কেউই অসৎ নই। মানুষও কোনো অপ্রীতিকর প্রস্তাব দেয় না। জটিলতায় পড়তে হচ্ছে না।
বাপ্পা মজুমদার: দাদার মতো একই অনুভূতি আমারও। যেন এ রকমই থাকতে পারি।
l একজন স্বনামখ্যাত শিল্পী, অন্যজন নানা শিল্পীর গানে সংগীতায়োজন করছেন, আবার কখনো দুজনই একই কাজ করছেন। এখনকার গান ও শিল্পীরা কেমন?
পার্থ মজুমদার: ইচ্ছে হলেই বা একটু আর্থিক সামর্থ্য থাকলেই যে কেউই এখন গান গাইছে। এটা উচিত নয়।
প্রতিভা অন্বেষণের যে প্রক্রিয়াটা এখানে চলছে, সেটা অনাচারের জন্ম দিচ্ছে। মুঠোফোন থেকে এসএমএস করে প্রতিভা তৈরি হয় না, তার বিকাশও হয় না। হয়তো পাওয়া গেল একজনকে, তাকে হইচই করে তারকা বানানো হলো। ব্যস, সম্ভাবনাটা শেষ হয়ে গেল।
বাপ্পা মজুমদার: আমি খুব ভালো উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী নই।
কিন্তু গানের ভালো বা খারাপটা একটু বুঝতে শিখেছি। আমার নিজেরই এখনো রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের গান গাইতে ভয় হয়। কতজনকে দেখছি নিয়মিত চর্চার কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, তবুও অবলীলায় গেয়ে চলেছে সেসব গান। খুব মানসিক কষ্ট হয়।
l একাত্তরে হারিয়ে যাওয়া দিদির গল্প...
পার্থ মজুমদার: বাবা বলতেন, তোমার মায়ের কষ্ট দূর করার জন্য আমরা বাপ্পাকে এনেছি।
নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মা দিদির কিছু জিনিসপত্র আগলে রাখতেন—ফ্রক, পুঁতির মালা, পুতুল। যেদিন এসব নাড়াচাড়া করতেন, সেদিন মায়ের মুখের দিকে তাকানো যেত না।
বাপ্পা মজুমদার: আমার জন্মের কারণে দিদিকে হারানোর কষ্টটা মা, বাবা ও দাদা খানিকটা ভুলতে পেরেছিলেন, এটা ভেবে আমি কৃতজ্ঞ বোধ করি। যার সঙ্গে আমি খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম, সেই মায়ের সঙ্গে দিদিকে নিয়ে কোনো গল্প হতো না।
l দুই ভাইয়ের চোখে একজন ও অন্যজন কেমন?
পার্থ মজুমদার: বাপ্পা আমার বুকের ভেতরে থাকে।
এটা বলে বোঝানোর ভাষা আমার জানা নেই।
বাপ্পা মজুমদার: তিনজন অসাধারণ মানুষের একজন হলেন দাদা। বাবা, মা ও দাদা। দাদা নিভৃতচারী। আমি ছাড়া দাদার কেউ নেই।
দাদার ছেলে আট বছর বয়সী সুদীপ। ও দাদার ছোট ছেলে আর আমি বড় ছেলে।
l দুজনের দুই ব্যান্ডে কাজ করা কেন?
পার্থ মজুমদার: অনেক আগে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। একসঙ্গে সংগীতায়োজনের কাজ হয়েছে। আর একসঙ্গে ব্যান্ড না করাটা হলো একটা জেনারেশন গ্যাপের কারণে।
আর্ক বানালাম। বামবা’য় থাকলাম। টুটুল এসে বলল, দাদা, ‘ধ্রুবতারা’য় আমাকে সহযোগিতা করুন।
বাপ্পা মজুমদার: দাদা ও আমি মিলে এখনো কাজ করতে পারি। কোনো অসুবিধা নেই।
l যাঁরা শিল্পী হতে চান, তাঁদের জন্য কোনো সুপরামর্শ?
পার্থ মজুমদার: সবার আগে ভালো মানুষ হতে হবে। শিখতে হবে। চর্চার মধ্যে থাকতে হবে।
বাপ্পা মজুমদার: সাধনা করতে হবে। লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হবে।
ভালো কাজের জয় হবেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।